বিভিন্ন প্রকার বিকৃতি ও পীড়ন
বিভিন্ন প্রকার বিকৃতি ও পীড়ন (Different Types of Strain and Stress)
পরিবর্তনের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বিকৃতি ও পীড়ন তিন রকমের হতে পারে ।
(ক) দৈর্ঘ্য বা টান বিকৃতি ও দৈর্ঘ্য বা টান পীড়ন (Longitudinal or Tensile Strain and Longitudinal or Tensile Stress)
দৈর্ঘ্য বিকৃতি (Longitudinal Strain) : কোনো বস্তুর উপর বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে যদি এর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটে তাহলে একক দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনকে দৈর্ঘ্য বিকৃতি বলে ।
ব্যাখ্যা : L দৈর্ঘ্যের কোনো বস্তুর উপর দৈর্ঘ্য বরাবর বল প্রয়োগ করলে যদি এর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন l হয় তাহলে দৈর্ঘ্য বিকৃতি =\frac{l}{L}
দৈর্ঘ্য পীড়ন (Longitudinal Stress) : দৈর্ঘ্য বিকৃতি প্রতিরোধ করার জন্য বস্তুর একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে যে প্রতিরোধ বলের সৃষ্টি হয় অর্থাৎ দৈর্ঘ্য বিকৃতি ঘটাতে বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর দৈর্ঘ্য বরাবর যে বল প্রযুক্ত হয় তাকে দৈর্ঘ্য পীড়ন বলে ।
ব্যাখ্যা : দৈর্ঘ্য বিকৃতি ঘটাতে যদি কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য বরাবর A প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলের উপর F বল লম্বভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে দৈর্ঘ্য পীড়ন =\mathrm{FA}
তারের নিচের প্রান্তে যদি M ভরের বস্তু ঝুলিয়ে বল প্রয়োগ করা হয়, তাহলে \mathrm{F}=\mathrm{Mg} এবং তারের ব্যাসার্ধ r হলে, A=\pi r^{2}
সুতরাং দৈর্ঘ্য পীড়ন =\frac{F}{A}=\frac{M g}{\pi r^{2}}
(খ) আয়তন বিকৃতি ও আয়তন পীড়ন (Volume or Bulk Strain and Volume or Bulk Stress)
আয়তন বিকৃতি (Volume or Bulk Strain) : বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে যদি কোনো বস্তুর আকারের পরিবর্তন না হয়ে শুধু আয়তনের পরিবর্তন হয় তাহলে একক আয়তনের পরিবর্তনকে আয়তন বিকৃতি বলে ।
ব্যাখ্যা : V আয়তনের কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগের ফলে যদি এর আয়তন v পরিমাণ কমে যায় তাহলে, আয়তন বিকৃতি =\frac{v}{V}
আয়তন পীড়ন (Volume or Bulk Stress) : আয়তন বিকৃতি প্রতিরোধ করার জন্য বস্তুর একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে যে প্রতিরোধ বলের সৃষ্টি হয় অর্থাৎ আয়তন বিকৃতি ঘটাতে বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে যে বল প্রযুক্ত হয় তাকে আয়তন পীড়ন বলে ।
ব্যাখ্যা : আয়তন বিকৃতি ঘটাতে যদি কোনো বস্তুর A ক্ষেত্রফলের উপর F বল লম্বভাবে প্রয়োগ করতে হয় তাহলে, আয়তন পীড়ন = \mathrm{FA}
(গ) আকার বা ব্যবৰ্তন বা মোচড় বিকৃতি ও আকার বা ব্যবৰ্তন বা মোচড় পীড়ন (Shearing Strain and Shearing Stress)
একখানি বইয়ের উপরের পৃষ্ঠে করতল স্থাপন করে যদি আমরা অনুভূমিকভাবে F বল প্রয়োগ করি তাহলে বইখানির আয়তনের কোনো পরিবর্তন না হলেও আকৃতি বদলে যাবে । বস্তুর আকৃতির এ ধরনের পরিবর্তনকে ব্যবৰ্তন বলে ।
ব্যবৰ্তন বিকৃতি (Shearing Strain) : ধরা যাক, চিত্রে রাবারের তৈরি একটি পুরু আয়তাকার ব্লক । ব্লকটির ভূমি আঠার সাহায্যে একটি টেবিলের উপর অনুভূমিকভাবে শক্ত করে আটকানো আছে । এখন আমরা যদি ব্লকটির উপরের পৃষ্ঠে স্পর্শক বরাবর অর্থাৎ অনুভূমিকভাবে বল প্রয়োগ করি তাহলে ব্লকটির আকৃতির পরিবর্তন হবে কিন্তু আয়তনের কোনো পরিবর্তন হবে না । আয়তাকার বস্তুটি সামান্তরিক বস্তুতে পরিবর্তিত হবে (চিত্র) বা আমরা বলতে পারি ব্লকটির উলম্ব তল \theta কোণে মোচড় খেয়েছে । নিচের স্থির তলের অভিলম্ব C D এই যে \theta কোণে (রেডিয়ান এককে) ঘুরে গেল, এই কোণকে বলা হয় আকার বা ব্যবৰ্তন বা মোচড় বিকৃতি । এই কোণটিকে ব্যবৰ্তন কোণও বলে ।
সংজ্ঞা : একক দূরত্বে অবস্থিত দুই তলের মধ্যবর্তী আপেক্ষিক সরণকে ব্যবৰ্তন বা মোচড় বিকৃতি বলে ।
ব্যাখ্যা: বল প্রয়োগের ফলে কোনো আয়তাকার বস্তুর নিচের তলের সাপেক্ষে C D দূরত্বে অবস্থিত উপরের তলের আপেক্ষিক সরণ C C^{\prime} হলে,
মোড় বিকৃতি =\frac{C C^{\prime}}{C D}
কিন্তু \frac{C C r}{C D}=\tan \theta
ব্যবৰ্তন কোণ \theta খুব ছোট হওয়ায় ব্যবর্তন বিকৃতি \theta (রেডিয়ান) =\tan \theta=\frac{C C^{\prime}}{C D}
ব্যবৰ্তন পীড়ন (Shearing Stress) : ব্যবৰ্তন বিকৃতি প্রতিরোধ করার জন্য একক ক্ষেত্রফলে যে প্রতিরোধ বলের সৃষ্টি হয় অর্থাৎ ব্যবৰ্তন বিকৃতি ঘটাতে একক ক্ষেত্রফলের উপর যে স্পর্শকীয় বল প্রযুক্ত হয় তাকে ব্যবৰ্তন পীড়ন বলে ।
ব্যাখ্যা : ব্যবৰ্তন বিকৃতি ঘটাতে যদি A ক্ষেত্রফলের উপর স্পর্শকীয় F বল লম্বভাবে প্রযুক্ত হয় তাহলে ব্যবৰ্তন পীড়ন =\mathrm{FA}
হুকের সূত্র (Hooke’s Law)
রবার্ট হুক পরীক্ষার সাহায্যে দেখান যে, স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে কোনো বস্তুর বিকৃতি প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক । পরীক্ষালব্ধ এ ফলকে রবার্ট হুক সূত্রের আকারে উপস্থাপিত করেন ।
বিবৃতি : স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর পীড়ন এর বিকৃতির সমানুপাতিক ।
অর্থাৎ পীড়ন \propto বিকৃতি ।
বা, পীড়ন = ধ্রুবক \times বিকৃতি
\text { বা, } \frac{\text { পীড়ন }}{\text { বিকৃতি }}=\text { ধ্রুবক }এ ধ্রুবকের মান বস্তুর উপাদান এবং এককের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে । একে বস্তুর উপাদানের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক বা মানাঙ্ক (modulus of elasticity) বা স্থিতিস্থাপক ধ্রুবক (elastic constant) বলে ।
ব্যাখ্যা : কোনো বস্তুতে বল প্রয়োগ করলে তার বিকৃতি ঘটে । বল স্থিতিস্থাপক সীমা অতিক্রম না করলে হুকের সূত্রানুসারে কোনো বস্তুর বিকৃতি যত বেশি হবে, পীড়নও তত বেশি হবে । অর্থাৎ বিকৃতি প্রতিরোধকারী বলের মানও তত বেশি হবে । যেহেতু পীড়ন একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে প্রযুক্ত বল দ্বারা পরিমাপ করা হয় । সুতরাং বলা যায়, একক ক্ষেত্রফলের উপর প্রযুক্ত বল যত বেশি হবে বস্তুটি তত বেশি বিকৃত হবে অর্থাৎ তার দৈর্ঘ্য, আয়তন বা আকার তত বেশি পরিবর্তিত হবে । একক ক্ষেত্রফলে প্রযুক্ত বল দ্বিগুণ করলে বিকৃতি দ্বিগুণ হবে, একক ক্ষেত্রফলে প্রযুক্ত বল তিনগুণ করলে বিকৃতিও তিনগুণ হবে ।
পীড়ন-বিকৃতি লেখচিত্র (Stress-Strain Curve)
একটি তারের একপ্রান্ত একটি দৃঢ় অবলম্বনে আটকে অপর প্রান্তে কিছু ওজন ঝুলিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, ওজনের পরিমাণ বাড়ালে তারের দৈর্ঘ্যও বেড়ে যায় । বস্তর একক ক্ষেত্রফলের উপর ক্রিয়াশীল বল হচ্ছে পীড়ন । বলের ক্রিয়ায় বস্তুর একক মাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে বিকৃতি । এখন পীড়ন ও বিকৃতির লেখচিত্র অঙ্কন করলে চিত্রের মতো একটি রেখা পাওয়া যাবে ।
লেখচিত্রটি O থেকে P বিন্দু পর্যন্ত একটি সরলরেখা, অর্থাৎ P বিন্দু পর্যন্ত তারের পীড়ন বিকৃতির সমানুপাতিক অর্থাৎ তারটি হুকের সূত্র মেনে চলে । ঐ বিন্দুদ্বয়ের মধ্যে যেকোনো অবস্থান থেকে ভার সরিয়ে নিলে বস্তুটি তার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে । সুতরাং, ঐ বিন্দুদ্বয়ের মধ্যে বস্তু পূর্ণ স্থিতিস্থাপকরূপে আচরণ করে এবং P বিন্দু বস্তুর স্থিতিস্থাপক সীমা নির্দেশ করে ।
স্থিতিস্থাপক সীমা অতিক্রম করে ভার চাপালে দেখা যাবে লেখ নিচের দিকে বাঁক নিচ্ছে । এ সময়ে যেকোনো মুহূর্তে (চিত্রে Q বিন্দু) ভার অপসারণ করে নিলেও তারটি আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না । তখন ভার-সম্প্রসারণ চিত্রে QT হয় । অর্থাৎ তারে একটি স্থায়ী বিকৃতি OT থেকে যায় । ভার আরো বৃদ্ধি করলে ভার-সম্প্রসারণ লেখ অনিয়মিতভাবে ওঠা-নামা করে এবং তারের কোনো কোনো জায়গা সরু হয়ে পড়ে । R পর্যন্ত এরকম চলে ।
R বিন্দুকে নতি বিন্দু (yield point) বলে । এরপর ভার আরো বাড়ালে তারের বিভিন্ন জায়গা আরো সরু হতে থাকে এবং কোনো এক জায়গা থেকে তার ছিঁড়ে যায় (চিত্রে S বিন্দু) । S বিন্দুকে সহন সীমা বলে । প্রতি একক ক্ষেত্রফলে ন্যূনতম যে বল লম্বভাবে প্রযুক্ত হলে তারটি ছিঁড়ে যায় তাকে ঐ তারের অসহ পীড়ন বলে । কোনো তারের অসহ পীড়নকে তারের প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল দিয়ে গুণ করলে অসহ ভার বা অসহ বল পাওয়া যায় ।
স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue) : কোনো তারের উপর ক্রমাগত পীড়নের হ্রাস-বৃদ্ধি করলে বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায় । এর ফলে বল অপসারণের সাথে সাথে বস্তু আগের অবস্থা ফিরে পায় না কিছুটা দেরি হয় । বস্তুর এই অবস্থাকে স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (elastic fatigue) বলে । তখন অসহ ভারের চেয়ে কম ভারে এমনকি স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যেই তারটি ছিঁড়ে যেতে পারে ।