স্থিতিস্থাপকতা
স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity)
সংজ্ঞা : বল প্রয়োগে যদি কোনো বস্তুর আকার বা আয়তন বা উভয়ের পরিবর্তন ঘটে অর্থাৎ বস্তুর বিকৃত হয়, তাহলে প্রযুক্ত বল সরিয়ে নিলে যে ধর্মের ফলে বিকৃত বস্তু আগের আকার ও আয়তন ফিরে পায় তাকে স্থিতিস্থাপকতা বলে ।
যে বস্তুর বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বেশি তার স্থিতিস্থাপকতাও বেশি হবে । লোহা ও রবারের মধ্যে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা লোহার বেশি তাই লোহা রবারের চেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক ।
পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু (Fully Elastic Material) : বাহ্যিক বল অপসারিত হলে যদি বিকৃত বস্তু ঠিক আগের আকার ও আয়তন ফিরে পায় তাহলে ঐ বস্তুকে পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু বলে ।
স্থিতিস্থাপক সীমা (Elastic Limit) : বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা গুণের জন্য বাহ্যিক বল অপসারিত হলে বিকৃত বস্তু ঠিক আগের আকার, আয়তন ফিরে পায় । কিন্তু বস্তুর এ আকার বা আয়তন পুনঃপ্রাপ্তির ক্ষমতা অসীম নয় । পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রত্যেক বস্তু বাহ্যিক বলের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তুর ন্যায় আচরণ করে । এই সীমাকে স্থিতিস্থাপক সীমা বলা হয় ।
সংজ্ঞা : যে মানের বল পর্যন্ত কোনো বস্তু পূর্ণ স্থিতিস্থাপক থাকে অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বেশি যে বল প্রয়োগ করে বল অপসারণ করলে বস্তুটি পূর্বাবস্থায় ফিরে যায় তাকে স্থিতিস্থাপক সীমা বলে ।
নমনীয় বস্তু (Flexible Material) : কোনো বস্তুর উপর বাহ্যিক বল প্রয়োগ করে তাকে বিকৃত করলে যদি বল অপসারণের পর বস্তুটি ঐ বিকৃত অবস্থা পুরোপুরি বজায় রাখে তাহলে বস্তুটিকে নমনীয় বা পূর্ণ প্লাস্টিক বস্তু বলা হয় ।
পূর্ণ দৃঢ় বস্তু (Full Solid Material) : বাইরে থেকে যেকোনো পরিমাণ বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর যদি আকারের কোনো পরিবর্তন না ঘটে তাহলে বস্তুটিকে পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বলা হয় । পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বাস্তবে পাওয়া যায় না ।
বিকৃতি (Strain) : কোনো বস্তু যদি পূর্ণ দৃঢ় না হয় তাহলে বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে বস্তুটির বিভিন্ন অংশের মধ্যে আপেক্ষিক সরণ হয়; ফলে বস্তুটির আকার বা আয়তনের পরিবর্তন হয় । বস্তুর এ অবস্থাকে রূপবিকৃতি (Deformation) বলে এবং বস্তুটি বিকৃত হয়েছে বলা হয় । আনুপাতিক রূপবিকৃতি বা রূপবিকৃতির হারকে বিকৃতি বলে ।
সংজ্ঞা : বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর একক মাত্রায় যে রূপবিকৃতি বা পরিবর্তন হয় তাকে বিকৃতি বলে ।
ব্যাখ্যা : কোনো বস্তুর আদিমাত্রা A এবং বল প্রয়োগের ফলে মাত্রা B হলে মাত্রার পরিবর্তন হবে B~A ।
\text { সুতরাং বিকৃতি }=\frac{\mathrm{B} \sim \mathrm{A}}{\mathrm{A}}বিকৃতি একটি স্কেলার রাশি ।
মাত্রা ও একক : যেহেতু বিকৃতি একই প্রকার দুটি রাশির অনুপাত তাই এর কোনো মাত্রা ও একক নেই ।
বিকৃতির তাৎপর্য : কোনো বস্তুর বিকৃতি 0.002 বলতে বোঝায় বস্তুর একক মাত্রার পরিবর্তন হয়েছে 0.002 একক ।
পীড়ন (Stress) : কোনো বস্তুকে বিকৃত করা হলে এই বিকৃতি প্রতিরোধ করার জন্য বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা ধর্মের জন্য বস্তুর ভেতর একটি প্রতিরোধ বলের উদ্ভব হয় । এই বল বস্তুকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায় । একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে যে প্রতিরোধ বলের উদ্ভব হয় তাই হচ্ছে পীড়ন ।
সংজ্ঞা : বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর আকার বা দৈর্ঘ্য বা আয়তনের পরিবর্তন ঘটলে স্থিতিস্থাপকতার জন্য বস্তুর ভেতর থেকে এই বলকে বাধাদানকারী একটি বলের উদ্ভব হয় । বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে উদ্ভূত এই বিকৃতি প্রতিরোধকারী বলের মানকে পীড়ন বলে ।
ব্যাখ্যা : যেহেতু প্রযুক্ত বল ও প্রতিরোধকারী বল পরস্পর সমান সেজন্য প্রযুক্ত বল দ্বারাই প্রতিরোধকারী বলের পরিমাপ করা হয় । অতএব পীড়নের মান হচ্ছে একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে প্রযুক্ত বিকৃতি সৃষ্টিকারী বলের মানের সমান । অর্থাৎ,
\text { পীড়न }=\frac{\text { প্রতিরোধকারী বল }}{\text { ক্ষেত্রফল }}=\frac{\text { প্রযুক্ত বল }}{\text { ক্ষেএফল }}
A ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট কোনো বস্তুতে লম্বভাবে F বল প্রয়োগ করা হলে,
\text { পীড়ন } =\frac{F}{A}
পীড়ন একটি স্কেলার রাশি ।
মাত্রা ও একক : পীড়নের মাত্রা হবে,
পীড়ন =\frac{\text { বল }}{\text { ক্ষেত্রফল }} এর মাত্রা অর্থাৎ \mathrm{ML}^{-1} \mathrm{~T}^{-2}
পীড়ন = বল ক্ষেত্রফল এর মাত্রা অর্থাৎ \left[\mathrm{ML}^{-1} \mathrm{~T}^{-2}\right]
পীড়নের একক \mathrm{Nm}^{-2} বা \mathrm{Pa} (প্যাসকেল)
তাৎপর্য : কোনো বস্তুর পীড়ন 5 \times 10^{5} \mathrm{Nm}^{-2} বলতে বোঝায় বস্তুর প্রতি 1 \mathrm{~m}^{2} ক্ষেত্রফলের ওপর লম্বভাবে বিকৃতি প্রতিরোধকারী বলের মান 5 \times 10^{5} \mathrm{~N} ।
বিকৃতি সৃষ্টি করতে প্রতি 1 \mathrm{~m}^{2} ক্ষেত্রফলের ওপর লম্বভাবে প্রযুক্ত বলের মানও তাই ।
অসহ বল বা ভার (Unbearable Force or Weight) : স্থিতিস্থাপক সীমার বাইরে বল প্রয়োগ করা হলে বল অপসারণ করার পর বস্তুটি আর পূর্বাবস্থায় সম্পূর্ণ ফিরে আসে না । প্রযুক্ত বলের মান আরো বেশি হলে বস্তুটি ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় । সবচেয়ে কম যে বল প্রয়োগ করলে বস্তুটি ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় তাকে অসহ বল বলে । অসহ বলকে অসহ ভার বা ওজনও বলা হয় ।
সংজ্ঞা : সর্বাপেক্ষা কম যে বলের ক্রিয়ায় কোনো বস্তু ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় তাকে অসহ বল বলে ।
অসহ পীড়ন (Unbearable Stress) : অসহ বলের জন্য যে পীড়ন হয় তাই অসহ পীড়ন ।
সংজ্ঞা : প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে প্রযুক্ত সর্বাপেক্ষা কম যে বলের ক্রিয়ায় কোনো বস্তু ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় তাকে অসহ পীড়ন বলে ।
অসহ পীড়ন =\frac{\text { অসহ বল }}{\text { ক্ষেত্রফল }} এর মাত্রা অর্থাৎ \mathrm{ML}^{-1} \mathrm{~T}^{-2}
তাৎপর্য : তামার অসহ পীড়ন 3.5 \times 10^{8} \mathrm{~N} \mathrm{~m}^{-2} বলতে বোঝায় তামার তৈরি কোনো বস্তুর প্রতি বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের উপর ন্যূনতম 3.5 \times 10^{8} \mathrm{~N} বল লম্বভাবে প্রয়োগ করলে বস্তুটি ছিঁড়ে বা ভেঙে যাবে ।
পদার্থের স্থিতিস্থাপক ধর্ম ও আন্তঃআণবিক বল (Elastic Properties of Matter and Intermolecular forces)
পদার্থের আণবিক গড়ন বিবেচনা করলে এর স্থিতিস্থাপক ধর্ম সহজে বোঝা যায় । সকল পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক বল ক্রিয়া করে । কঠিন পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে ক্রিয়াশীল এ বলকে সংসক্তি বল (cohesive force) বলে । স্বাভাবিক অবস্থায় কেলাসের অণুগুলো নিম্নতম বিভব শক্তি অবস্থানে অবস্থান করে থাকে । এ অবস্থা এদের সাম্যাবস্থা । এরকম অবস্থানে কোনো অণুর উপর ক্রিয়াশীল নিট আন্তঃআণবিক বল শূন্য । অণুগুলোর মধ্যকার দূরত্ব পরিবর্তনের সাথে আন্তঃআণবিক বলের পরিবর্তন ঘটে ।
আণবিক দূরত্ব যত বেশি হবে, আন্তঃআণবিক বল তত বেশি আকর্ষণধর্মী হবে এবং আন্তঃআণবিক দূরত্ব যত কম হবে আন্তঃআণবিক বল তত বেশি বিকর্ষণধর্মী হবে । স্বাভাবিক অবস্থায় আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বল পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে ফলে নিট বল হয় শূন্য ।
কোনো বস্তুতে দৈর্ঘ্য বা টান পীড়ন প্রয়োগ করা হলে অণুগুলোর মধ্যবর্তী আন্তঃআণবিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায় ফলে অণুগুলো আকর্ষণ বল অনুভব করে বা পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হয় । বহিস্থ বল সরিয়ে নিলে আকর্ষণ বলের প্রভাবে অণুগুলো তাদের সাম্যাবস্থানে ফিরে আসে । অপরদিকে দেখা যায় যে, বহিস্থ বল প্রয়োগে কোনো বস্তুকে যদি সঙ্কুচিত করা হয় তাহলে আন্তঃআণবিক দূরত্ব হ্রাস পায় ফলে তাদের মধ্যে বিকর্ষণ বলের উদ্ভব ঘটে ।
বহিস্থ বল সরিয়ে নিলে বিকর্ষণ বল অণুগুলোকে পুনরায় তাদের সাম্যাবস্থায় ফিরিয়ে আনে । কোনো নির্দিষ্ট টান বলের জন্য কোনো স্বতন্ত্র অণুর কী পরিমাণ সরণ ঘটবে তা আন্তঃআণবিক বলের সবলতার উপর নির্ভর করে । আন্তঃআণবিক বল যত বেশি সবল হবে অণুগুলোর সরণ তত কম হবে । এ রকম অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট পীড়নের দরুন আনুষঙ্গিক বিকৃতি কম হবে বলে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান বেশি হবে ।
তাৎপর্য : তামার অসহ পীড়ন 3.5 \times 10^{8} \mathrm{~N} \mathrm{~m}^{-2} বলতে বোঝায় তামার তৈরি কোনো বস্তুর প্রতি বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের উপর ন্যূনতম 3.5 \times 10^{8} \mathrm{~N} বল লম্বভাবে প্রয়োগ করলে বস্তুটি ছিঁড়ে বা ভেঙে যাবে ।