10 Minute School
Log in

তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ ও বর্নালি (Electromagnetic Wave & Spectrum)

তড়িচুম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic wave) :

শক্তির স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে সপ্তদশ শতাব্দীতে দুটি মতবাদ উপস্থাপন করা হয়। প্রথমটি হলো নিউটনের কণিকা তত্ত্ব এবং দ্বিতীয়টি হাইগেনস-এর তরঙ্গ তত্ত্ব।

আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব (Wave theory of light) :

হাইগেনস (Huygens) প্রথম 1678 খ্রিস্টাব্দে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। পরে ইয়ং, ফ্রেনেল এবং আরও অনেক বিজ্ঞানী এই তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। 

এই তত্ত্বের সাহায্যে আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু সমবর্তন, ফটো-তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখা করা যায় না। পরবর্তীকালে মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হয় যে, প্রকৃতিতে ইথার নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই।  

তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic wave) :

1845 খ্রিষ্টাব্দে ফ্যারাডে আবিষ্কার করেন যে একটি প্রবল চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব সমবর্তন তল ঘুরে যায়। এ ঘটনা ফ্যারাডে ক্রিয়া নামে পরিচিত।

\epsilon_{O}=\frac{1}{4 \pi \times 9 \times 10^{9}} \operatorname{coul}^{2} N^{-1} m^{-2}=8. 85 \times 10^{-12} \operatorname{coul}^{2} / N^{-1} m^{-2}

\mu_{0} হলো শূন্য মাধ্যমে প্রবেশ্যতার ধ্রুবক এবং এর মান \mu_{0}=4 \pi \times 10^{-7} \mathrm{NA}^{-2}

মাক্সওয়েল এও প্রমাণ করেন যে, এ তরঙ্গ অনুপ্রস্থ (Transverse) তরঙ্গ।

পয়েন্টিং ভেক্টর (Pointing vector) :

কোনো তড়িৎ চুম্বক তরঙ্গের গতিপথে লম্বভাবে স্থাপিত কোনো একক ক্ষেত্রফলের মধ্য দিয়ে যে পরিমাণ শক্তি অতিক্রম করে তাকে পয়েন্টিং ভেক্টর বলে।

pointing vector

\vec{S}=\vec{E} \times \vec{H}

এবং একক হলো \text{ওয়াট/মিটার}^{2}। যেহেতু S একটি ভেক্টর রাশি এর দিক হবে যে দিকে শক্তি স্থানান্তরিত হয় সেদিকে।

তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্বের সাহায্য আলোর সমবর্তন ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু আলোক তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না। আলোক তড়িৎ ক্রিয়া, কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করার জন্য 1900 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী মাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। 

আলোক বর্ষ (Light year) :

আলোক বর্ষ = 9.46 \times 10^{15} \mathrm{~m}=9. 46 \times 10^{12} \mathrm{~km}

নভোমন্ডলীর পরিমাপে এই একক ব্যাবহার করা হয়।

আলোর প্রকৃতি সম্বন্ধে বিভিন্ন তত্ত্বের উল্লেখ কর (Different theories about the nature of light)

আলোকের প্রকৃতি সম্বন্ধে যেসব তত্ত্ব উদ্ভবিত হয়েছে সেগুলি হলো-

(i) নিউটনের কণিকা তত্ত্ব : এই তত্ত্বের সাহায্যে ঋজুগতি প্রতিফলন, প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করা যায়; কিন্তু ব্যতিচার, সমবর্তন, অপবর্তন, বিচ্ছুরণ ব্যাখ্যা করা যায় না।     

(ii) হাইগেনের তরঙ্গ তত্ত্ব : এই তত্ত্বের সাহায্যে প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়; কিন্তু সমবর্তন ব্যাখ্যা করা যায় না।    

(iii) মাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্ব : এই তত্ত্বের সাহায্যে আলোর সমবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়; কিছু ফটো-তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না।  

(iv) আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম তত্ত্ব : এই তত্ত্বের সাহায্যে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ, ফটো-তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়; কিন্তু ব্যতিচার, অপবর্তন, সমবর্তন ব্যাখ্যা করা যায় না।   

তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Electromagnetic wave) :

১। তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic wave) তড়িৎ ক্ষেত্র \vec{E} ও চৌম্বক ক্ষেত্র \vec{B} -এর পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন হয়।

২। তরঙ্গ সঞ্চালনের অভিমুখ \vec{E} \vec{B} উভয়ের ওপর লম্ব। তাই তড়িচুম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic wave) আড় তরঙ্গ। 

৩। তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের সঞ্চালনের জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না।

৪। তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের তীব্রতা দুরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতে হ্রাস পায়। অর্থাৎ 

\mathrm{E} \infty \frac{1}{r^{2}}, এখানে E হলে তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের তীব্রতা এবং r হলো উৎস হতে দুরত্ব। সুতরাং, দূরত্ব দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলে তীব্রতা চারগুণ হ্রাস পাবে। 

৫। তড়িৎচুম্বকীয় সকল বিকিরণের তরঙ্গের বেগ c, তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাস্ক -এর মধ্যে নিম্নোক্ত সম্পর্ক প্রযোজ্য : \mathrm{C}=\mathrm{u} \lambda  

৬। শূন্য মাধ্যমে এই তরঙ্গের বেগ 3 \times 10^{8} \mathrm{~ms}^{-1}

দৃশ্যমান আলোর বর্ণালি (Spectrum of visible light) : 

এই বর্ণগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমা নিচে দেওয়া হলো 

বেগুনি 3.80×10^{-7}থেকে  4.25×10^{-7}m
নীল 4.25×10^{-7}m থেকে 4.45×10^{-7}m
আসমানি 4.45×10^{-7}m থেকে 5.00×10^{-7}m
সবুজ 5.00×10^{-7}m থেকে 5.75×10^{-7}m
হলুদ 5.75×10^{-7}m থেকে 5.85×10^{-7}m
কমলা 5.85×10^{-7}m থেকে 6.20×10^{-7}m
লাল 6.20×10^{-7}m থেকে 7.80×10^{-7}m

তড়িৎ চুম্বকীয় স্পেকট্রাম বা বর্ণালি

(Electromagnetic spectrum)

\mathrm{C}=\mathrm{u} \lambda  

তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্কের প্রসার বা পাল্লা (range) অত্যন্ত বেশি। এর প্রসারতা 104Hz বা সাইকেল/সেকেন্ড-এর কম মান থেকে শুরু করে 1023Hz বা সাইকেল/সেকন্ড-এর ঊর্ধ্বে পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পরিসরকে তরিৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি (Electromagnetic Spectrum) বলে।electromagnetic wave

 

তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালির বৈশিষ্ট্যমূলক ছক

(Characteristic chart of electromagnetic spectrum)

তরঙ্গ পট্টি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিসর বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ/ব্যবহার
বেতার তরঙ্গ 10^{-4}m থেকে 5×10^{4}m বিভিন্ন ধরনের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থাৎ দূরবর্তী স্থানে স্পন্দিত ছবি প্রেরণের জন্য বেতার তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়।
মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ 10^{-1}m থেকে 5×10^{-3}m রাডার যন্ত্রে, নৌ ও বিমান চালনায়, রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থায়, শিল্প কারখানায় এই তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়। এই ছাড়া খাবার গরম করা ও রান্নার কাজে মাইক্রোওভেন ব্যবহৃত হয়।
অবলোহিত রশ্মি 10^{-3}m থেকে 4×10^{-7}m বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায়, জ্যোতির্বিদ্যায়, শিল্প কারখানায় এই রশ্মি ব্যবহৃত হয়। অন্ধকারে দেখার জন্য নাইট গগলস হিসেবে এবং অন্ধকারে ছবি তোলার জন্য এই রশ্মির ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। মাংশপেশীর ব্যথা ও টান এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
দৃশ্যমান আলো

বেগুনি………….

নীল……………..

আসমানি………

সবুজ……………

হলুদ…………….

কমলা…………..

লাল……………..

7×10^{-7}m থেকে  4×10^{-7}m

3.8×10^{-7}m থেকে 4.25×10^{-7}m

4.25×10^{-7}m থেকে 4.45×10^{-7}m

4.45×10^{-7}m থেকে 5×10^{-7}m

5×10^{-7}m থেকে 5.75×10^{-7}m

5.75×10^{-7}m থেকে 5.85×10^{-7}m

5.85×10^{-7}m থেকে 6.20×10^{-7}m

6.20×10^{-7}m থেকে 7.80×10^{-7}m

যে কোনো কিছু দেখার কাজে আমাদের চোখ এই আলো ব্যবহার করে। উদ্ভিদে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে। ফটোগ্রাফিক ফিল্ম প্রভাবিত করে।
অতিবেগুনি রশ্মি 5.00×10^{-7}m থেকে 5.00×10^{-9}m আয়নায়ন ঘটনোর কাজে, প্রতিপ্রভা সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর কাজে, ফটো-ইলেকট্রিক ক্রিয়া সংঘটনে, ফটোগ্রাফিক ফিল্ম  প্রভাবিত করার কাজে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে এবং শরীরে ভিটামিন D তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
এক্স-রে

(x-ray)

5.00×10^{-8}m  থেকে 5.00×10^{-15}m চিকিৎসা ক্ষেত্রে, গবেষণা কাজে, শিল্প কারখানায়, নিরাপত্তার কাজে, চোরা-চালান নিরোধে এক্স-রে ব্যবহৃত হয়।
গামা রশ্মি 5.00\times10^{-11}m থেকে 5.00\times10^{-7}m বা এর চেয়ে কম। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে, বিজ্ঞানাগারে গবেষণার কাজে, ধাতব পদার্থের খুঁত নির্ণয়ে এই রশ্মি ব্যবহৃত হয়। মানব দেহে ক্যান্সার আক্রান্ত সেলকে ধ্বংস করতে এই রশ্মি ব্যবহৃত হয়।

 

তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্রম অনুযায়ী সাজাও (বড় থেকে ছোট) :

  1. রেডিও এবং টিভি তরঙ্গ
  2. অবহেলিত রশ্মি
  3. দৃশ্যমান আলোক রশ্মি
  4. অতিবেগুনী রশ্মি, 
  5. X-রশ্মি
  6. \gamma-রশ্মি 

 

জানার বিষয়: 

  1. মহাজাগতিক রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যে <10^{-14}m
  2. \sqrt{\mu_{0} \epsilon_{0}} এর একক m^{-1}s

তরঙ্গমুখ (Wave front)

আমরা জানি, কোনো একটি মাধ্যমের বিভিন্ন কণার সস্মিলিত কম্পনের ফলে মাধ্যমে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই আলোড়নকে তরঙ্গ বলে। যেমন পুকরের স্থির পানিতে ঢিল ছুঁড়লে তরঙ্গ উৎপন্ন যা উৎপন্ন স্থান থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গমুখের নিম্নলিখিত যে কোনো একটি সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে-

(ক) তরঙ্গস্থিত সমদশাসম্পন্ন কণাগুলো যে তলে অবস্থান করে, তাকে সৃষ্ট তরঙ্গের তরঙ্গমুখ বলে।

(খ) যে কোনো সময় একই দশায় থাকা বিন্দুগুলি যে রেখা বা তলের ওপর অবস্থিত তাকে তরঙ্গমুখ বলে।   

ব্যাখ্যা: মনে করি কোনো সমসত্ত্ব  (isotrophic) মাধ্যমে অবস্থিত S একটি ক্ষুদ্র আলোক উৎস। উৎসের অণুগুলোর কম্পনে উৎপন্ন আড় তরঙ্গ মাধ্যমের চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আলোকের বেগ c হলে t সেকেন্ড সময়ে আলোর তরঙ্গ S হতে বিভিন্ন দিকে ct পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করবে।

এখন S-কে কেন্দ্র করে ct ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি গোলক অঙ্কন করলে ওই গোলকের উপরিতলে অবস্থিত প্রতিটি বিন্দুর দশা একই হবে। গোলকের উপরিতলই সমদশা-গ্রস্ত কণাগুলোর অবস্থান নির্দেশ করবে। সুতরাং, ওই মুহূর্তে গোলকের গোলীয় পৃষ্ঠটি আলোর তরঙ্গমুখ। অতএব A হলে তরঙ্গমুখ। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আলো দূরে সরে যাবে এবং তরঙ্গমুখের নতুন নতুন অবস্থান পাওয়া যাবে। চিত্র ৭.১-এ B ও C যথাক্রমে t_1  এবং t_2  সময়ে তরঙ্গমুখের নতুন অবস্থান। তরঙ্গমুখের উল্লম্ব বরাবর অঙ্কিত SP,SQ,SR প্রভৃতি রেখা বিভিন্ন দিকে আলোর সঞ্চারণের দিক নির্দেশ করে।   

তরঙ্গমুখ (Wave front)

গোলকীয় তরঙ্গমুখ: আমরা জানি, তরঙ্গস্থিত সমদশাসম্পন্ন কণাগুলোর সঞ্চারপথ হলো তরঙ্গমুখ। উৎস হতে উৎপন্ন আলোর তরঙ্গমুখ উৎসের কাছাকাছি অবস্থানে গোলকীয়। চিত্র ৭.৪-এ A,B,C ইত্যাদি গোলকীয় তরঙ্গমুখ। গোলকীয় তরঙ্গমুখের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দেয়া যায়- 

তরঙ্গস্থিত সমদশাসম্পন্ন  কণাগুলোর সঞ্চারপথ গোলকীয় হলে তাকে গোলকীয় তরঙ্গমুখ বলে। গোলকীয় তরঙ্গমুখসম্পন্ন তরঙ্গকে গোলকীয় তরঙ্গ বলে।

সমতল তরঙ্গমুখ: উৎস হতে দূরবর্তী অঞ্চলে তরঙ্গমুখের বক্রতা কমতে থাকে। বহু দূরের উৎস হতে আগত তরঙ্গ মুখ সমতল হবে। এজন্য সূর্যের বা অন্য কোনো নক্ষত্রের তরঙ্গমুখকে সমতল বিবেচনা করা হয়। পরবর্তী ৭.৪ অনুচ্ছেদের চিত্র ৭.৫ (ক)-এ AB ও CD সমতল তরঙ্গমুখ। অর্থাৎ তরঙ্গস্থিত সমদশাসম্পন্ন কণাগুলোর সঞ্চারপথ সমতল হলে তাকে সমতল তরঙ্গ বলে। সমতল তরঙ্গমুখসম্পন্ন তরঙ্গকে সমতল তরঙ্গ বলে।