রক্ত ও সঞ্চালন (Blood and Circulation)
রক্ত (Blood)
রক্তরস নামক তরল মাতৃকায় ভাসমান বিভিন্ন ধরনের রক্ত কণিকা নিয়ে গঠিত টিস্যুকে রক্ত বলে।
- একজন পূর্ণবয়স্ক মানবদেহে প্রায় ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে অর্থাৎ দেহের মোট ওজনের প্রায় ৮%।
- রক্ত সামান্য ক্ষারীয়। এর pH মাত্রা ৭.৩৫-৭.৪৫ (গড়ে ৭.৪০) এবং তাপমাত্রা ৩৬-৩৮o সেলসিয়াস।
- রক্তের আপেক্ষিক গুরুত্ব পানির চেয়ে বেশি, প্রায় ১.০৬৫।
- অজৈব লবণের উপস্থিতির জন্য রক্তের স্বাদ নোনতা।
- সুনির্দিষ্ট বাহিকার মাধ্যমে রক্ত দেহের সবখানে সঞ্চালিত হয়।
লোহিত রক্তকণিকা বা এরিথ্রোসাইট (Erythrocyte; গ্রিক)
মানবদেহের রক্তরসে ভাসমান গোল, দ্বিঅবতল চাকতির মত, নিউক্লিয়াসবিহীন কিন্তু অক্সিজেনবাহী হিমোগ্লোবিনযুক্ত, লাল বর্ণের কণিকাকে লোহিত রক্তকণিকা বলে।
এ ধরনের কণিকার গড় ব্যাস ৭.৩μm ও গড় স্থুলতা ২.২μm এবং কিনারা অপেক্ষা মধ্যভাগ অনেক পাতলা।
স্তন্যপায়ী প্রানিদের মধ্যে কেবল উটের লোহিত কণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে- এ তথ্যটি ভুল। উটের এরিথ্রোসাইটও নিউক্লিয়াসবিহীন, তবে কণিকার আকার কিছুটা ভিন্নতর।
বিভিন্ন বয়সের মানবদেহে প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে রক্তকণিকার সংখ্যা হচ্ছে :
- ভ্রূনদেহে ৮০-৯০ লাখ
- শিশুর দেহে ৬০-৭০ লাখ
- পূর্ণবয়ষ্ক পুরুষে ৫০-৫৪ লাখ
- পূর্নবয়ষ্ক স্ত্রীদেহে ৪৪-৪৯ লাখ
বিভিন্ন শারীরিক অবস্থায় এ সংখ্যার তারতম্য ঘটে। যেমন- ব্যায়াম ও গর্ভাবস্থায় কণিকার সংখ্যা বেশি হয়।
- প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা ৫০ লাখের চেয়ে ২৫% কম হলে রক্তাল্পতা (anaemia) দেখা দেয়।
- কোনো কারনে ৬৫ লাখের বেশি হলে তাকে পলিসাইথেমিয়া (polycythemia) বলে।
- লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল ১২০ দিন।
- লাল অস্থিমজ্জার মধ্যে স্টেমকোষ (stem cell) থেকে লোহিত রক্তকণিকা উদ্ভূত হয়। রক্তে অক্সিজেন মাত্রা কমে গেলে নতুন লোহিত কণিকা সৃষ্টি হয়। রক্তপাত, উঁচু স্থানে অবস্থান, ব্যায়াম অস্থিমজ্জার ক্ষতি, কম মাত্রার হিমোগ্লোবিনসহ বিভিন্ন কারনে অক্সিজেন মাত্রা কমে যেতে পারে। বৃক্ক কম অক্সিজেন মাত্রা শনাক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে এরিথ্রোপয়েটিন (erythropoieitin) নামে এক হরমোন উৎপন্ন ও ক্ষরণ করে। এ হরমোন লাল অস্থিমজ্জার মাধ্যমে লোহিত কণিকা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে। বেশি লোহিত রক্তকণিকা রক্তপ্রবাহে যুক্ত হলে রক্ত ও টিস্যুতে অক্সিজেনের মাত্রাও বেড়ে যায়। রক্তে অক্সিজেন মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বৃক্ক এরিথ্রোপয়েটিন ক্ষরণ কমিয়ে দেয়, ফলে লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদনও কমে যায়। এরিথ্রোসাইট সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে এরিথ্রোপয়েসিস (erythropoiesis) বলে।
রাসায়নিকভাবে লোহিত কণিকার ৬০-৭০% পানি এবং ৩০-৪০% কঠিন পদার্থ। কঠিন পদার্থের মধ্যে প্রায় ৯০% হিমোগ্লোবিন। অবশিষ্ট ১০% প্রোটিন, ফসফোলিপিড, কোলেস্টেরল, অজৈব লবণ, অজৈব ফসফেট, পটাশিয়াম ইত্যাদি নিয়ে গঠিত।
প্রতিটি হিমোগ্লোবিন অণূ হিম (heme) নামক লৌহ ধারণকারী রঞ্জক (pigment) এবং গ্লোবিন (globin) নামক প্রোটিন সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি ১০০ মিলিলিটার রক্তে প্রায় ১৬ গ্রাম হিমোগ্লোবিন থাকে।হিমোগ্লোবিনের ৪ টি পলিপেপটাইড চেইনের সাথে একটি হিম গ্রুপ যুক্ত থাকে। হিম গ্রুপের জন্যই রক্ত লাল হয়।
অণুচক্রিকা বা প্লেইটলেট বা থ্রম্বোসাইট (Platelets)
- দেহের লাল অস্থিমজ্জার মেগাক্যারিওসাইট (megakaryocyte) নামে বড় কোষ থেকে উৎপন্ন ও রক্তরসে ভাসমান ১-৪ μmব্যাসসম্পন্ন, অনিয়তাকার, ঝিল্লি-আবৃত, সামান্য সাইটোপ্লাজমযুক্ত নিউক্লিয়াসবিহীন, কোষ-ভগ্নাংশকে (Cell fragments) অণুচক্রিকা বা প্লেইটলেট বলে।
- প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে প্রায় ১,৫০,০০০ – ৩,০০,০০০ অণুচক্রিকা থাকতে পারে।
- প্রতিদিন প্রায় ২০০ বিলিয়ন (২০ হাজার কোটি) অণুচক্রিকা উৎপন্ন হয়।
- রক্তস্রোতে প্রবেশের পর এদের জীবনকাল ৫-৯ দিন।
- যকৃত ও প্লীহার ম্যাক্রোফেজের মাধ্যমে এদের ধ্বংসপ্রাপ্তি ঘটে।
- plug) সৃষ্টির মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করে।
- রক্তজমাট ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন ক্লটিং ফ্যাক্টর (clotting factor) ক্ষরণ করে।
- প্রয়োজন শেষে রক্তজমাট বিগলনে সাহায্য করে।
- ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ধ্বংস করে।
- দেহের কোথাও ব্যথার সৃষ্টি হলে মনোসাইটকে আকৃষ্ট করতে রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরন করে।
- রক্তবাহিকার এন্ডোথেলিয়ামের অন্তঃপ্রাচীর সুরক্ষার জন্য গ্রোথ ফ্যাক্টর ক্ষরণ করে।
- সেরোটোনিন (serotonin) নামক রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে রক্তবাহিকাকে দ্রুত সংকোচনে উদ্বুদ্ধ করে
- স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অণুচক্রিকা থাকলে রক্তনালীর ভিতরে অদরকারি রক্তজমাট সৃষ্টি, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অনুচক্রিকার মধ্যে পার্থক্য (Difference between Erythrocyte, Leucocutes and Platelets)
তুলনীয় বিষয় | লোহিত রক্তকণিকা | শ্বেত রক্তকণিকা | অনুচক্রিকা |
সংখ্যা | ১. প্রতি কিউবিক মিলিমিটার রক্তে প্রায় ৫০ লক্ষ। | ১. শ্বেত কিউবিক মিলিমিটার রক্তে ৫-৮ হাজার। | ১. প্রতি কিউবিক মিলিমিটার রক্তে ০.৫ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ। |
নিউক্লিয়াস | ২. প্রাথমিকভাবে নিউক্লিয়াস থাকলেও হিমোগ্লোবিন সঞ্চিত হবার পর নিউক্লিয়াস বিনষ্ট হয়ে যায়। | ২. সব সময় নিউক্লিয়াস থাকে। | ২. কোনো সময়ই নিউক্লিয়াস থাকে না । |
বর্ণ | ৩. সাইটোপ্লাজমে হিমোগ্লোবিন থাকায় এগুলোকে লাল বর্ণের দেখায়। | ৩. সাইটোপ্লাজমে হিমোগ্লোবিন না থাকায় এগুলো বর্ণহীন। | ৩. বর্ণহীন। |
আয়ুষ্কাল | ৪. ১২০ দিন। | ৪. ২-১৫ দিন | ৪. ৫–৯ দিন। |
আকৃতি | ৫. দ্বি-অবতল, চাকতির মতো। | ৫. গোলাকার বা অনিয়ত। | ৫. অনিয়ত আকৃতির। |
কাজ | ৬. O_{2} পরিবহন। | ৬. রোগ প্রতিরোধ। | ৬. রক্ত তঞ্চন। |
রক্ত জমাট বাধা বা রক্ত তঞ্চন (Blood Clotting)
দেহের কোথাও ক্ষত সৃষ্টির ফলে কোন রক্তবাহিকার রেনডম ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে ও সংক্রমণ প্রতিরোধে যে জটিল জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ফাইব্রিন জালক সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতস্থানে রক্তকে থকথকে পরিণত করে সে প্রক্রিয়াকে রক্তের জমাট বাধা বা রক্ত তঞ্চন বলে
এ প্রক্রিয়ায় অনুচক্রিকা ও রক্তরসে অবস্থিত ১৩ ধরনের ক্লটিং ফ্যাক্টর (clotting factor) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ৪ টি ফ্যাক্টর হলো- (1) ফাইব্রিনোজেন, (2) প্রোথ্রম্বিন, (3) থ্রম্বোপ্লাস্টিন ও (4) C_{a^{2+}} ।
ফ্যাক্টরগলোর নাম :-
১. ফ্যাক্টর- Ⅰ বা ফাইব্রিনোজেন
২. ফ্যাক্টর- Ⅱ বা পোথ্রম্বিন
৩. ফ্যাক্টর- Ⅲ বা থ্রম্বোপ্লাস্টিন
৪. ফ্যাক্টর- Ⅳ বা ক্যালসিয়াম
৫. ফ্যাক্টর- Ⅴ বা ল্যাবাইল ফ্যাক্টর বা প্রোঅ্যাকসেলারিন
৬. ফ্যাক্টর- Ⅵ বা অ্যাকসেলারিন
৭. ফ্যাক্টর- Ⅶ বা স্টেবল ফ্যাক্টর বা প্রোকনভারটিন
৮. ফ্যাক্টর- Ⅷ বা অ্যান্টিহিমোফিলিক ফ্যাক্টর
৯. ফ্যাক্টর- Ⅸ বা ক্রিস্টমাস ফ্যাক্টর
১০. ফ্যাক্টর- Ⅹ বা বা স্টুয়ার্ট ফ্যাক্টর
১১. ফ্যাক্টর- Ⅺ বা প্লাজমা থ্রম্বোপ্লাস্টিন
১২. ফ্যাক্টর- Ⅻ বা হ্যাগম্যান ফ্যাক্টর
১৩. ফ্যাক্টর- ⅫⅠ বা ফাইব্রিন স্টেবিলাইজিং ফ্যাক্টর
রক্ততঞ্চনকাল (Blood clotting period) :
দেহ থেকে নির্গত রক্ত জমাট বাঁশ্তে যে সময় লাগে তাকে রক্ততঞ্চনকাল বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের রক্ততঞ্চানকাল হচ্ছে ৩-৮ মিনিট।
ধাপ-১ বিনষ্ট অনুচক্রিকা ও টিস্যুকোষজাত উপাদান রক্তরসের তঞ্চন সহায়ক উপাদান → থ্রম্বোপ্লাস্টিন
ধাপ-২ প্রোথ্রম্বিন (নিষ্ক্রিয়) থ্রম্বোপ্লাস্টিন → থ্রম্বিন (সক্রিয়)
ধাপ-৩ ফাইব্রিনোজেন থ্রম্বিন → ফাইব্রিন মনোমার