বোরের পরমাণু মডেল (Bohr’s Atom Model)
1913 খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী নীলস বোর (Niels Bohr) পরমাণুর এই মডেল প্রস্তাব করেন এবং 1922 খ্রিস্টাব্দে এই আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বোর প্রস্তাব করেন যে, চিরায়ত বলবিদ্যা (Classical mechanics) এবং বিদ্যুৎ চুম্বকত্ব (Electromagnetism)-এর সূত্রসমূহ পরমাণুতে বিকল হয়ে (break down) পড়ে। তিনি মূলত রাদারফোর্ডের নিউক্লীয় পরমাণু মডেলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করেন এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের বৈপ্লবিক প্রসারণ ঘটিয়ে পরমাণুর বর্ণালি ব্যাখ্যা করেন। তার নাম অনুসারে পরমাণুর এই মডেলকে বোর পরমাণু মডেল বলা হয়। এই পরমাণু মডেলে তিনি রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের প্রধান ত্রুটি পরমাণুর স্থায়ী অস্তিত্বসহ অন্যান্য ত্রুটি দূর করার চেষ্টা করেন। এই পর্যায়ে নীলস বোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করে সমস্যাটির সমাধান করতে চেষ্টা করেন। তিনি রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে নিম্নলিখিত মৌলিক স্বীকার্য প্রয়োগ করেন। এই স্বীকার্যগুলোকে বোর-এর স্বীকার্য বলে।
বোর-এর স্বীকার্যসমূহ (Bohr’s theory)
ক. প্রথম স্বীকার্য (কৌণিক ভরবেগ সংক্রান্ত):
কোনো স্থায়ী কক্ষপথে আবর্তনকালে ইলেকট্রনের মোট কৌণিক ভরবেগ \frac{h}{2 \pi}-এর পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক হবে, অর্থাৎ L= \frac{nh}{2 \pi } এখানে, h হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। অন্যভাবে বলা যায়, যে কক্ষপথগুলোতে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ \frac{h}{2 \pi}-এর পূর্ণ গুণিতক, সেগুলোই অনুমোদিত কক্ষপথ।
এর অর্থ এই যে r ব্যাসার্ধের স্থায়ী কক্ষে m ভরবিশিষ্ট ইলেকট্রন v দ্রুতিতে আবর্তিত হলে এর কৌণিক ভরবেগ, mvr=L= \frac{nh}{2 \pi}
এখানে n একটি পূর্ণ সংখ্যা। বিভিন্ন কক্ষপথের জন্য n-এর মান বিভিন্ন হয়। নিউক্লিয়াসের অবস্থানের সাপেক্ষে ১ম, ২য়, ৩য় ইত্যাদি স্থায়ী কক্ষপথের জন্য n= 1, 2, 3 ইত্যাদি হয়; কিন্তু 0 নয়। n-কে কক্ষপথের মুখ্য কোয়ান্টাম সংখ্যা (Principal quantum number) বলা হয়।
সমীকরণ (9.1) কে বলা হয় বোরের কম্পাঙ্ক শর্ত।
খ. দ্বিতীয় স্বীকার্য (শক্তি স্তর সংক্রান্ত):
পরমাণুস্থ ইলেকট্রনসমূহ ইচ্ছাকৃত যে কোনো ব্যাসার্ধের কক্ষপথে অর্থাৎ সব সম্ভাব্য কক্ষপথে নিউক্লিয়াসের চারদিকে পরিভ্রমণ করতে পারে না। বরং কয়েকটি পৃথক পৃথক নির্দিষ্ট ও সুবিধাযুক্ত বৃত্তাকার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। এই কক্ষপথগুলোকে স্থায়ী ও অবিকিরণযোগ্য কক্ষপথ বলে। এই স্বীকার্য অনুসারে যে কোনো অনুমোদিত কক্ষপথে ইলেকট্রনের শক্তি ধ্রুব থাকে। এজন্য এই কক্ষপথগুলোকে স্থির বা স্থায়ী কক্ষপথ (stationary or stable orbit) বলা হয়।
গ. তৃতীয় স্বীকার্য (কম্পাঙ্ক সংক্রান্ত):
যখনই কোনো ইলেকট্রন একটি যথোপযোগী কক্ষপথ হতে অপর একটি যথোপযোগী কক্ষপথে লাফ দেয়, তখনই শক্তির বিকিরণ বা শোষন ঘটে। যদি ইলেকট্রন উচ্চতর সুবিধাযুক্ত কক্ষপথ হতে নিম্নতর সুবিধাযুক্ত কক্ষপথে লাফ দেয়, তবে শক্তির বিকিরণ ঘটে [চিত্র]। আর যদি ইলেকট্রন নিম্নতর সুবিধাযুক্ত কক্ষপথ হতে উচ্চতর সুবিধাযুক্ত কক্ষপথে লাফ দেয় তবে শক্তির শোষণ ঘটে। এই বিকিরিত বা শোষিত শক্তির পরিমাণ ওই দুটি কক্ষপথের শক্তির বিয়োগফলের সমান এবং এর মান এক কোয়ান্টাম অর্থাৎ h\nu ।
বোর মডেল অনুসারে হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাসার্ধ ও শক্তির রাশিমালা (The radius and energy ratio of the hydrogen atom according to the Bohr model)
ব্যাসার্ধের রাশিমালা
হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি প্রোটন নিউক্লিয়াস হিসেবে থাকে এবং একটি ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে। ধরা যাক, ইলেকট্রনের ভর m এবং চার্জ e৷ মনে করি ইলেকট্রনটি r ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার পথে প্রোটন তথা নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে v বেগে ঘুরছে। সুতরাং ইলেকট্রনের ওপর প্রযুক্ত কেন্দ্রমুখী বল,
\mathrm{F}_{c}=\frac{m v^{2}}{r} … … … (9.3)
আবার প্রোটনের চার্জ এবং প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যকার স্থির তড়িৎ বল,
\mathrm{F}_{e}=\frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \frac{e^{2}}{r^{2}} … … … (9.4)
স্থির তড়িৎ বলই কেন্দ্রমুখী বল সরবরাহ করে, সুতরাং \mathrm{F}_{C}=\mathrm{F}_{e} … … … (9.5)
সমীকরণ (9.3) ও (9.4) থেকে পাই
m v^{2}=\frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \frac{e^{2}}{r}বা, v=\frac{e}{\sqrt{4 \pi \epsilon_{0} m r}}… … … (9.6)
n-তম কক্ষপথের জন্য, v_{\mathrm{n}}=\frac{e}{\sqrt{4 \pi \epsilon_{0} m r_{\mathrm{n}}}} … … … (9.6a)
বোরের ১ম স্বীকার্য থেকে আমরা জানি,
v_{\mathrm{n}} m r_{n}=\frac{n h}{2 \pi}9.6(a) সমীকরণ থেকে -এর মান বসিয়ে পাই,
বা, r_{\mathrm{n}}=\frac{n^{2} h^{2} \epsilon_{0}}{\pi m e^{2}} … … … (9.6b)
[9.6(b)] সমীকরণ হলো n–তম কক্ষপথের ব্যাসার্ধ। n=1 বসিয়ে হাইড্রোজেন পরমাণুর ১ম কক্ষপথের ব্যাসার্ধ পাওয়া যায়,
r_{\mathrm{n}}=\frac{h^{2} \epsilon_{0}}{\pi m e^{2}} … … … (9.6c)
এই কক্ষপথটি নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছে থাকে। এই কক্ষপথকে প্রথম বোর কক্ষপথ এবং কক্ষের ব্যাসার্ধকে প্রথম বোর ব্যাসার্ধ বলা হয়।
সমীকরণ 9.6(c)-এ বিভিন্ন রাশির মান বসিয়ে r_{1}=0.53 \dot{A} পাওয়া যায়।
শক্তির রাশিমালা
হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটিমাত্র ইলেকট্রন আছে। ধরি ইলেকট্রনের মোট শক্তি
E_n=E_k+E_p; এখানে E_k= গতিশক্তি এবং E_p= বিভব শক্তি
=\frac{1}{2} m v_{n}^{2}+(e V) \mathrm{E}_{n}=\frac{1}{2} m v_{n}^{2}-\frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \frac{e^{2}}{r_{n}} =\frac{1}{2} m \frac{e^{2}}{4 \pi \epsilon_{0} m r_{n}}-\frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \frac{e^{2}}{r_{n}}=\frac{1}{2} \frac{e^{2}}{4 \pi \epsilon_{0} r_{\mathrm{n}}}-\frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \frac{e^{2}}{r_{n}} \quad\left[v_{\mathrm{n}}=\frac{e}{\sqrt{4 \pi \epsilon_{0} m r_{\mathrm{n}}}}\right] … … … (9.7)
\therefore \mathrm{E}_{n}=\frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \times e^{2}\left[\frac{1}{2 r_{\mathrm{n}}}-\frac{1}{r_{\mathrm{n}}}\right]=-\frac{1}{2} \times \frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \times \frac{e^{2}}{r_{\mathrm{n}}} … … … (9.8)
এই সমীকরণে r_n-এর মান বসিয়ে পাই,
\begin{aligned} \mathrm{E}_{n} &=-\frac{1}{2} \times \frac{1}{4 \pi \epsilon_{0}} \times \frac{e^{2} \pi m e^{2}}{n^{2} h^{2} \epsilon_{0}} \quad\left[r_{\mathrm{n}}=\frac{h^{2} \epsilon_{0}}{\pi m e^{2}}\right] \\ \therefore \mathrm{E}_{n} &=-\frac{m e^{4}}{8 \epsilon_{0}^{2} n^{2} h^{2}} \end{aligned} … … … (9.8a)
এখানে n=0, 1, 2, ...................n
এই সমীকরণ থেকে দেখা যায় মোট শক্তি সর্বদাই ঋণাত্মক, অর্থাৎ অসীমের দিকে ইলেকট্রনকে সরিয়ে নিতে হলে কাজ সম্পাদন করতে হয়। এর অর্থ হলো ইলেকট্রন পরমাণুতে আবদ্ধ।
n= 1 হলে, 9.4(a) সমীকরণ থেকে পাই,
\mathrm{E}_{n}=-\frac{m e^{4}}{8 \epsilon_{0}^{2} h^{2}} … … … (9.8b)
সুতরাং \mathrm{E}_{n}=\frac{1}{n^{2}} E_{1}, n=1 হলে \mathrm{E}_{2}=\frac{1}{4} E_{1}, n=3 হলে \mathrm{E}_{3}=\frac{1}{9} E_{1}, ইত্যাদি।
9.8(b) সমীকরণে মান বসিয়ে পাওয়া যায়,
\begin{aligned} \mathrm{E}_{1} &=-\frac{\left(9.1 \times 10^{-31} \mathrm{~kg}\right)\left(1.6 \times 10^{-19} \mathrm{C}\right)^{4}}{8 \times\left(6.63 \times 10^{-34} \mathrm{Js}\right)^{2}\left(8.85 \times 10^{-12} \mathrm{C}^{2} \mathrm{~N}^{-1} \mathrm{~m}^{-2}\right)^{2}} \\ &=2.17 \times 10^{-18} \mathrm{~J}=-13.6 \mathrm{eV} \end{aligned}ইহা হাইড্রোজেন পরমাণুর ভূমি অবস্থার শক্তি নির্দেশ করে।
সমীকরণ 9.4(a) কে লেখা যায়, \mathrm{E}_{n}=-\frac{13.6}{n^{2}} বা, \mathrm{E}_{n} \propto \frac{1}{n^{2}} সুতরাং n বৃদ্ধিতে E–এর মান কম ঋণাত্মক হয়, অর্থাৎ শক্তি বৃদ্ধি পায়।
n–তম কক্ষপথে ইলেকট্রনের বেগ : সমীকরণ 9.6(a) থেকে দেখা যায় যে বেগ, v_{n} \propto \frac{1}{\sqrt{r_{n}}}
আবার সমীকরণ 9.6(b) থেকে দেখা যায় যে, ব্যাসার্ধ, r_{n} \propto n^{2}
সুতরাং, v_{n} \propto \frac{1}{\sqrt{n^{2}}} \propto \frac{1}{n} । অর্থাৎ n-এর মান যত বাড়বে ইলেকট্রনের বেগ তত কমবে। n=1, অর্থাৎ প্রথম বোর কক্ষে ইলেকট্রনের বেগ v_1 সবচেয়ে বেশি।
সমীকরণ 9.6(a)–এ n=1 বসিয়ে পাই, v_{\mathrm{n}}=\frac{e}{\sqrt{4 \pi \epsilon_{0} m r_{\mathrm{n}}}}। এখন r=0.53 A=0.53 \times 10^{-10} \mathrm{~m} এবং অন্যান্য মান বসিয়ে পাওয়া যায়, v_{1}=2.18 \times 10^{6} \mathrm{~ms}^{-1}। ইলেকট্রনের এই বেগের মান শূন্যস্থানে আলোর বেগ 3 \times 10^{10} ms^{-1} এর প্রায় 137 ভাগের 1 ভাগ।
বোর কক্ষপথগুলিকে স্থায়ী কক্ষপথ বলা হয় কেন ?
বোর কক্ষপথগুলিকে ‘স্থায়ী কক্ষপথ’ বলা হয় কারণ এই কক্ষপথগুলিতে প্রদক্ষিণ করার সময় ইলেকট্রন কোনো শক্তি বিকিরণ করে না। যদিও প্রদক্ষিণ কালে এদের গতিতে ত্বরণ থাকে তথাপি বোরের স্বীকার্য অনুযায়ী ইলেকট্রনগুলি শক্তি ক্ষয় না করে কক্ষপথে আবর্তন করে।
নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রমুখী বলের উৎস কী ?
নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রমুখী বলের উৎস নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনচার্জ এবং এর চারদিকে ঘূর্ণায়মান ঋণচার্জযুক্ত ইলেকট্রনের ওপর কুলম্বীয় আকর্ষণ বল। অর্থাৎ স্থির তড়িৎ বলই কেন্দ্রমুখী বল সরবরাহ করে।