পয়সনের অনুপাত, ইস্পাত, রবারের স্থিতিস্থাপকতা, প্রবাহীর প্রবাহ
পয়সনের অনুপাত (Poisson’s Ratio)
যখন কোনো তারে দৈর্ঘ্য বরাবর বল প্রয়োগ করা হয় তখন তারের দৈর্ঘ্য কিছুটা বেড়ে যায় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তারের ব্যাস কিছু কমে যায় বা তার সরু হয়ে যায়। প্রস্থের দিকে যে বিকৃতি হয় তাকে পার্শ্ব বিকৃতি বলে। কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য বিকৃতি ঘটলে পার্শ্ব বিকৃতিও ঘটে। বৈজ্ঞানিক সাইমন পয়সন দেখান যে, স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে পার্শ্ব বিকৃতি দৈর্ঘ্য বিকৃতির সমানুপাতিক।
সংজ্ঞা : স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর পার্শ্ব বিকৃতি ও দৈর্ঘ্য বিকৃতির অনুপাত একটি ধ্রুব সংখ্যা। এ ধ্রুব সংখ্যাকে বস্তুর উপাদানের পয়সনের অনুপাত বলে। পয়সনের অনুপাতকে σ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
\text { পয়সনের অনপাত, } \sigma=\frac{\text { পার্শ্ব বিকৃতি }}{\text { দৈর্ঘ্য বিকৃতি }}মান : বৃত্তাকার প্রস্থচ্ছেদ বিশিষ্ট কোনো তারের দৈর্ঘ্য L ও ব্যাস D হলে এবং বাহ্যিক বলের প্রভাবে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি l হলে ও ব্যাস d পরিমাণ কমে গেলে, দৈর্ঘ্য বিকৃতি =\frac{l}{L} এবং পার্শ্ব বিকৃতি =\frac{d}{D}
∴ পয়সনের অনুপাত, \sigma=\frac{d / D}{l / L}=\frac{d L}{D l}
ব্যাসের পরিবর্তে ব্যাসার্ধ দিয়েও পয়সনের অনুপাতকে প্রকাশ করা যেতে পারে।
ধরা যাক, তারের আদি দৈর্ঘ্য L এবং ব্যাসার্ধ r। বাহ্যিক বলের প্রভাবে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি \Delta L এবং ব্যাসার্ধের হ্রাস \Delta r হলে,
দৈর্ঘ্য বিকৃতি =\frac{\Delta L}{L_{0}}
পার্শ্ব বিকৃতি =-\frac{\Delta r}{r}
\therefore \sigma=\frac{\frac{\Delta r}{r}}{\frac{\Delta L}{L_{0}}}=-\frac{\Delta r L_{0}}{r \Delta L}এখানে ঋণাত্মক চিহ্ন দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, \Delta L ধনাত্মক হলে \Delta r ঋণাত্মক হবে এবং \Delta L ঋণাত্মক হলে \Delta r ধনাত্মক হবে। অর্থাৎ বল প্রয়োগে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেলে ব্যাসার্ধ হ্রাস পাবে আর দৈর্ঘ্য হ্রাস পেলে ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পাবে।
মাত্রা ও একক : বিকৃতি একই জাতীয় দুটি রাশির অনুপাত বলে বিকৃতির মাত্রা ও একক নেই। পয়সনের অনুপাত দুটি বিকৃতির অনুপাত বলে পয়সনের অনুপাতের কোনো মাত্রা ও একক নেই।
তাৎপর্য : অ্যালুমিনিয়ামের পয়সনের অনুপাত 0.35 বলতে বোঝায় অ্যালুমিনিয়ামের দৈর্ঘ্য বরাবর স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বল প্রয়োগ করলে পার্শ্ব বিকৃতি ও দৈর্ঘ্য বিকৃতির অনুপাত সব সময় 0.35 হয়।
তাত্ত্বিকভাবে দেখানো যায় যে, পয়সনের অনুপাতের মান -1 এর চেয়ে কম এবং +\frac{1}{2} এর চেয়ে বেশি হতে পারে না অর্থাৎ -1 \leq \sigma \leq \frac{1}{2} । বাস্তবে পয়সনের অনুপাত কেবলমাত্র তখনই ঋণাত্মক হওয়া সম্ভব যখন দৈর্ঘ্য প্রসারণের ফলে বস্তুর ব্যাস বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ পার্শ্বীয় প্রসারণ ঘটে। কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পয়সনের অনুপাতের মান ঋণাত্মক হওয়া সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ধাতব পদার্থের ক্ষেত্রে এ মান সাধারণত 0.3 হয়ে থাকে। ধাতব পদার্থের ক্ষেত্রে তাই পয়সনের অনুপাতের সীমা ধরা হয় 0 \leq \sigma \leq \frac{1}{2}।
ইস্পাত রবারের চেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক (Steel is more Elastic than Rubber)
এক টুকরো রবারের ফিতে টানলে সহজেই বেড়ে যায়, কিন্তু একটি ইস্পাতের তার টানলে তা সহজে বাড়ে না। একই প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল ও দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট দুটি ভিন্ন বস্তুর মধ্যে যে বস্তুতে যত বেশি প্রতিরোধ বলের সৃষ্টি হয় সেই বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা তত বেশি। প্রতিরোধ বল প্রযুক্ত বলের সমান বলে নির্দিষ্ট বিকৃতি সৃষ্টি করতে যে বস্তুতে যত বেশি বল প্রয়োগ করতে হয় তাকে তত বেশি স্থিতিস্থাপক বলা হয়। এ হিসাবে দেখা যায় যে, একই দৈর্ঘ্য ও প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট রবার ও ইস্পাতের তারে সমান দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে রবারের তুলনায় ইস্পাতের তারে বল প্রয়োগ করতে হয় অনেক বেশি। এজন্য রবারের তুলনায় ইস্পাতের স্থিতিস্থাপকতা অনেক বেশি।
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক ও পয়সনের অনুপাতের তালিকা
পদার্থ | ইয়ং গুণাঙ্ক
10^{10} N m^{-2} |
আয়তন গুণাঙ্ক
10^{10} N m^{-2} |
দৃঢ়তার গুণাঙ্ক
10^{10} N m{-2} |
পয়সের অনুপাত | |
১ | ইস্পাত | 20 | 17 | 8.4 | 0.33 |
২ | লোহা (পেটা) | 20 | 17 | 8.0 | 0.28 |
৩ | নিকেল | 20 | 16 | 7.9 | 0.31 |
৪ | তামা | 13 | 14 | 4.8 | 0.34 |
৫ | লোহা (ঢালাই) | 11.5 | 90 | 4.6 | 0.24 |
৬ | পিতল (60% তামা) | 10 | 11 | 3.5 | 0.33 |
৭ | অ্যালুমিনিয়াম | 7.00 | 7.7 | 2.6 | 0.35 |
৮ | কাঁচ | 6.00 | 3.7 | 3.1 | 0.18-0.3 |
৯ | সীসা | 1.6 | 4.6 | 0.56 | 0.44 |
১০ | পারদ | 2.8 | |||
১১ | গ্লিসারিন | 0.40 | |||
১২ | পানি | 0.21 | |||
১৩ | পেট্রোলিয়াম | 0.14 | |||
১৪ | ইথাইল অ্যালকোহল | 0.11 |
সম্প্রসারিত কর্মকাণ্ড (Extended Activities)
তারের সম্প্রসারণে কৃতকাজ বা স্থিতিস্থাপক বিভব শক্তির রাশিমালা বের কর।
বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে কোনো বস্তুকে বিকৃত করলে কিছু কাজ করতে হয় এবং ঐ কাজ বস্তুতে বিভব শক্তিরূপে সঞ্চিত থাকে। আবার বাহ্যিক বল অপসারিত হলে বস্তু তার আগের আকার ফিরে পায় এবং ঐ শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
মোট কৃতকাজ বা বিভব বা স্থিতি শক্তি (Total Accomplishment or Potental or Status Energy)
ধরা যাক, L দৈর্ঘ্য ও A প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট একটি তারকে দৃঢ় অবলম্বন থেকে ঝুলানো হয়েছে। মনে করি, এই তারে F বল প্রয়োগ করার ফলে এর দৈর্ঘ্য dl পরিমাণ বৃদ্ধি পেল। সুতরাং তারে সঞ্চিত বিভব শক্তির পরিবর্তন বা কৃতকাজ হবে = বল দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি।
কৃতকাজ d W=F d l
এই সমীকরণকে l= 0 থেকে l=l এই সীমার মধ্যে সমাকলন করে সঞ্চিত মোট বিভব শক্তি বা কৃতকাজ পাই,
W=\int_{0}^{l} F d l ⋯⋯ (7.15)
ইয়ং গুণাঙ্ক থেকে আমরা জানি যে,
Y=\frac{F L}{A l}যেখানে L তারের মোট দৈর্ঘ্য, A প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল এবং দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, F বল।
F=\frac{Y A l}{L}এখন (7.15) সমীকরণে F এর মান বসালে,
W=\int_{0}^{l} \frac{Y A l}{L} d l=\frac{Y A}{L} \int_{0}^{l} l d l=\frac{Y A}{L}\left[\frac{l^{2}}{2}\right]_{0}^{l} W=\frac{Y A}{L} \frac{l^{2}}{2}W=\frac{1}{2} \frac{Y A l^{2}}{L} … … … (7.16)
এই কাজই তারের মধ্যে স্থিতিস্থাপক বিভব হিসেবে সঞ্চিত থাকে।
একক আয়তনে সঞ্চিত বিভব শক্তি (The Potental Energy Stored in a Single Volume)
কিন্তু তারের মোট আয়তন, V= প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল × দৈর্ঘ্য = AL
একক আয়তনে সঞ্চিত বিভব শক্তি বা কৃতকাজ U=\frac{W}{V}
=\frac{\frac{1}{2} \frac{Y A l^{2}}{L}}{A L} =\frac{1}{2} \frac{Y A l}{L} \frac{l}{L}=\frac{1}{2} \frac{Y l^{2}}{L^{2}}
∴U=\frac{1}{2} পীড়ন × বিকৃতি
কারণ পীড়ন =\frac{F}{A}=\frac{Yl}{L} এবং বিকৃতি =\frac{l}{L}
প্রবাহীর প্রবাহ (Flow of Fluids)
স্রোতরেখা বা ধারারেখ প্রবাহ (Streamline flow)
মনে করা যাক, \mathrm{ABC} পথ বরাবর কোনো তরল পদার্থ প্রবাহিত হচ্ছে। ধরা যাক যে, তরল পদার্থের কোনো কণা \overrightarrow{\mathrm{v}_{1}}, \overrightarrow{\mathrm{v}_{2}} এবং \overrightarrow{\mathrm{v}_{3}} বেগ নিয়ে যথাক্রমে \mathrm{A}, \mathrm{B} ও \mathrm{C} বিন্দু অতিক্রম করছে। প্রবাহটি যদি ধারারেখ হয় তাহলে কোনো নতুন কণা \mathrm{A} বিন্দুতে পৌছালে এর বেগ \overrightarrow{\mathrm{v}_{1}} এর সমান হবে। এ বেগের অভিমুখ হবে \mathrm{A} বিন্দুতে অঙ্কিত \mathrm{ABC} পথের স্পর্শকের অভিমুখে। কোনো কণা \mathrm{B} তে পৌঁছালে এর বেগ হবে \overrightarrow{\mathrm{v}_{2}}। এই বেগ \overrightarrow{\mathrm{v}_{1}} এর সমান হতে পারে আবার নাও হতে পারে। একইভাবে \mathrm{C} বিন্দু অতিক্রমকারী সকল কণার বেগ হবে \overrightarrow{\mathrm{v}_{3}}।
সুতরাং বলা যায় যে, প্রবাহিত হওয়ার সময় তরল পদার্থের সকল কণা যদি একই বেগ নিয়ে এর অগ্রবর্তী কণার পথ অনুসরণ করে তাহলে সে প্রবাহকে ধারারেখ প্রবাহ বা স্রোতরেখা প্রবাহ বা শান্ত প্রবাহ বলে। ধারারেখ প্রবাহের বেলায় কোনো নির্দিষ্ট বিন্দু অতিক্রমকারী সকল কণার ঐ বিন্দুতে বেগ একই বা সমান থাকে। কিন্তু কণাগুলোর বেগ এদের পথের বিভিন্ন বিন্দুতে পৃথক হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ধারারেখ হলে গতিপথের যেকোনো বিন্দুতে অঙ্কিত স্পর্শক ঐ বিন্দুতে তরলের প্রবাহের অভিমুখ বা দিক নির্দেশ করে। ধারারেখা সরল বা বক্র হতে পারে।
একগুচ্ছ ধারা রেখকে একত্রে প্রবাহ নল বা প্রবাহ বলে।
বিক্ষিপ্ত প্রবাহ (Turbulent flow)
কোনো তরল পদার্থ ধারারেখ প্রবাহে প্রবাহিত হয় যদি এর বেগ ক্রান্তি বেগ নামক একটি সীমান্তিক বেগের চেয়ে কম হয়। কোনো তরল পদার্থের বেগ যদি এর ক্রান্তি বেগের চেয়ে বেশি হয় তাহলে তরল পদার্থের কণার পথ ও বেগ প্রতিনিয়ত এলোমেলোভাবে পরিবর্তিত হয় ফলে কণাগুলো আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়। এতে প্রবাহী এর সকল নিয়মানুবর্তিতা হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের প্রবাহকে বিক্ষিপ্ত বা অনিয়ত বা অশান্ত প্রবাহ বলে। এ ধরনের গতিতে যেকোনো বিন্দুতে তরল পদার্থের কণার বেগের মান ও দিক উভয়ই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়।
অধ্যাপক অসবর্ন রেনল্ডস (Prof. Osborne Reynolds) সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন যে, কোনো তরলের ক্রান্তিবেগ নির্ভর করে তরলের সান্দ্রতাঙ্ক (n), তরলের ঘনত্ব (\rho) এবং যে নল দিয়ে তরল প্রবাহিত হচ্ছে তার ব্যাসার্ধের (r)উপর। তিনি হিসাব করে দেখান যে,
ক্রান্তিবেগ, v_{c} \propto \frac{n}{\rho r}
v_{c}=R_{e} \frac{n}{\rho r}এখানে, R_{e}= রেনল্ডস-এর সংখ্যা = একটি ধ্রুবক। এই ধ্রুবকের মানের উপর নির্ভর করে তরলের প্রবাহ ধারারেখ প্রবাহ হবে না বিক্ষিপ্ত প্রবাহ হবে। R_{e}<2000 হলে অর্থাৎ রেনল্ডস-এর সংখ্যা 2000-এর কম হলে তরল প্রবাহ ধারারেখ প্রবাহ হবে। আর R_{e} এর মান 2000 থেকে 3000 এর মধ্যে হলে বুঝতে হবে তরল প্রবাহ ধারারেখ থেকে বিক্ষিপ্ত প্রবাহে রূপান্তরিত হচ্ছে। R_{e} এর মান 3000 এর উপরে হলে প্রবাহ পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত প্রবাহে পরিণত হবে।