10 Minute School
Log in

সান্দ্রতা, ঘর্ষণ ও সান্দ্রতা, সান্দ্রতা সহগ বা সান্দ্রতাঙ্ক বা সান্দ্রতা গুণাঙ্ক

সান্দ্রতা (Viscosity) 

যে সকল পদার্থ প্রবাহিত হয় তাদের প্রবাহী পদার্থ বলে । কোনো প্রবাহী প্রবাহিত হওয়ার ক্ষেত্রে কেমন বাধাগ্রস্ত বা রোধী (resistive) তার পরিমাপই হলো ঐ পদার্থের সান্দ্রতা । প্রবাহিত হওয়ার ক্ষেত্রে মধু পানির চেয়ে বেশি রোধী তাই মধু পানির তুলনায় অধিক সান্দ্র । প্রবাহীর সান্দ্রতা দুটি কঠিন পদার্থের মধ্যবর্তী ঘর্ষণের সদৃশ । প্রবাহীর নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই । কারণ তাদের আন্তঃআণবিক বল খুবই নগণ্য । কোনো অনুভূমিক তলের উপর দিয়ে প্রবাহিত কোনো প্রবাহীকে কতগুলো স্তরে স্তরে বিভক্ত বলে কল্পনা করলে তল সংলগ্ন স্তরটি তলের সাপেক্ষে স্থির থাকে বাকি স্তরগুলো থাকে গতিশীল । তল থেকে যে স্তরের দূরত্ব যত বেশি সে স্তরের আপেক্ষিক বেগ তত বেশি । 

প্রবাহের সময় প্রবাহীর একটি স্তর এর সন্নিহিত স্তরের সাথে ঘর্ষণের সৃষ্টি করে এবং ঐ স্তরের আপেক্ষিক গতিকে বাধা দেয় । তাতে বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন বেগে প্রবাহিত হয় । প্রবাহীর এ বিভিন্ন স্তরের ঘর্ষণকেই সান্দ্রতা বলা হয় ।

সংজ্ঞা : যে ধর্মের দরুন কোনো প্রবাহীর বিভিন্ন স্তরের আপেক্ষিক গতিতে বাধার সৃষ্টি হয় তাকে ঐ প্রবাহীর সান্দ্রতা বলে ।  

ঘর্ষণ ও সান্দ্রতা (Friction and Viscosity) 

ঘর্ষণ যেমন দুটি কঠিন পদার্থের আপেক্ষিক গতিকে বাধা দেয়, সান্দ্রতা তেমনি প্রবাহীর দুটি স্তরের আপেক্ষিক গতিতে বাধা দেয় এবং গতি ব্যাহত করতে চেষ্টা করে । সান্দ্রতাকে তাই অন্তস্থ ঘর্ষণও বলা হয় । স্থির প্রবাহীর বেলায় সান্দ্রতা বল ক্রিয়া করে না, প্রবাহী গতিশীল হলেই সান্দ্রতা বল ক্রিয়া করে । ঘর্ষণ বল ও সান্দ্রতা বলের মধ্যে পার্থক্য হলো ঘর্ষণ বলের মান স্পর্শতলের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভর করে না, সান্দ্রতা বলের মান প্রবাহীর স্তরদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভর করে । এ ছাড়াও, সান্দ্রতা বল প্রবাহীর স্তরদ্বয়ের বেগ ও স্থির তল থেকে এর দূরত্বের উপর নির্ভর করে । বিভিন্ন তরলের সান্দ্রতা বিভিন্ন রকম । তেল, দুধ ও আলকাতরার মধ্যে আলকাতরার সান্দ্রতা সবচেয়ে বেশি । পানির তুলনায় মধুর সান্দ্রতা বেশি । 

সান্দ্রতা সহগ বা সান্দ্রতাঙ্ক বা সান্দ্রতা গুণাঙ্ক (Co-efficient of Viscosity) 

প্রবাহী পদার্থের পাশাপাশি সমান্তরাল দুটি স্তরের আপেক্ষিক গতির দরুন সৃষ্ট ঘর্ষণ বলের জন্য সান্দ্র প্রভাব দেখা দেয় । যে ধর্মের ফলে প্রবাহী এর বিভিন্ন স্তরের আপেক্ষিক গতিকে বাধা দেয় তাকে ঐ প্রবাহীর সান্দ্রতা বলে ।

স্তরায়িত প্রবাহে রয়েছে এমন একটি প্রবাহী বিবেচনা করা যাক । এই প্রবাহী পদার্থের এমন দুটি সমান্তরাল স্তর বিবেচনা করা যাক, যাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রফল A এবং এরা পরস্পর থেকে dy দূরত্বে রয়েছে । এই স্তর দুটির বেগ যথাক্রমে v এবং v+d v । তাহলে দূরত্বের সাপেক্ষে বেগের অন্তরক হলো \frac{d v}{d y} । একে বেগের নতি (velocity gradient) বলে ।

Viscosity

প্ৰবাহী স্তর দুটির মধ্যে বেগের পার্থক্য থাকায় প্রবাহীর সান্দ্রতার জন্য তাদের মধ্যে প্রবাহের বিপরীত দিকে একটি বল ক্রিয়া করে । এ বলের মান সম্পর্কে নিউটন একটি সূত্র দিয়েছেন । এটি সান্দ্রতা সংক্রান্ত নিউটনের সূত্র নামে পরিচিত ।

নিউটনের সূত্র (Newton’s Law) : প্রবাহীর দুটি স্তরের মধ্যে আপেক্ষিক বেগ থাকলে প্রবাহের বিপরীত দিকে যে স্পর্শকীয় সান্দ্র বল ক্রিয়া করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তার মান (F) প্রবাহীর স্তরদ্বয়ের ক্ষেত্রফল (A) এবং তাদের মধ্যকার বেগের নতি \left(\frac{d v}{d y}\right) এর সমানুপাতিক ।

অর্থাৎ F \propto A\left(\frac{d v}{d y}\right)

বা, F=\eta A(\frac{d v}{d y})  … … … … (7.19)  

(7.19) এখানে হলো একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক । এর মান প্রবাহীর প্রকৃতি এবং তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে । একে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় প্রবাহীর সান্দ্রতা গুণাঙ্ক বা সান্দ্রতা সহগ বলা হয় । 

সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে, A=1 একক এবং (\frac{d v}{d y})=1 একক হলে

F=\eta \times 1 \times 1

অর্থাৎ \eta=F হয় ।

সংজ্ঞা : নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় প্রবাহীর দুটি স্তরের মধ্যে বেগের নতি একক রাখতে (অর্থাৎ একক দূরত্বে অবস্থিত দুটি স্তরের মধ্যে একক আপেক্ষিক বেগ বজায় রাখতে) প্রবাহী স্তরের প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যে স্পর্শকীয় বলের প্রয়োজন হয় তাকে ঐ তাপমাত্রায় ঐ প্রবাহীর সান্দ্রতা গুণাঙ্ক বা সান্দ্রতা সহগ বলে । 

সান্দ্রতা সহগ প্রবাহীর সান্দ্রতার পরিমাপ বিশেষ । কোনো প্রবাহীর সান্দ্রতা সহগ বলতে প্রবাহীটি যে সান্দ্র প্রভাব প্রদান করে তার পরিমাপকে বোঝায় । সান্দ্রতা সহগ যত বেশি প্রবাহীটি তত সান্দ্র । কক্ষ তাপমাত্রায় গ্লিসারিনের সান্দ্রতা সহগ পানির চেয়ে 10^3 গুণ বেশি । নিউটনের সূত্র সকল গ্যাসের জন্য এবং অনেক তরলের জন্য খাটে । যে সব তরলের জন্য এই সূত্র খাটে তাদের বলা হয় নিউটনীয় তরল । পানি একটি নিউটনীয় তরল । অ-নিউটনীয় তরলের জন্য এর কোনো ধ্রুব মান নেই । প্রকৃতপক্ষে, এসব তরলের সান্দ্রতা সহগ নেই । এরকম একটি তরল হলো তেল রং (oil paint) ।  

এর মাত্রা ও একক 

(7.19) সমীকরণ থেকে দেখা যায়,

\eta=\frac{F}{A \frac{d v}{d y}} \text { বা, } \eta=\frac{\text { বল }}{\text { ক্ষেত্রফল } \times \text { বেগ }\times \text { দূরত্ব }}

সুতরাং এর মাত্রা হবে উপরিউক্ত সমীকরণের ডানপাশের রাশিগুলোর মাত্রা অর্থাৎ 

[\eta]=\frac{M L T^{-2}}{L^{2} \frac{L T^{-1}}{L}}

(7.19) সমীকরণ থেকে পুনরায় পাওয়া যায়,

\eta=\frac{F}{A \frac{d v}{d y}}

এই সমীকরণের ডানপাশের রাশিগুলোর একক বসালে এর এস আই একক পাওয়া যায় । এ একক হলো

\frac{N}{m^{2} \frac{m s^{-1}}{m}}

অর্থাৎ N s m^{-2}  বা, Pa s

বিজ্ঞানী পয়সুলীর নামানুসারে সান্দ্রতাঙ্কের আর একটি একক হচ্ছে পয়েস (poise)  1 \mathrm{N} \mathrm{s} \mathrm{m}^{-2}= 10 poise

তাৎপর্য : পানির সান্দ্রতা সহগ 10^{-3} \mathrm{N} \mathrm{s} \mathrm{m}^{-2} বলতে বোঝায় 1\mathrm{~m}^{2} ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট পানির দুটি স্তর পরস্পর থেকে 1 m দূরত্বে অবস্থিত হলে এদের ভেতর 1\mathrm{~m} \mathrm{~s}^{-1} আপেক্ষিক বেগ বজায় রাখতে 10^{-3} \mathrm{~N} বলের প্রয়োজন হয় ।

সান্দ্রতার উপর তাপমাত্রার প্রভাব (Effect of Temperature on Viscosity)

(ক) তরলের সান্দ্রতা (Viscosity of Liquid) : বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে তরলের সান্দ্রতার উপর তাপমাত্রার প্রভাব পাওয়া যায় । দেখা গেছে যে, 10℃ তাপমাত্রায় পানির সান্দ্রতা সহগের যে মান পাওয়া যায়, 80°C তাপমাত্রায় সে মান হয় এক-তৃতীয়াংশ । কিন্তু তরলের সান্দ্রতা সহগের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্কে কোনো সঠিক সূত্র পাওয়া যায়নি । বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন সূত্র দিয়েছেন । 

তাপমাত্রার সাথে সান্দ্রতা সহগের সম্পর্কসূচক একটি সমীকরণ হলো :

\log \eta=A+\frac{B}{T}

এখানে হলো তরলের সান্দ্রতা সহগ, T তরলের কেলভিন তাপমাত্রা এবং AB ধ্রুবক ।

(খ) গ্যাসের সান্দ্রতা (Viscosity of Gas) : তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্যাসের সান্দ্রতা বৃদ্ধি পায় । গ্যাসের সান্দ্রতা সহগ তার কেলভিন তাপমাত্রার বর্গমূলের সমানুপাতিক । 

\therefore \eta \propto \sqrt{T}

তাপমাত্রা বৃদ্ধি : তরল গ্যাসের সান্দ্রতা হ্রাস বৃদ্ধির বৈপরীত্য (Increase in Temperature: Decrease in Viscosity of Liquid Gas as Opposed to Increase)

তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে তরলের সান্দ্রতা হ্রাস পায় । 10℃ তাপমাত্রায় পানির যে সান্দ্রতা 80℃ তাপমাত্রায় তা কমে এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়; কিন্তু অপরদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে গ্যাসের সান্দ্রতা বৃদ্ধি পায় । কেন এই বৈপরীত্য ?

আমরা জানি যে, তরল ও গ্যাস উভয়ই অণু দিয়ে গড়া । আণবিক তত্ত্ব থেকে আমরা তাই তরল ও গ্যাসের সান্দ্রতা বৃদ্ধি ও হ্রাসের বৈপরীত্য ব্যাখ্যা করতে পারি ।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তরলের অণুগুলো তাপ থেকে শক্তি গ্রহণ করে বেশি শক্তি পায় এবং এদের গতি বেড়ে যায় । এতে অণুগুলোর গড় মুক্ত পথ বৃদ্ধি পায় ফলে এদের মধ্যে ঘর্ষণ কম হয় । গড় মুক্ত পথ বৃদ্ধির ফলে তরলের স্তরের আপেক্ষিক বাধা কমে যায় । ফলে তরলের সান্দ্রতা হ্রাস পায় ।

অপরদিকে গ্যাসের অণুগুলো থাকে তরলের তুলনায় অনেক আলগাভাবে বাঁধা । এরা সব সময় এলোমেলো গতিতে থাকে । তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এদের ইতস্তত গতি অত্যন্ত বেড়ে যায় । ধীর গতির স্তরের কিছু অণু দ্রুত গতির স্তরে যায় । ফলে দ্রুতগতি স্তরের অণুগুলোর গড় দ্রুতি হ্রাস পায় ।  আবার এই ইতস্তত গতির ফলে দ্রুত গতি স্তরের কিছু অণু ধীর গতির স্তরে চলে যায় । এতে ধীর গতি স্তরের অণুগুলোর গড় দ্রুতি বৃদ্ধি পায় । এর ফলে দুই স্তরের মধ্যকার আপেক্ষিক গতি হ্রাস পায় তথা সান্দ্রতা বৃদ্ধি পায় ।

সান্দ্রতার উপর চাপের প্রভাব (Effect of Pressure on Viscosity)

(ক) তরলের সান্দ্রতা (Viscosity of Liquid) : চাপ বৃদ্ধির সাথে তরলের সান্দ্রতা বৃদ্ধি পায় । খনিজ তেলের ক্ষেত্রে সান্দ্রতার উপর চাপের প্রভাব খুবই লক্ষ্যণীয় ।

(খ) গ্যাসের সান্দ্রতা (Viscosity of Gas) : বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল গ্যাসের গতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বলেন যে, গ্যাসের সান্দ্রতার উপর চাপের কোনো প্রভাব নেই এবং একথা চাপের বিস্তৃত পাল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । তবে নিম্নচাপের ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় ।