আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল,সাক্ষী
পুবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের ডালে স্থির দৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশি পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই। আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই। এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে তারা জানে আমি কোনো আত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির-সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি,আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন।আমি
জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে। হাত রাখো বৈঠায় লাঙলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর।দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস। আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই। দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা।আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।
◈ জন্ম- ১৯১৭ সালের ২রা জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
◈ বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে আই এ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।
◈ পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক।
◈ গভীর জীবনবোধ ও আশাবাদ তাঁর কবিতাকে এক বিশেষ ব্যঞ্জনা দান করেছে।
◈ তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্তমানবতার সপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন।
◈ সাহিত্যকর্মের জন্য বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক পুরস্কার লাভ করেন।
◈ প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ।
◈ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, আশায় বসতি, সারা দুপুর, ছায়াহরিণ।
◈ ছোটদের জন্য তাঁর কবিতার বই- জোছনা রাতের গল্প, ছুটির দিন দুপুরে।
◈ কিশোরপাঠ্য উপন্যাস- রানী খালের সাঁকো।
◈ মৃত্যু- ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালে ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রাতের আকাশে তারা ফুটে, নিচে বাঁশবাগান। সেই নিঝুম বাঁশবাগানে অসংখ্য জোনাকি আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়ায়। জারুল, জামরুল গাছগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে এমনভাবে, দেখলে মনে হয় তারা যেন ঘুমাচ্ছে। এসবের সঙ্গে কবির পরিচয় আছে, তেমনি তারাও তাঁকে চেনে। তাই, তারা কবির চিরচেনা সাক্ষী।
কবি যে দেশে জন্মেছেন, সে দেশটি স্বপ্নময়। সেদেশের গ্রাম, গ্রাম্য প্রকৃতি ও জীবন প্রায় একই ধরনের স্বপ্নের স্পর্শ মাখা। কবিও সেই স্বপ্নময়তাকে ধারণ করেই বেড়ে উঠেছেন।
কবি বাইরের কোনো আত্মীয় নন, সবাই তাকে চেনে এবং জানে।
গ্রামের এক ধরনের গাছের নাম নিশিন্দা। জ্যোৎস্নার চাদরে অর্থাৎ জ্যোৎস্নার আলোয় সেই নিশিন্দা গাছের ছায়ার কথা এখানে কবি উল্লেখ করেছেন এবং বলছেন যে এই নিশিন্দা গাছের ছায়াও সাক্ষী।
এদেশের গ্রামে দারিদ্র্য আর অভাব যেন খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। রোগে-শোকে জরাজীর্ণ মানুষ আছে, যারা কদম আলীর মতো অকাল বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে। তারা ক্ষুধায় ক্লান্ত, তাদের চোখে নেমে এসেছে আঁধার। তাদের সঙ্গে কবির নিত্য ওঠাবসা। কবি খুব কাছের মানুষ তাদের। তাই খুব ভালো করে তাদের কবি চিনেন।
কবির স্বদেশের গ্রামের দু’পাশে সবুজ বিস্তীর্ণ ধানের খেত। ঝিকিমিকি নদী, নদীর কিনারে ধু-ধু বালুচর, সরু আলপথ- সবকিছুই তাঁর চিরচেনা, অস্তিত্বের সঙ্গে গাঁথা। এ অপরূপ প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে তিনি মুগ্ধ। এত সুন্দর সব কিছুই যেন কবির অস্তিত্বের সঙ্গে একেবারে মিশে আছে।
কবি জোর দিয়ে তার কথাকে বিশ্বাস করতে বলছেন এবং বোঝাতে চাচ্ছেন তিনি কোন অতিথি নন কিংবা অপরিচিত কেউ নন।
এদেশের স্নিগ্ধ মাটিতে কবি জন্ম নিয়েছেন। তিনি যে এই মাটিরই অংশ তাঁর সাক্ষ্য দিবে এই বাংলার প্রকৃতি। কবির জন্য সাক্ষ্য দিবে মাথার উপরের আকাশ, আকাশের তারা। আর সাক্ষ্য দিবে এদেশের মাটিতে জন্মানো ফুল।
কবি এই বাংলার প্রকৃতির সন্তান। তাঁর এই দাবির সাক্ষী স্বরূপ রয়েছে কবির চিরচেনা পুবের পুকুর। পুকুর পাড়ের ডুমুর গাছের ডালে স্থির দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকা কোন এক মাছরাঙাও কবির জন্য সাক্ষ্য দিবে ।
মাতৃভূমির সাথে কবির সম্পর্ক আজীবনের। কেননা এই বাংলা মাতৃভূমিতেই তিনি জন্ম নিয়েছেন। প্রকৃতির উপাদানকে তিনি যেমন পরম মমতায় নিজের অন্তরে লালন করেছেন, ঠিক তেমনি এই বাংলার প্রকৃতিও কবিকে আপন করে নিয়েছে। কবি ভিনদেশী কোনো পথিক নন কিংবা আগন্তুকও নন, এই বাংলারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন কবি যার সাক্ষীস্বরূপ রয়েছে এই বাংলার আকাশ, ফুল, বাঁশবাগান সহ আর অনেক অপার্থিব প্রাকৃতিক উপাদান।
সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে কবি এই বাংলার মাটিতে অবস্থান করছেন। এই বাংলার অংশ হয়ে তিনি মাতৃভূমির প্রতিটি উপাদানে বিরাজ করছেন। জন্মভূমির প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানে তাঁর উপস্থিতি স্পষ্ট।
ঋতুবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলার এক অপার্থিব চিত্র কবি এই চরণে অঙ্কন করেছেন। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার বৃষ্টি কিংবা শরতের মেঘমালা- এই সবই এই বাংলার প্রকৃতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। ঘরে ফিরে যাওয়া ক্লান্ত পাখির ঝাঁকও কবিকে পরম মমতায় নিজেদের মাঝে ধারণ করছে। কবি তাদের পরম আপনজন।
কার্তিক মাসে মাঠের ফসলে নতুন শিষের আগমন হয়। সেই নতুন ধানের শিষও কবির অবস্থানের সাক্ষী দেয়। ধানের শিষে জমে থাকা ক্ষণস্থায়ী শিশিরও কবির অবস্থানের সাক্ষ্য দেবে।
কেবল মাত্র প্রকৃতির উপাদান নয়, কবি তার সমসাময়িক মানুষজনদের মাঝেও নিজের অবস্থান কে খুঁজে নিয়েছেন। কদম আলীর মত অকাল বার্ধক্যে জর্জরিত মানুষদের পরম আত্মীয় তিনি।
কবি গ্রাম বাংলার দারিদ্র্যপীড়িত মানুষজনদের মাঝেও নিজের অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। জমিলার মায়ের মত দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষজনদের পরম আপন তিনি। তাদের মধ্য দিয়েই তিনি এই বাংলার সর্বত্র বিরাজ করেন।
এদেশের স্নিগ্ধ সুবাসিত মাটির গন্ধকে কবি নিজের দেহে পরম যত্নে ধারণ করেছেন কেননা এই মাটিরই ভূমিজাত সন্তান তিনি, মাটির মাঝেও রয়েছে কবির শরীরের গন্ধ।
কবির মনে এক অপার্থিব অনুভূতি জাগে- যে লাঙল দিয়ে কৃষক মাটির বুক চিড়ে ফসল ফলায়, যে বৈঠা দিয়ে মাঝি নৌকা বায়; সেই লাঙল বৈঠায় কবি তাঁর হাতের স্পর্শ খুঁজে পান। লাঙল আর বৈঠাও কবির অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়।
কবি তাঁর এই চরণে অসামান্য এক চিত্রকল্পের রচনা করেছেন। কবি অনুভব করেন, তাঁর দুপাশে সরু পথ বিশিষ্ট বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। তার সামনে অবারিত ধু-ধু একটি নদীর চিত্রকল্প। সেই নদীর কোনও অস্তিত্ব নেই। কবি এক অবুঝ বালকের মত সেই অস্তিত্বহীন নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অবলোকন করছেন।
জন্মভূমির সবকিছুই আমাদের কাছে মনে হয় কত চেনা, কত জানা। এই অনুভূতি তুলনাহীন এবং জন্মভূমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আজীবনের। চারপাশের প্রকৃতিকে আপন সত্ত্বায় অনুভব করলে দেশের মানুষকেও আপন মনে হয় আমাদের। এই কবিতায় সেই অনুভবই আন্তরিকভাবে তুলে ধরেছেন কবি আহসান হাবীব। তিনি বলছেন, তিনি কোনো আগন্তুক নন। তিনি যেমন ঐ আসমান, জমিনের ফুল, জোনাকি, পুকুর, মাছরাঙাকে চেনেন, তেমনি তারাও তাঁকে চেনে। শুধু প্রকৃতিই নয়, তিনি এই জনপদের মানুষদেরও ভালোভাবে চেনেন। কবি অনুভব করেন, যে লাঙল জমিতে ফসল ফলায়, সেই লাঙল আর মাটির গন্ধ লেগে আছে তাঁর হাতে, শরীরে। এই গ্রামীণ জনপদের সঙ্গে তাঁর জীবন বাঁধা এবং এটাই হচ্ছে তাঁর অস্তিত্ব। জন্মভূমির সঙ্গে একজন মানুষ যে গভীরভাবে সম্পর্কিত সে কথাটিই মূলত কবি এখানে বুঝিয়েছেন।