পৃষ্ঠটান, পৃষ্ঠটানের আণবিক তত্ত্ব
পৃষ্ঠটান (Surface Tension)
সংজ্ঞা : কোনো তরল পৃষ্ঠের উপর যদি একটি রেখা কল্পনা করা হয় তবে ঐ রেখার প্রতি একক দৈর্ঘ্যে রেখার সাথে লম্বভাবে এবং পৃষ্ঠের স্পর্শকরূপে রেখার উভয় পাশে যে বল ক্রিয়া করে তাকে ঐ তরলের পৃষ্ঠটান বলে ।
ব্যাখ্যা : কোনো তরলের পৃষ্ঠের উপর l দৈর্ঘ্যের AB রেখার সাথে লম্বভাবে এবং পৃষ্ঠের স্পর্শকরূপে রেখার উভয় পাশে F বল ক্রিয়া করলে পৃষ্ঠটান T হবে,
T=\frac{F]{l}মাত্রা ও একক : পৃষ্ঠটানের মাত্রা হচ্ছে \frac{\text { বল }}{\text { দৈর্ঘ্য }} এর মাত্রা অর্থাৎ M T^{-2} এবং একক হচ্ছে Nm বা, N m^{-1} ।
তাৎপর্য : পানির পৃষ্ঠটান 72×10{-3} Nm^{-1} বলতে বোঝায় পানির পৃষ্ঠে 1 m দীর্ঘ একটি রেখা কল্পনা করলে ঐ রেখার সাথে লম্বভাবে এবং পৃষ্ঠের স্পর্শকরূপে রেখার উভয় পাশে 72 \times 10^{-3} \mathrm{~N} বল ক্রিয়া করে ।
পৃষ্ঠটানের আণবিক তত্ত্ব (Molecular Theory of Surface Tension)
আন্তঃআণবিক বল দু’রকম :
(১) সংসক্তি বল (cohesive force) ও
(২) আসঞ্জন বল (adhesive force)
১। সংসক্তি বল (cohesive force) : একই পদার্থের বিভিন্ন অণুর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বলকে সংসক্তি বল বলা হয় । কাছাকাছি অবস্থিত অণুসমূহের আকর্ষণ বল বেশি এবং দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে এ আকর্ষণ বল কমতে থাকে ।
২। আসঞ্জন বল (adhesive force) : বিভিন্ন পদার্থের অণুর ভেতর পারস্পরিক আকর্ষণ বলকে আসঞ্জন বল বলা হয় ।
একটি কাচের গ্লাসে যদি কিছু পানি নেওয়া হয়, তাহলে পানির দুটি অণুর মধ্যে বা কাচের দুটি অণুর মধ্যে যে আকর্ষণ বল সেটি হচ্ছে সংসক্তি বল । আর একটি পানির অণু এবং একটি কাচের অণুর মধ্যবর্তী আকর্ষণ বল হচ্ছে আসঞ্জন বল ।
দুটি অণুর মধ্যে সংসক্তি বল সর্বোচ্চ যে দূরত্ব পর্যন্ত অনুভূত হয় বা সক্রিয় থাকে তাকে আণবিক আকর্ষণের পাল্লা বলে । আণবিক আকর্ষণের পাল্লা প্রায় 10^{-10} m । কোনো অণুকে কেন্দ্র করে এর আণবিক আকর্ষণের পাল্লার সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে কোনো গোলক কল্পনা করলে ঐ গোলককে ঐ অণর প্রভাব গোলক বা পাল্লা গোলক বলে । কেন্দ্রের অণুটি এর প্রভাব গোলকের মধ্যস্হ অণুগুলো দ্বারাই প্রভাবিত হয়, প্রভাব গোলকের বাইরের কোনো অণু দ্বারা প্রভাবিত হয় না, এর অর্থ হলো যে, প্রভাব গোলকের বাইরের কোনো অণুর সাথে এই অণুর সংসক্তি বল নেই বললেই চলে ।
মনে করা যাক, চিত্রে A, B, C কোনো তরলের তিনটি অণু । A অণুটি রয়েছে তরলের গভীরে, তাই এর গোলকটি তরলের ভেতরে রয়েছে । এ অণুটির প্রভাব গোলকের ভেতরকার সকল অণু দ্বারা চতুর্দিকে সমানভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে । সুতরাং এর উপর সংসক্তি বলের লব্ধি শূন্য । অর্থাৎ এর উপর মোট কোনো সংসক্তি বল ক্রিয়া করছে না । তাই এ অণুটি যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে ।
B অণুটি তরলের এমন জায়গায় রয়েছে যে, এর প্রভাব গোলকের কিছুটা অংশ তরলের বাইরে রয়েছে । এ প্রভাব গোলকের উপরের অংশে তরলের যত সংখ্যক অণু থাকবে নিচের অংশে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক অণু থাকবে । এর ফলে B এর উপর ক্রিয়াশীল নিম্নমুখী সংসক্তি বল উর্ধ্বমুখী সংসক্তি বলের চেয়ে বেশি হবে । ফলে B অণুটি একটি নিম্নমুখী লব্ধি বল অনুভব করবে ।
C অণুটি তরল পদার্থের মুক্ত তলে অবস্থিত । এর প্রভাব গোলকের উপরের অর্ধাংশ তরলের বাইরে এবং নিচের অর্ধাংশ তরলের ভেতর রয়েছে । সুতরাং উপরের অংশে ক্রিয়াশীল কোনো সংসক্তি বল নেই, শুধু অণুটির উপর নিম্নমুখী সংসক্তি বল ক্রিয়াশীল । কাজেই এ ক্ষেত্রে C অণুটি সর্বাধিক নিম্নমুখী বল দ্বারা আকর্ষিত হবে । সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত অণু তিনটির মধ্যে C অণুরই নিচের দিকে যাওয়ার প্রবণতা হবে সবচেয়ে বেশি ।
এবার তরলের মুক্ত তল PQ থেকে আণবিক পাল্লার সমান দূরত্বে যদি একটি সমান্তরাল তল RS কল্পনা করা হয়, তবে PQ এবং RS এর ভেতর অবস্থিত সকল অণু সংসক্তি বলের দরুন নিম্নমুখী টান অনুভব করবে । এ নিম্নমুখী টানের মান RS তল থেকে যতই উপরের মুক্ত তলের দিকে যাওয়া যাবে, ততই বাড়তে থাকবে এবং মুক্ত তলে এর মান হবে সর্বাধিক ।
এখন কোনো অণুকে তরলের ভেতর থেকে RS তলের উপরে আনতে নিম্নমুখী সংসক্তি বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে এবং এই কাজ অণুটির বিভব শক্তি বৃদ্ধি করবে । সুতরাং RS তলের নিচে অবস্থিত অণুগুলোর তুলনায় উপরের অণুগুলোর বিভব শক্তি বেশি । কিন্তু আমরা জানি, সকল বস্তুই সর্বনিম্ন বিভব শক্তিতে আসতে চায় । এখন RS তল থেকে মুক্ত তল PQ পর্যন্ত যতগুলো অণু আছে, তাদের বিভব শক্তি সর্বনিম্ন করতে হলে মুক্ত পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল হ্রাস করতে হবে । কাজেই তরলের মুক্ত পৃষ্ঠ সর্বদা তার ক্ষেত্রফল হ্রাস করতে চেষ্টা করে এবং সঙ্কুচিত হতে চায়, ফলে মুক্ত পৃষ্ঠটি একটি টান টান স্থিতিস্থাপক পর্দার ন্যায় আচরণ করে এবং টান অবস্থায় থাকে । এ টান তরলের পৃষ্ঠের স্পর্শক বরাবর ক্রিয়া করে। তরল পৃষ্ঠে একটি রেখা কল্পনা করলে এ টান ঐ রেখার সাথে লম্ব হয় । রেখার প্রতি একক দৈর্ঘ্যে উদ্ভূত এ টানই পৃষ্ঠটান ।