প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর(1st Defense Line): ত্বক, পরিপাকনালির এসিড ও এনজাইমের ভূমিকা
মানবদেহের প্রতিরক্ষায় যে প্রতিরক্ষা স্তর রাসায়নিক ও ভৌত বাহ্যিকতলীয় প্রতিবন্ধক (chemical and physical surface barriers) হিসেবে বহিরাগত যে কোনো অণুজীব বা কণাকে দেহের ভিতরে প্রবেশে বাধা দেয় তাকে প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর(First line of Defense) বলে। ১ম প্রতিরক্ষা স্তরের অন্যতম উপাদান হলো ত্বক,পৌষ্টকনালির অ্যাসিড। মানবদেহের প্রতিরক্ষায় ত্বক,পৌষ্টকনালির অ্যাসিড ও এনজাইমের ভূমিকা দেখানো হলো।
দেহের প্রতিরক্ষায় ত্বকের ভূমিকা (প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর)
(Role of Skin in Defense of the Body)
- ত্বকের বাইরের স্তরটি এপিডার্মিস (epidermis)। এটি একটি হর্ণি স্তর যা মৃত ও চাপা কোষে গঠিত এবং স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম (stratum corneum) নামে পরিচিত। এটি জীবাণুরোধী স্তর এবং ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের প্রবেশে ভৌত প্রতিবন্ধক (physical barrier) হিসেবে কাজ করে। কতকগুলো ভাইরাস ছাড়া এমন কোনো রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নেই যা অক্ষত ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে।
- মানবত্বকে অক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সব সময়ই থাকে, কিন্তু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সেখানে বাঁচতে পারে না। কারণ ত্বকের স্বেদ বা সিবেসাস গ্রন্থি (sebaceous gland) ও ঘাম গ্রন্থি (sweat gland) থেকে যথাক্রমে যে তেল (বা স্বেদ) ও ঘাম ক্ষরিত হয় তা ত্বককে এসিডিক (PH 3.0-5.0) করে তুলে। এমন পরিবেশে জীবাণু বাঁচতে বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। অন্যদিকে, ত্বকে যে সব অক্ষতিকর বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে সেগুলোও যে এসিড ও বিপাকীয় বর্জ্য ত্যাগ করে সে সব পদার্থও ত্বকের উপরে ব্যাকটেরিয়া দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। স্বেদ ও ঘাম গ্রন্থির ক্ষরণেও জীবাণুনাশক (অ্যান্টিবায়োটিক) পদার্থ থাকে (যেমন– ডার্মিসাইডিন নামে পেপটাইড)। এসব পদার্থ থাকায় মানুষের ত্বক আত্ম-রোগজীবাণুনাশক অঙ্গ (self-disinfecting organ) হিসেবে কাজ করে।
- যোনিতে যে ব্যাকটেরিয়া বাস করে তা ল্যাকটিক এসিড ক্ষরণ করে PH মাত্রা কমিয়ে দেয়। কেউ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে এসব ব্যাকটেরিয়া মারা যেতে পারে, ফলে যোনিদেশে PH বেড়ে যায়। এ সুযোগে সেখানে Candida বা অন্যান্য অণুজীবের বংশবৃদ্ধি ঘটে ক্ষতরোগের সৃষ্টি করে।
- দেহের সিক্ত অংশগুলো সবসময় কোনো না কোনো ব্যাকটেরীয় সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। অনেক অংশ আবার ব্যাকটেরিয়ানাশকও বহন করে, যেমন-অশ্রু, নাসিকাঝিল্লি ও লালায় লাইসোজাইম (lysozyme): সিমেনে স্পার্মিন (spermin); দুধে ল্যাক্টোপারঅক্সিডেজ (lactoperoxidase) ইত্যাদি।
- কানের ভিতরে সিরুমিনাস গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত সিরুমেন (cerumen) বা কানের মোম কানের গভীরে ধূলা-বালি, ব্যাকটেরিয়া ও ছোট পোকার প্রবেশ প্রতিরোধ করে। সিরুমিনাস গ্রন্থি কর্ণকুহরে এক ধরনের ত্বকীয় গ্ৰন্থি।
খাদ্যদ্রব্যের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে পরিপাকনালির এসিড ও এনজাইমের ভূমিকা (প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর)
(Role of Digestive Acid and Enzyme in the Destruction of Bacteria in Food)
নাসিকা-গহ্বর, গলবিল ও ট্রাকিয়ার মিউকাস ঝিল্লি যে মিউকাস (mucous) ক্ষরণ করে তাতে লাইপোজাইম (lysozyme) নামে এক ধরনের প্রোটিন থাকে যা ব্যাকটেরিয়ানাশক হিসেবে কাজ করে। ট্রাকিয়ার মিউকোসা শুধু মিউকাসই ক্ষরণ করে না, এর প্রাচীর সিলিয়াময়ও বটে। সিলিয়া থাকায় ধূলা-বালি বা বহিরাগত বস্তু প্রবেশে বাধা পায়, সিলিয়ায় আটকা পড়ে এবং সিলিয়ার বহির্মুখি আন্দোলনে ব্যাকটেরিয়া মিউকাস মিশ্রিত হয়ে গলবিলে এসে পড়ে। গলবিল হয়ে এসব ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলিতে পৌছালে গ্যাস্ট্রিক জুসের HCl-এর ক্রিয়ায় ধ্বংস হয়ে যায়।
খাদ্যদ্রব্যের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে পরিপাকনালির এসিড ও বিভিন্ন এনজাইম নিচে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- লালাগ্রন্থিতে লাইসোজাইম নামে এক ধরনের এনজাইম থাকে। এটি মুখ ও গলায় সংক্রমণকারী Staphylococcus, Streptococcus Bacillus প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়াসহ অনেক ধরনের জীবাণু ধ্বংস করে। ব্যাকটেরিয়ার পলিস্যাকারাইড-নির্মিত কোষপ্রাচীর বিগলিত করে এদের বিনষ্ট করে।
- লাইসোজাইম, লালা এবং লালায় অবস্থিত সামান্য পরিমাণ হাইড্রোজেন কার্বনেট আয়ন (এটি দাঁতে এসিডের উপস্থিতিকে প্রশমিত বা নিষ্ক্রিয় করে) মিলে দাঁত ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। লালারসের অবিরাম ক্ষরণে মুখের ভিতরে বা দাঁতে খাদ্যকণা জমতে পারে না, ফলে ব্যাকটেরিয়াও জন্মাতে পারে না।
- পাকস্থলি প্রাচীরের প্যারাইটাল বা অক্সিনেটিক কোষ-ক্ষরিত গ্যাস্ট্রিক জুসে বিপুল পরিমাণ HCl পাকস্থলির অভ্যন্তরে শক্তিশালী এসিডিক মাধ্যম (PH 1.0-2.0) সৃষ্টি করে। এসিডিক মাধ্যম খাদ্যে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসকে ধ্বংস করে।
- অস্ত্রে বসবাসকারী কয়েক ধরনের মিথোজীবী অণুজীব থেকে ক্ষরিত অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং খাদ্যবাহিত কয়েক ধরনের ভাইরাসের বৃদ্ধি রহিত করে।
- যকৃত থেকে ক্ষরিত পিত্ত (ক্ষারীয় রস PH 8.0) অস্ত্রের ডিওডেনামে অবস্থিত কাইম (chyme)-এ অ্যান্টিবডি উৎপন্নের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে।
- সমগ্র পৌষ্টিকনালির অন্তঃপ্রাচীর মিউকাসে আবৃত থাকে। মিউকাসে অবস্থিত এক ধরনের রাসায়নিক রয়েছে ব্যাকটেরিয়াকে ঘিরে ধরে এবং প্রাচীরগাত্রে আটকে থাকতে বাধা দেয়।