তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র (First Law of Thermodynamics)
তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র | First Law of Thermodynamics:
বিজ্ঞানী কাউন্ট রামফোর্ড, হ্যামফ্রে ডেভী এবং জেমস্ প্রেসকট জুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, কাজ তথা যান্ত্রিক শক্তি হতে তাপ উৎপন্ন হয় এবং তাপ গতিরই একটি রূপ। তাদের এই মতবাদ হতেই বস্তুত তাপগতিবিদ্যার সূত্রপাত। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখা তাপ ও যান্ত্রিক শক্তির পরস্পর রূপান্তর ও সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে তাকে তাপগতিবিদ্যা (Thermodynamics) বলে।
তাপগতিবিদ্যার সূত্রাবলি আলোচনার পূর্বে তাপগতি সম্পর্কীয় কয়েকটি রাশির সংজ্ঞা আমাদের জানা প্রয়োজন।
(ক) তাপগতীয় ব্যবস্থা বা সিস্টেম (Thermodynamic system) :
তাপগতীয় ব্যবস্থা বা সিস্টেম বলতে তল বা বেষ্টনী দ্বারা সীমাবদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ বস্তুকে বুঝায় যেখানে তাপগতীয় চলরাশি (চাপ, আয়তন, তাপমাত্রা) পরিমাপ করা যায়। যেমন একটি পিস্টনযুক্ত সিলিণ্ডারে অথবা একটি বেলুনে আবদ্ধ গ্যাসকে আমরা তাপগতীয় ব্যবস্থা বা সিস্টেম বলে থাকি। কিন্তু ঢাকনাবিহীন হাঁড়িতে পানি ফোটানো হলে তাকে সিস্টেম বলা হয় না।
(খ) পরিপার্শ্ব (Surroundings) :
একটি ব্যবস্থার আশেপাশের সব কিছুকে বলা হয় পরিপার্শ্ব। যেমন পিস্টন ও সিলিন্ডারের আশেপাশের বায়ু হলো এর পরিপার্শ্ব। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থার সাথে শক্তি বিনিময়ে সক্ষম যে কোনো ব্যবস্থাকে ওই ব্যবস্থার পরিপার্শ্ব বলে।
(গ) তাপগতীয় স্থানাঙ্ক (Thermodynamic co-ordinates) :
যে সকল রাশির মান কোনো ব্যবস্থার অবস্থা নির্ধারণ করে সেগুলিকে ব্যবস্থার তাপগতীয় স্থানাঙ্ক বলে। যেমন সিলিণ্ডারে আবদ্ধ গ্যাস হলো ব্যবস্থা এবং গ্যাসের অবস্থার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে এর চাপ, আয়তন ও পরম তাপমাত্রা। তাই চাপ, আয়তন ও পরম তাপমাত্রাকে তাপগতীয় স্থানাঙ্ক বলে।
(ঘ) সাম্যবস্থা (Equilibrium) :
কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থার চূড়ান্ত অবিচল (steady) অবস্থাকে তাপগতীয় সাম্যবস্থা বলে। সাম্যাবস্থায় ব্যবস্থার সকল বিন্দুতে তাপগতীয় স্থানাঙ্ক অর্থাৎ চাপ, আয়তন, তাপমাত্রার মান সমান।
(ঙ) তাপগতীয় প্রক্রিয়া (Thermodynamic process) :
কোনো ব্যবস্থার তাপগতীয় স্থানাঙ্কসমূহের যে কোনো পরিবর্তনকে তাপগতীয় প্রক্রিয়া বলা হয়।
(চ) অভ্যন্তরীণ বা অন্তঃস্থ শক্তি (Internal energy) :
কোনো সিস্টেমের মধ্যে যে শক্তি অন্তর্নিহিত বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে যা পরিবেশ পরিস্থিতিতে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাকে অভ্যন্তরীণ বা অন্তঃস্থ শক্তি বলে। সিস্টেমে তাপ প্রয়োগ করলে অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। আর তাপ প্রয়োগ না করলে অভ্যন্তরীণ শক্তি ধ্রুব (constant) থাকে। কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি নির্ভর করে চাপ, আয়তন এবং তাপমাত্রার সাথে কিছু ভৌত ধর্ম; যেমন আপেক্ষিক তাপ, প্রসারণ সহগ ইত্যাদির ওপর।
বিজ্ঞানী জুল সর্বপ্রথম কাজ ও তাপের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং সম্পর্কটি সূত্রাকারে প্রকাশ করেন। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র ব্যবহার করে সিস্টেমে সম্পাদিত কাজ, অভ্যন্তরীণ শক্তি নির্ণয় করা যায়। একে জুলের মতবাদ বলে। বিজ্ঞানী জুল নিম্নলিখিত উপায়ে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র বিবৃত করেন।
সূত্র: যখন কাজ সম্পূর্ণভাবে তাপে বা তাপ সম্পূর্ণভাবে কাজে রূপান্তরিত হয় তখন কাজ ও তাপ পরস্পরের সমানুপাতিক হয়।
ব্যাখ্যা : যদি W পরিমাণ কাজ সম্পূর্ণরূপে তাপে পরিণত হওয়ায় Q পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়, তবে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রানুসারে, W∝Q
বা, W=JQ
এখানে J একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক। একে তাপের যান্ত্রিক সমতা (mechanical equivalent of heat) বা জুল তুল্যাঙ্ক (Joule’s Equivalent) বলে।
তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র শক্তির নিত্যতা সূত্রের একটি বিশেষ রূপ। বিজ্ঞানী ক্লসিয়াস (Clausius) এই সূত্রকে সাধারণভাবে প্রকাশ করেন। তাঁর মতে তাপশিক্তি অন্য কোনো শক্তিতে রূপান্তরিত হলো কিংবা অন্য কোনো শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হলে সিস্টেমের মোট শক্তির পরিমাণ একই থাকে। একে ক্লসিয়াসের মতবাদ বলে। বিজ্ঞানী ক্লসিয়াস নিম্নলিখিত উপায়ে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রকে বিবৃত করেন।
সূত্র : যখন কোনো ব্যবস্থায় (system) তাপ সরবরাহ করা হয় বা ব্যবস্থা কর্তৃক তাপ গৃহীত হয়, তখন এর কিছু অংশ অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি করতে অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে এবং অবশিষ্ট অংশ বাহ্যিক কাজ সম্পাদনে ব্যয় হয়। অর্থাৎ, প্রদত্ত তাপ = অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি + বাহ্যিক কাজ।