মানবদেহে হরমোনাল ক্রিয়া (Hormonal Activities)
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি শারীরবিজ্ঞানী ক্লড বার্নার্ড (Claude Bernard) সর্বপ্রথম প্রাণিদেহের অন্তঃস্থ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে মানবদেহে মূত্রের ঘনত্ব, রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা ও রক্তের pH নিয়ন্ত্রণে মূল কার্যকর উপাদান হিসেবে হরমোনাল ক্রিয়া (Hormonal Activities) কিভাবে জটিল ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে চলেছে বিজ্ঞানীরা তা উদ্ভাবন করেছেন। নিচে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো :
মূত্রের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ (Control of Urine Concentration)
আহারের সঙ্গে পানি গ্রহণ এবং ঘাম, মল-মূত্র ত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে পানি ত্যাগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ রক্তের দ্রব (solute)-এর স্থিতাবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্টৰ্ভাবে প্রভাব ফেলে অ্যান্টিডাইইউরেটিক হরমোন (ADH)। বিপুল পরিমাণ কম ঘন মূত্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ডাইইউরেসিস (diuresis) এবং এর বিপরীত প্রক্রিয়াটি অ্যান্টিডাইইউরেসিস (antidiuresis) নামে পরিচিত। ADH কার্যগতভাবে অ্যান্টিডাইউরেটিক, অতএব বেশি ঘন মূত্র উৎপন্নে ভূমিকা পালন করে। ADH একটি পেপটাইড হরমোন। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে উৎপন্ন হয়ে পিটুইটারি গ্রন্থির পশ্চাৎখন্ডে প্রবেশ করে। রক্তে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে অবস্থিত অসমোরিসেপ্টর কোষগুলো উত্তেজিত হয় এবং ADH উৎপন্ন করে । নিউরোনের অ্যাক্সন বেয়ে ADH পশ্চাৎ পিটুইটারি গ্রন্থিতে প্রবেশ করে এবং রক্তস্রোতে ক্ষরিত হয়। ক্ষরিত হরমোন বৃক্কসহ দেহের সব অংশে বাহিত হয়।
বৃক্কে নেফ্রনগুলোর সংগ্রাহী নালির কোষঝিল্লিতে অবস্থিত গ্রাহক অণু ADH গ্রহণ করে, ফলে ঝিল্লির পানিভেদ্যতা বেড়ে যায়। গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট থেকে তখন পানি অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় বৃক্কের সংগ্রাহী নালিতে পুনঃশোষিত হয়। সংগ্রাহী নালিতে তরল বেশ ঘন হয়ে যায় এবং ব্যক্তি অল্প পরিমাণ অতিঘন মূত্র উৎপন্ন করে। অন্যদিকে, রক্তে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে হাইপোথ্যালামাসের অসমোরিসেপ্টর কোষগুলো তেমন উত্তেজিত হয় না এবং অতি অল্প পরিমাণ ADH ক্ষরিত হয়। তখন সংগ্রাহী নালির কোষগুলো প্রায় পানি-অভেদ্য হয়ে যায়, ফলে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট থেকে পানি পুনঃশোষণ বন্ধ থাকে।
সংগ্রাহী নালিতে তখন ফিলট্রেট অনেক তরল হয়ে যায় এবং ব্যক্তি বেশি পরিমাণ অতি তরল মূত্র উৎপন্ন করে। দেহে পানির সমতা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ অবস্থা হত থাকে। রেনাল ক্যাপসুলে পারস্রাবণ প্রক্রিয়া সবসময় অব্যাহত থাকে। পানির অভাবে রক্তরসের গাঢ়তা বাড়লে কিংবা কমে গেলে অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত অ্যালডোস্টেরন (aldosterone) হরমোন মূত্রে সোডিয়াম আয়নের রেচন কমিয়ে পরোক্ষভাবে পানির রেচনও হ্রাস করে।
রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ (Control of Sodium in Blood)
রক্তের প্লাজমায় সোডিয়ামের মাত্রা স্থির রাখতে যে হরমোনটি নিয়ন্ত্রন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে সেটি হচ্ছে অ্যালডোস্টেরন (aldosterone)। এ হরমোনও পানি পুনঃশোষণকে প্রভাবিত করে অ্যালডোস্টেরন ক্ষরিত হয় অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির কর্টেক্স (বহিঃস্থ অঞ্চল থেকে)। রক্তে সোডিয়াম কম হলে অভিস্রবণের মাধ্যমে কম পানি প্রবেশ করে, তাই রক্তের আয়তন কমে যায়। এর ফলে রক্তচাপও হ্রাস পায়। চাপ ও আয়তন হ্রাস পেলে ডিস্টাল বা দূরবর্তী নালি ও অ্যাফারেন্ট ধমনিকার (afferent arteriole) মাঝখানে অবস্থিত জাক্সটাগ্লোমেরুলার কমপ্লেক্স নামে একগুচ্ছ সংবেদী কোষ উদ্দীপ্ত হয় এবং রেনিন (renin) এনজাইম ক্ষরণ করে।
যকৃত থেকে উৎপন্ন ও প্লাজমায় অবস্থিত একধরনের প্রোটিনকে রেনিন সক্রিয় অ্যানজিওটেনসিন (angeotensin) হরমোনে পরিণত করে। ঐ হরমোন অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে অ্যালডোস্টেরন ক্ষরণকে উদ্দীপ্ত করে। অ্যালডোস্টেরন রক্তবাহিত হয়ে বৃক্কের ডিস্টাল প্যাঁচানো নালিকায় পৌছায় এবং নালিকার কোষগুলোতে সোডিয়াম-পটাসিয়াম পাম্প (sodium-potassium pump)-কে উদ্দীপ্ত করে। ফলে দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা থেকে সোডিয়াম আয়ন বেরিয়ে নালিকার চারপাশের কৈশিকজালিকায় প্রবেশ কলে। অন্যদিকে, পটাসিয়াম আয়ন প্রবেশ করে কৈশিকজালিকা থেকে দূরবর্তী প্যাচানো নালিকায়। অ্যালডেস্টেরন অস্ত্রে সোডিয়াম শোষণকে এবং ঘামে কম সোডিয়াম ত্যাগকে উদ্দিীপ্ত করে। এ দুই প্রক্রিয়ার ফলে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। এ কারণে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় রক্তে প্রচুর পানি প্রবেশ করে তাই রক্তের আয়তন ও চাপ উভয়ই বেড়ে যায়।
রক্তের pH নিয়ন্ত্রণ (Control of Blood pH)
পিএইচ (pH) হচ্ছে হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের একটি পরিমাপক। নিরপেক্ষ pH হচ্ছে 7.0, এসিড pH হয় 7-এর নিচে আর ক্ষারীয় pH হছে 7-এর উপরে। কিছু রাসায়নিক পদার্থ দ্রবণে pH-এর পরিবর্তনকে প্রতিহত করতে সক্ষম। এসব পদার্থকে বলে বাফার (buffers)। রক্তের প্লাজমার স্বাভাবিক pH হচ্ছে 7.4। এ মাত্রা যথাসম্ভব বজায় না রাখলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। দেহে ক্ষারের চেয়ে বেশি এসিড বেশি উৎপন্ন হয়। অতএব, এসিডিটি কমানোর বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী।
এসিডিটি বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হচ্ছে কোষীয় শ্বসনে উৎপন্ন CO2। এটি দ্রবীভূত হয়ে H2CO3 (কার্বনিক এসিড) নামে একটি দুর্বল এসিডে পরিণত হয়। এটি ভেঙ্গে H+ ও H2CO3 (হাইড্রোজেন কার্বনেট আয়ন) উৎপন্ন হয়। CO2 এর ঘনত্ব বেশি হয়ে গেলে পরিত্রাণ পেতে প্রতিবর্ত সাড়া হিসেবে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বেড়ে যায় । HCO3– বাফার হিসেবে কাজ করতে পারে কারণ H+ এর ঘনত্ব বেশি হয়ে গেলে এগুলো H2CO3 গঠন করে ।
রক্তে HCO3– ও ফসফেট বাফার অতিরিক্ত H+ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এ কারণে রক্তের pH কমে না। প্লাজমার স্বাভাবিক pH এ যেন পরিবর্তন না ঘটে সে উদ্দেশে নেফ্রনের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা এবং সংগ্রাহী নালি নিম্নোক্ত দু’ভাবে কাজ করে-
- রক্ত অতিএসিডিক হতে শুরু করলে দূরবর্তী নালিকা ও সংগ্রাহী নালির কোষগুলোর সাহায্যে রক্ত থেকে H+ সক্রিয় পরিবহন (active transport)-এর মাধ্যমে নালিকাতে পরিবাহিত হয়। CO2 যদি H+ এর উৎস হয়ে থাকে তাহলে HCO3– ও উৎপন্ন হয়ে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তে ফেরত যাবে । pH বেড়ে গেলে বিপরীত ঘটনা ঘটবে। এসব পরিবর্তনের কারণে মূত্রের pH 4.5-8.5 পর্যন্ত হতে পারে।
- pH কমে গেলেও বৃক্ককোষে অ্যামোনিয়াম বেইস (base) আয়ন (NH4+) সৃষ্টিতে উদ্দীপ্ত হয়। NH+ এসিডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৃক্কে বাহিত হয় এবং অ্যামোনিয়াম লবণ হিসেবে রেচিত হয়।