10 Minute School
Log in

রেচনের শারীরবৃত্ত (Physiology of Excretion)

আমিষ জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে দেহে নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্যপদার্থ সৃষ্টি হয়। এসব বর্জ্য দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং যতশীঘ্র সম্ভব দেহ থেকে নিষ্কাশন করা অত্যাবশ্যক। মানুষের প্রধান নাইট্রোজেনঘটিত রেচন(Excretion) বর্জ্য হলো- ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, অ্যামোনিয়া, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি। এর মধ্যে ইউরিয়ার পরিমাণ সর্বাধিক এবং এটি মূত্রের সাথে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। যকৃতে ইউরিয়া উৎপন্ন হয়ে রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বৃক্কে পৌছায়। বৃক্কে মূত্র তৈরি হয়। রেচনে এরূপ ইউরিয়ার আধিক্য থাকাকে ইউরিওটেলিজম (ureotelism) বলে। যেসব প্রাণিতে ইউরিওটেলিজম দেখা যায় তাদের ইউরিওটেলিক প্রাণি (ureotelic animal) বলা হয়। মানুষ ইউরিওটেলিক হওয়ার কারণে রেচনের শারীরবৃত্তকে (Physiology of Excretion) তাই দুটি শিরোনামে আলোচনা করা হলো : 

ক. নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য উৎপাদন এবং খ. মূত্র সৃষ্টি

ক. নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য উৎপাদন (Production of Nitrogenous Waste)

আমিষ খাদ্য পরিপাক হয়ে অ্যামিনো এসিডে পরিণত হয়। অ্যামিনো এসিড প্রধানত দেহ গঠন ও বৃদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হয়। যকৃতে অব্যবহৃত ও অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড থেকে ডিঅ্যামাইনেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে   ডিঅ্যামিনেশন (deamination) প্রক্রিয়ায় অ্যামিনো গ্রুপ (-NH2) হয়ে কিটো এসিড ও NH2, সৃষ্টি করে। কিটো এসিড শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। অ্যামিনো গ্রুপ পরিবর্তিত হয়ে NH3 (অ্যামোনিয়া) উৎপন্ন করে।

NH3 অত্যন্ত বিষাক্ত যা CO2 এর সাথে মিলিত হয়ে যকৃতে অরনিথিন চক্রের (ornithine cycle) মাধ্যমে ক্ষতিকর ও পানিতে দ্রবণীয় ইউরিয়া (urea)-য় পরিণত হয়। এটি ইউরিয়া চক্র নামেও পরিচিত। ইউরিয়া প্লাজমায় (রক্তরসে) অবস্থান করে এবং সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে বৃক্কে পৌছায়।

খ. মূত্র সৃষ্টি (Formation of Urine)

স্কটিশ শারীরবিজ্ঞানী Arthur Robertson Cushney (1917)-র মতে, নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে আসার পর তিনটি ধাপে মূত্র সৃষ্টি হয়, যথা: (১) অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ, (২) টিউবিউলার পুনঃশোষণ এবং (৩) সক্রিয় ক্ষরণ ।

১. অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ বা আল্ট্রাফিল্ট্রেশন (Ultrafiltration)

মূত্র তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে রক্তের অতিসূক্ষ্ম  পরিস্রাবণ। নেফ্রনের রেনাল করপাসলে এ পদ্ধতি সংঘটিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ড থেকে পৃষ্ঠীয় ধমনি, রেনাল ধমনি এবং অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের মাধ্যমে রক্ত অতি উচ্চ চাপে গ্লোমেরুলাসে প্রবেশ করে। সাধারণত অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের তুলনায় ইফারেন্ট আর্টারিওলের ব্যাস সংকীর্ণ হওয়ায় গ্লোমেরুলাসে রক্তের উচ্চ চাপ সৃষ্টি হয়। এ হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপে রক্তের প্রোটিন ও রক্তকণিকা ছাড়া সমস্ত পানি, লবণ, শর্করা, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড প্রভৃতি কৈশিক জালিকার এন্ডোথেলিয়াম ও ভিত্তিঝিল্লি এবং রেনাল ক্যাপসুলের এপিথেলিয়াম ভেদ করে ক্যাপসুলার স্পেস-এ জমা হয়। এ পরিস্রুত তরলকে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট বা প্রাথমিক মূত্র বলে। মানবদেহের দুটি বৃক্কের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে প্রায় 1200 ml রক্ত প্রবাহিত হয়। এর রক্ত থেকে প্রায় 125 ml গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট বৃক্কের মাধ্যমে বোম্যানস ক্যাপসুল-এ জমা হয়।

অন্যদিকে পরিস্রুত রক্ত পরে  ইফারেন্ট আর্টারিওলে প্রবেশ করে। যে চাপের মাধ্যমে রক্তের দ্রাব্য বস্তু পরিস্রুত হয়, তাকে বলে কার্যকর পরিস্রাবণ চাপ (effective filtration pressure)। পরিস্রাবণ প্রক্রিয়াটি চাপ প্রয়োগের ফলে সংঘটিত হয় বলে একে আল্ট্রাফিল্ট্রেশন বলা হয় । হিসেবে দেখা গেছে, কার্যকর পরিস্রাবণ চাপ ২৫ mmHg। এ চাপের প্রভাবে প্রতি মিনিটে প্রায় ১২৫ ml রক্তরস গ্লোমেরুলাস থেকে পরিস্রুত হয়। তবে এ হার পরিস্রাবণ চাপের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।

বোম্যানস ক্যাপসুল-আল্ট্রাফিল্ট্রেশন - রেচনের শারীরবৃত্ত (Physiology of Excretion)

২. টিউবিউলার পুনঃশোষণ বা নির্বাচিত পুনঃশোষণ (Tubular reabsorption or Selective reabsorption) :

বোম্যানস ক্যাপসুল থেকে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেট বৃক্ক নালিকা বা রেনাল টিউবিউলে প্রবেশ করে। এখানে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেট ৮০% নির্বাচিত পদার্থ পুনঃশোষিত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে। টিউবিউলের প্রাচীরের কোষগুলো পুনঃশোষণের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। যেমন-  

  • কোষগুলোর একপাশে মাইক্রোভিলাই ও বেসাল চ্যানেল তাকায় এদের শোষণতল বেশি
  • সাইটোপ্লাজমে বেশি সংখ্যক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে  
  • রক্তের কৈশিক জালিকার সাথে ঘন সন্নিবিষ্ট থাকে

রেনাল টিউবিউলসের বিভিন্ন অংশে যেসব পদার্থের পুনঃশোষণ হয় তা হলো –

  • প্রক্সিমাল বা নিকটবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Proximal convoluted tubule) : এখানে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেটের ৬০% পুনঃশোষিত হয়। গ্লুকোজ, অ্যামিনো এসিড, ভিটামিন, হরমোন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, ফসফেট, বাইকার্বোনেট, পানি, কিছু ইউরিয়া ইত্যাদি এ অংশে পুনঃশোষিত হয়।

নেফ্রন এ মূত্র সৃষ্টি কৌশল

  • হেনরির লুপ (Loop of Henle) : এখানে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, হাইড্রোজেন, ক্লোরিন আয়ন ইত্যাদি পুনঃশোষিত হয়। অন্যদিকে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) পানি পুনঃশোষণে সাহায্য করে।
  • ডিস্টাল বা দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Distal convoluted tubule) : এখানে পটাসিয়াম, হাইড্রোজেন, ক্লোরিন আয়ন ইত্যাদি যত হয়। অন্যদিকে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) পানি পুনঃশোষণে সাহায্য করে।
  • সংগ্রাহী নালি (Collecting Duct) : এখানে প্রধানত পানি এবং অল্প Cl, Na+ ও ইউরিয়া পুনঃশোষিত হয়।

৩. টিউবিউলার ক্ষরণ বা সক্রিয় ক্ষরণ (Tubular or Active secretion) :

বিপাক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট কিছু অপ্রয়োজনীয় উপজাত পদার্থ, যথা- ক্রিয়েটিনিন ও কিছু ইউরিয়া প্রক্সিমাল প্যাঁচানো নালিকার চারপাশে রক্তজালক থেকে সক্রিয় ক্ষরণের মাধ্যমে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেটের সাথে যুক্ত হয়। ডিস্টাল প্যাঁচানো নালিকায় হাইড্রোজেন আয়ন, পটাসিয়াম ও অ্যামোনিয়াম আয়ন, সেরেটোনিন, কোলিন, হিস্টামিন ইত্যাদি ক্ষরিত হয়ে ফিলট্রেটের সাথে মিশে মূত্রে (urine) পরিণত হয়। উৎপন্ন মূত্র অতঃপর সংগ্রাহী নালিকা, ইউরেটার হয়ে মূত্রথলি থেকে মূত্রনালির মাধ্যমে বাইরে নিষ্কাশিত হয়।

মূত্র বা নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের গতিপথ নিচে দেখানো হলো :

হৃৎপিণ্ড অ্যাওর্টা পৃষ্ঠীয় মহাধমনি রেনাল ধমনি অ্যাফারেন্ট আর্টারিওল গ্লোমেরুলাস বোম্যানস ক্যাপসুলের গহ্বর রেনাল টিউবিউলস সংগ্রাহী নালি বৃক্কের পেলভিস ইউরেটার মূত্রথলি মূত্রনালি রেচন ছিদ্র দেহের বাইরে নিষ্কাশন।

 

টিউবিউলার পুনঃশোষণ এবং টিউবিউলার ক্ষরণের মধ্যে পার্থক্য (Tubular reabsorption and Tubular secretion)

টিউবিউলার পুনঃশোষণ

টিউবিউলার ক্ষরণ

১. গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট থেকে কয়েকটি নির্বাচিত পদার্থ রক্তে প্রবেশ করে। ১. রক্ত থেকে কয়েকটি নির্বাচিত পদার্থ অপসারিত হয়ে বৃক্ক নালিকায় প্রবেশ করে।
২. পুনঃশোষিত পদার্থগুলো হলো গ্লুকোজ, অ্যামিনো এসিড, অজৈব আয়ন, পানি, ভিটামিন ইত্যাদি। ২. ক্ষরিত পদার্থগুলো হলো গ্লুকোজ, অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন, হিপপিউরিক এসিড ইত্যাদি।
৩. ব্যাপন ও সক্রিয় পরিবহন প্রক্রিয়ায় পুনঃশোষণ ঘটে। ৩. কেবল সক্রিয় পরিবহন প্রক্রিয়ায় ক্ষরণ ঘটে।

 

মূত্র (Urine)

নেফ্রনের রেনাল টিউবিউলসে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেটের নির্বাচিত পুনঃশোষণের পর যে খড় বর্ণের, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত ও অম্লধর্মী তরল রেচন(Excretion) বর্জ্য মূত্রথলিতে জমা হয় তাকে মূত্র বলে। একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ১.৫ লিটার মূত্রের  মূত্র ত্যাগ করে। তবে কিছু কারণে এ পরিমাণ প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন- খাদ্যে তরল পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকলে মূত্রের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও শরীরে ঘাম বেশি হলে মূত্রের পরিমাণ কমে যায়। খাদ্যের প্রকৃতিও অনেক সময় মূত্রের পরিমাণের পার্থক্য ঘটায়। লবণাক্ত খাদ্য সাধারণত মূত্রের পরিমাণ বাড়ায়। বহুমূত্র (diabetes), বৃক্ক প্রদাহ (nephritis)  প্রভৃতি রোগ প্রস্রাবের হার ও মাত্রা উভয়কে প্রভাবিত করে। কিছু দ্রব্য মূত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাড়িয়ে দেয়। এসব দ্রব্য ডাইইউরেটিকস (diuretics) বা মূত্রবর্ধক নামে পরিচিত । পানি, লবণাক্ত পানি, চা ও কফি এ ধরনের দ্রব্য।

মূত্রের বৈশিষ্ট্য (Properties of Urine) :

  • পরিমাণ : প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের বৃক্কে দৈনিক ০.৫ থেকে ২.৫ লিটার মূত্র উৎপন্ন হয়।
  • বর্ণ : মূত্রে ইউরোক্রোম নামক রঞ্জক পদার্থ থাকায় এটি খড় (হালকা হলুদ) বর্ণের হয়।
  • গন্ধ : মূত্রের গন্ধ অনেকটা ঝাঁঝালো। দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ ইউরিনোড (C6H8O)- এর উপস্থিতির জন্য মূত্রে এরূপ গন্ধ হয়।
  • রাসায়নিক ধর্ম : মূত্র সামান্য অম্লীয়। এর pH মান ৫.০ – ৬.৫।
  • আপেক্ষিক গুরুত্ব : মূত্রের স্বাভাবিক আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০০৮ – ১.০৩০।

মূত্রের উপাদান (Urine components) :

মূত্রের রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে ৯৫% (৯৫-৯৭%) পানি এবং ৫% (৩. মধ্যে জৈব ও অজৈব উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে সামান্য পরিমাণে আয়োডিন, সিসা, আর্সেকনিক প্রভৃতি পাওয়া যায়।

জৈব উপাদান

শতকরা হার

অজৈব উপাদান

শতকরা হার

ইউরিয়া

সোডিয়াম

০.৩৫

ইউরিক এসিড

.০৫

পটাসিয়াম

০.১৫

হিপপিউরিক এসিড

.০৫

ক্যালসিয়াম

০.০৩

ক্রিয়েটিনিন

.০৭

অ্যামোনিয়াম

০.০৪

কিটোন বডিস

.০২

ম্যাগনেসিয়াম

০.০১

ক্রিয়েটিন

.০১

ক্লোরাইড

০.৬০

সালফেট

০.১৮

ফসফেট

০.২৭

 

রেচন ও অসমোরেগুলেশনে বৃক্কের ভূমিকা (Role of Kidney in Excretion and Osmoregulation)

কোষ থেকে নাইট্রোজেনঘটিত বিপাকীয় বর্জ্যের অপসারণের আরেক নাম রেচন(Excretion)। বিপাকীয় বর্জ্য দেহের জন্য অপ্রয়োজনীয়। দেহকোষ, টিস্যু ও অঙ্গে যে অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তার ফলে দেহের জন্য ক্ষতিকর যেসব বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন হয় তা রেচনে এবং দেহের অসমোরেগুলেশনে (রক্তে পানি ও আয়নসাম্য রক্ষা) বৃক্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রেচনে বৃক্কের ভূমিকা (Role of Kidney in Excretion)

বৃক্ক প্রধানত নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ দেহ থেকে নিষ্কাশন করে । আমিষ জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে দেহে নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য সৃষ্টি হয়। অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি মানুষের প্রধান নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য। এদের রেচন(Excretion) বর্জ্য বলে। এগুলো রক্তের মাধ্যমে সারাদেহে প্রবাহিত হয়। এগুলো বিষাক্ত ও দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই এসব রেচন পদার্থ দেহ থেকে নিষ্কাশন করা অত্যাবশ্যক। বৃক্ক এসব রেচন পদার্থ দেহ থেকে অপসারণ করে দেহকে সুস্থ রাখে । নিম্নলিখিত উপায়ে বৃক্ক এসব বর্জ্য নিষ্কাশন করে।

  • ইউরিয়া বর্জ্য : আমিষ জাতীয় খাদ্য পরিপাক হয়ে অ্যামিনো এসিডে পরিণত হয়। অ্যামিনো এসিড প্রধানত দেহ গঠন ও বৃদ্ধির কাজ করে থাকে। অ্যামিনো এসিডের বৈশিষ্ট্য হলো দেহে যতটুকু অ্যামিনো এসিড প্রয়ােজন ঠিক ততটুকুই ব্যবহৃত হতে পারে, অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড দেহে সঞ্চিত থাকতে পারে না। অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড যকৃতে ডি-অ্যামাইনেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ডি-অ্যামিনেশন (deamination) প্রক্রিয়ায় কিটো এসিড ও অ্যামিন মূলক (C, NH) সৃষ্টি করে। কিটো এসিড শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং অ্যামিন মূলক (NH) হাইড্রোজেন আয়ন (H+) এর সাথে যুক্ত হয়ে অ্যামোনিয়া (NH3) সৃষ্টি করে। অ্যামোনিয়া (NH3) অত্যন্ত বিষাক্ত। এটি (CO2) এর সাথে যুক্ত হয়ে যকৃতে অরনিথিন চক্রের মাধ্যমে কম ক্ষতিকারক পানিতে দ্রবণীয় ইউরিয়াতে পরিণত হয়। ইউরিয়া রক্তের প্লাজমায় অবস্থান করে এবং সংবহন তন্ত্রের মাধ্যমে বৃক্কে পৌছে। এরপর মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে দেহ থেকে বহিষ্কৃত হয়।
  • ইউরিক এসিড বর্জ্য : যকৃতের কোষে নিউক্লিক এসিডের পিউরিন ক্ষারক বিপাকের ফলে ইউরিক এসিড সষ্টি হয়। এটি ইউরিয়া অপেক্ষা কম বিষাক্ত। ইউরিক এসিড রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে পৌঁছে এবং দেহ থেকে বহিষ্কৃত হয়।
  • ক্রিয়েটিনিন বর্জ্য : দেহের পেশিতে অবস্থিত ক্রিয়েটিন (creatine) নামক অ্যামিনো এসিডের বিপাকের ফলে ক্রিয়েটিনিন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। দেহে বিদ্যমান প্রায় ২% ক্রিয়েটিন বিপাক প্রক্রিয়ায় পেশিতে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং ক্রিয়েটিনিন সৃষ্টি করে। ক্রিয়েটিনিন রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে পৌছে। বৃক্কে রক্ত থেকে ক্রিয়েটিনিন পরিস্রুত হয়ে মুত্রের সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দ্বারা বৃক্কের সুস্থতা নির্ণয় করা হয়। তাই রক্তের ক্রিয়েটিনিন মাত্রাকে বৃক্কের রোগ নির্ণয়ের নির্দেশক (diagnostic index of kidney) হিসেবে গণ্য করা হয়। রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষের 0.6 – 1.2 mg/dl এবং মহিলাদের 0.5 – 1.1 mg/dl. বৃক্কের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষ, অতিরিক্ত ঔষধ, হরমোন ইত্যাদিও মূত্রের সাথে বহিষ্কৃত হয়।

অসমোরেগুলেশনে বৃক্কের ভূমিকা (Role of Kidney in Osmoregulation)

অসমোরেগুলেশন প্রক্রিয়া বলতে জীবন্ত কোষ বা দেহের অন্তঃ ও বহিঃপরিবেশের মধ্যে তা সমতা রক্ষাকে বুঝায়। দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের স্থিতি বজায় রাখতে (homeostasis) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেহের পানি ও সোডিয়াম, পটাসিয়াম লবণ এবং ক্লোরাইড আয়নের মধ্যে একটি আন্তরসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়াকে অসমোরেগুলেশন বলা হয়।

অসমোরেগুলেশন পদ্ধতি (Osmoregulation system) :

দেহে পানির সমতা রক্ষা করার জন্যে অ্যান্টিডাইইউরেটিক হরমোন (Antidiuretic Hormone, ADH) নামক একটি হরমোন রয়েছে ADH-কে ভ্যাসোপ্রেসিন (vasopressin)-ও বলা হয়। দেহের পানির পরিমাণ কম হলে রক্তে ADH এর পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে বৃক্ক অল্প পরিমাণ (মিনিটে ০.৫ মিলিলিটার), মূত্র উৎপন্ন করে এবং দেহের পানির পরিমাণ ঠিক রাখে।

অন্যদিকে কোন কারণে পানির আধিক্য দেখা দিলে রক্তে ADH অতিমাত্রায় কমে যায় এবং দেহের পানির পরিমাণ বেড়ে যায় কারণ বৃক্কে পানি শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। এ অবস্থায় মূত্রের পরিমাণ প্রতি মিনিটে ১৬ মিলিলিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। মস্তিষ্কের গোড়ায় হাইপোথ্যালামাস অংশে কিছু স্নায়ুকোষ এ ADH ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকে নিউরোসিক্রেশন (neurosecretion) পদ্ধতির মাধ্যমে নিঃসৃত ADH পশ্চাৎ পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যে পরিবাহিত হয় এবং রক্তে অবমুক্ত হয়। হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে উপস্থিত অসমোরিসেপ্টর (osmoreceptor) নামক স্নায়ুকোষ দেহ তরলের অভিস্রবণিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।