তড়িৎ কোষ ও তড়িৎ কোষের সমবায় (Electric cell and Electric Circuit)
তড়িৎ কোষ (Electric cell)
যে যন্ত্রের সাহায্যে রাসায়নিক শক্তি বা অন্য শক্তি হতে তড়িৎ শক্তি উৎপন্ন করে তড়িৎ প্রবাহ বজায় রাখা হয় তাকে তড়িৎ কোষ (Electric cell) বলে।
যেমন রাসায়নিক কোষ (Chemical cell), সৌর কোষ (Solar cell), আলোক তড়িৎ কোষ (Photoelectric cell)। সচল যন্ত্রাংশযুক্ত তড়িৎ কোষ হলো ডায়নামো (Dynamo)।
তড়িৎ কোষ মূলত দুই প্রকার। যথা –
(১) প্রাথমিক কোষ বা মৌলিক কোষ (Primary cell) এবং
(২) গৌণ কোষ বা সঞ্চয়ী কোষ (Secondary cell)
প্রাথমিক কোষ বা মৌলিক কোষ (Primary cell):
যে তড়িৎ কোষ নিজেই নিজের রাসায়নিক শক্তি হতে সরাসরি তড়িৎ শক্তি উৎপন্ন করে তড়িৎ প্রবাহ বজায় রাখে, তাকে প্রাথমিক কোষ বা মৌলিক কোষ (Primary cell) বলে।
ভোল্টার কোষ, লেকল্যান্স কোষ, শুষ্ক কোষ ইত্যাদি প্রাথমিক কোষের উদাহরণ।
গৌণ কোষ বা সঞ্চয়ী কোষ (Secondary cells or storage cells):
যে তড়িৎ কোষে বাহির হতে তড়িৎ প্রবাহিত করে তড়িৎ শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিরূপে সঞ্চিত করে রাখা হয় এবং পরে ওই রাসায়নিক শক্তিকে পুনরায় তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তাকে গৌণ কোষ বা সঞ্চয়ী কোষ (Secondary cells or storage cells) বলে ।
বিদ্যুৎ কোষের সমবায় (Combination of cells)
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্তনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ মাত্রা বা বিভব বৈষম্য পরিবর্তনের জন্য কতকগুলো বিদ্যুৎ কোষকে একত্রে যুক্ত করা হয়। একে বিদ্যুৎ কোষের সমবায় (Electric Circuit) বলে এবং এরূপ দলবদ্ধ বিদ্যুৎ কোষগুলোকে একত্রে ব্যাটারি বলে। বিদ্যুৎ কোষের সমবায় তিন প্রকার; যথা
(ক) শ্রেণি বা সিরিজ সমবায় (Series Combination)
(খ) সমান্তরাল সমবায় (Parallel Combination) ও
(গ) মিশ্র সমবায় (Mixed Combination)
শ্রেণি সমবায় (Series Combination)
যদি কতকগুলো বিদ্যুৎ কোষকে (Electric Cell) এমনভাবে যুক্ত করা হয় যাতে প্রথমটির ঋণ পাতের সাথে দ্বিতীয়টির ধন পাত, দ্বিতীয়টির ঋণ পাতের সাথে তৃতীয়টির ধন পাত পর পর এভাবে যুক্ত থাকে তবে বিদ্যুৎ কোষগুলোর এই সমবায়কে শ্রেণি সমবায় (Series Combination) বলে।
ধরা যাক R মানের একটি রোধের দুই প্রান্তের সাথে n টি বিদ্যুৎ কোষ শ্রেণি সমবায়ে যুক্ত আছে (চিত্র)। প্রত্যেক বিদ্যুৎ কোষের বিদ্যুচ্চালক শক্তি E এবং অভ্যন্তরীণ রোধ r। কোষগুলোর মিলিত বিদ্যুচ্চালক শক্তি বা ব্যাটারির বিদ্যুচ্চালক শক্তি অথবা বর্তনীর বিভব বৈষম্য n E এবং সমতুল্য অভ্যন্তরীণ রোধ n r৷ কেননা রোধগুলো শ্রেণি সমবায়ে যুক্ত। কোষগুলোর অভ্যন্তরীণ রোধ আবার R-এর সাথে শ্রেণি সমবায়ে যুক্ত। কাজেই বর্তনীর মোট রোধ =n r+R।
ও’মের সূত্র অনুসারে বর্তনীর বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা,
i_{s}=\frac{\text { মোট বিদ্যুচ্চালক শক্তি }}{\text { মোট রোধ }}=\frac{n \mathrm{E}}{n r+R}১) যদি n r-এর তুলনায় R অনেক বড় হয় অর্থাৎ n r \ll R, তবে n r অগ্রাহ্য করা যায়।
এই অবস্থায়, i_{s}=\frac{n \mathrm{E}}{\mathrm{R}}=n \times একটি কোষের সৃষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা >\frac{n \mathrm{E}}{n r+R}।
সুতরাং উচ্চ বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা সৃষ্টির জন্য কোষগুলোকে এমনভাবে যুক্ত করতে হবে যাতে nr -এর তুলনায় R অনেক বড় হয়।
২) যদি n r-এর তুলনায় R অনেক ছোট হয় তবে R উপেক্ষা করে পাওয়া যায়,
i_{s}=\frac{n \mathrm{E}}{n r}=\frac{\mathrm{E}}{r} একটি কোষের সৃষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা।
এ অবস্থায় ব্যাটারির কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না।
সমান্তরাল সমবায় (Parallel Circuit)
যদি কতকগুলো বিদ্যুৎ কোষের (Electric Cell) ধন পাতগুলো এক বিন্দুতে এবং ঋণ পাতগুলো অপর এক বিন্দুতে যুক্ত থাকে তবে বিদ্যুৎ কোষগুলোর এই সমবায়কে সমান্তরাল সমবায় (Parallel Circuit) বলে।
ধরা যাক R মানের একটি রোধের সাথে n সংখ্যক বিদ্যুৎ কোষ সমান্তরাল সমবায়ে যুক্ত আছে। প্রত্যেক বিদ্যুৎ কোষের বিদ্যুচ্চালক শক্তি E এবং অভ্যন্তরীণ রোধ r। যেহেতু কোষগুলোর ধন পাতগুলো এক বিন্দু A-তে এবং ঋণ পাতগুলো অপর এক বিন্দু B-তে যুক্ত (চিত্র), কাজেই সমবায়ের বা ব্যাটারির বিদ্যুচ্চালক শক্তি যে কোনো একটি বিদ্যুৎ কোষের বিদ্যুচ্চালক শক্তির সমান হবে। আবার যেহেতু কোষগুলো সমান্তরাল সমবায়ে যুক্ত আছে, অতএব তাদের অভ্যন্তরীণ রোধগুলোও সমান্তরাল সমবায়ে থাকবে। সুতরাং সমবায়ের বা ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ \mathrm{R}_{p} হলে,
\frac{1}{\mathrm{R}_{p}}=\frac{1}{r}+\frac{1}{r}+\cdots n \quad \text { পদ }=\frac{n}{r}সুতরাং বর্তনীর মোট রোধ =\mathrm{R}+\mathrm{R}_{p}=\mathrm{R}+\frac{\mathrm{r}}{\mathrm{n}}। বর্তনী দিয়ে i_{p} মাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে ও’মের সূত্রানুসারে,
\begin{aligned} i_{p} &=\frac{\text { মোট বিদ্যুচ্চালক শক্তি }}{\text { মোট রোধ }} \\ &=\frac{\mathrm{E}}{\mathrm{R}+\frac{r}{n}}=\frac{n E}{n R+r} \end{aligned}(১) যদি r-এর তুলনায় n R অনেক বড় হয়, তবে r অগ্রাহ্য করে পাওয়া যায়, i_{p}=\frac{n E}{n R}=\frac{E}{R} একটি কোষের সৃষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা।
এ অবস্থায় ব্যাটারির কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না ।
(২) যদি r-এর তুলনায় n R অনেক ছোট হয়, তবে i_{p}=\frac{n E}{r}=n \times একটি কোষের সৃষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা।
এ অবস্থায় ব্যাটারির কার্যক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
কী শর্তে কোষের শ্রেণি ও সমান্তরাল সমবায়ে প্রবাহমাত্রা বৃদ্ধি পায় ?
1.(a) যখন \mathrm{R}>>\mathrm{nr} তখন \mathrm{I}=\mathrm{nE} / \mathrm{R} অর্থাৎ বর্তনীতে যে প্রবাহমাত্রা হবে উহা একটি কোষপ্রদত্ত প্রবাহমাত্রার n গুণ। \mathrm{E} / \mathrm{R} হলো একটি কোষের প্রবাহমাত্রা।
(b) যখন \mathrm{nr}>>\mathrm{R}, তখন \mathrm{I}=\mathrm{nE} / \mathrm{nr}=\mathrm{E} / \mathrm{r} অর্থাৎ বর্তনীতে যে প্রবাহমাত্রা হবে উহা একটি কোষ প্রদত্ত প্রবাহমাত্রার সমান।
(c) কাজেই যখন বহিঃবর্তনীর রোধ ব্যাটারির মোট অভ্যন্তরীণ রোধ অপেক্ষা খুব বেশি তখন শ্রেণি সমবায়ের ফলে প্রবাহমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
2.(a) যখন n R>>r, তখন I=n E / n R=E / R, অর্থাৎ বর্তনীতে যে প্রবাহমাত্রা হবে উহা একটি কোষ প্রদত্ত প্রবাহমাত্রার সমান।
(b) যখন r>>n R, তখন I=n E / r, অর্থাৎ বর্তনীতে যে প্রবাহমাত্রা হবে উহা একটি কোষ প্রদত্ত প্রবাহমাত্রার n গুণ।
কাজেই যখন ব্যাটারির অভ্যন্তরীণ রোধ বহিঃবর্তনীর রোধ অপেক্ষা খুব বেশি হয় তখন সমান্তরাল সমবায়ের ফলে প্রবাহমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
সমান সংখ্যক অভিন্ন কোষ শ্রেণি সমবায়ে এবং সমান্তরাল সমবায়ে যুক্ত করা হলো। কী শর্তে বর্তনীর সঙ্গে যুক্ত একটি রোধের মধ্যে প্রবাহের মান উভয় ক্ষেত্রে সমান হবে ?
ধর, প্রত্যেকটি তড়িচ্চালক বল E ও r অভ্যন্তরীণ রোধযুক্ত সংখ্যক কোষ নেওয়া হলো। কোষগুলি শ্রেণি সমবায়ে যুক্ত হলে,
বহিঃরোধক R এর মধ্যে প্রবাহ,i_{1}=\frac{\mathrm{nE}}{\mathrm{R}+\mathrm{nr}} এবং কোষগুলি সমান্তরাল সমবায়ে যুক্ত করলে।
R এর মধ্যে প্রবাহ, i_{2}=\frac{\mathrm{nE}}{\mathrm{nR}+\mathrm{r}}
প্রদত্ত শর্তানুযায়ী i_{1}=i_{2} হবে যখন \mathrm{R}=\mathrm{r} হয়।
কোন অবস্থাতে কোষের প্রান্তীয় বিভব পার্থক্য কোষের তড়িচ্চালক বল অপেক্ষা বেশি হয় ?
সাধারণভাবে কোষের তড়িচ্চালক বল কোষের প্রান্তীয় বিভব পার্থক্য অপেক্ষা বেশি হয়।
কোষের তড়িচ্চালক বল = প্রান্তীয় বিভব পার্থক্য + কোষের অভ্যন্তরীণ বিভব পতন।
কিন্তু দুটি ভিন্ন তড়িচ্চালক বলের কোষ যদি বিরুদ্ধ সমবায়ে (in opposition) যুক্ত করা হয় তবে বেশি তড়িচ্চালক বলের কোষটি অপর কোষকে চার্জ করবে অর্থাৎ কম তড়িচ্চালক বলের কোষটি নিজ হতে বর্তনীতে যে অভিমুখে তড়িতাধান পাঠাত, বেশি তড়িচ্চালক বলের কোষটি অপরটির ভেতর দিয়ে বিপরীতমুখী তড়িতাধান পাঠানোর ফলে কম তড়িচ্চালক বলের কোষের প্রান্তীয় বিভব পার্থক্য তার তড়িচ্চালক অপেক্ষা বেশি হবে। চিত্রানুযায়ী e_{1} তড়িচ্চালক বলযুক্ত একটি কোষকে e_{2}, তড়িচ্চালক বলের কোষের সঙ্গে বিরুদ্ধ সমবায়ে যুক্ত করা হয়েছে (\left(e_{2}>e_{1}\right))। এক্ষেত্রে B কোষ A কোষকে চার্জ করবে। A কোষের প্রান্তীয় বিভব পতন e_{1} অপেক্ষা বেশি হবে।
শক্তিশালী প্রবাহ পাওয়ার জন্য একই মানের কোষের শ্রেণি সমবায়ের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রোধ বহিস্থ রোধ অপেক্ষা কম কেন ?
মনে করি, E তড়িচ্চালক বল এবং r অভ্যন্তরীণ রোধের n সংখ্যক তড়িৎ কোষকে শ্রেণিতে যুক্ত করে R মানের বহিস্থ রোধের সাথে যুক্ত করলে তড়িৎ প্রবাহের মান i=\frac{\mathrm{nE}}{\mathrm{R}+\mathrm{nr}}, \mathrm{R} \gg \mathrm{r} এবং \mathrm{R} \gg n \mathrm{r} হলে, i=\frac{\mathrm{nE}}{\mathrm{R}}=\frac{n E}{R}। কিন্তু \frac{E}{R} হলো একটি কোষের ক্ষেত্রে তড়িৎ প্রবাহ, কারণ r=0। সুতরাং এক্ষেত্রে n সংখ্যক কোষ ব্যবহার করায় n গুণ তড়িৎ প্রবাহ পাওয়া যায়। সুতরাং শক্তিশালী প্রবাহ পাওয়ার জন্য একই মানের কোষের শ্রেণি সমবায়ের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রোধ বহিস্থ রোধ অপেক্ষা কম.