Hydra, বাংলাদেশে 𝑯𝒚𝒅𝒓𝒂−র বিভিন্ন প্রজাতি, নেমাটোসিস্টের প্রকারভেদ
প্রতীক প্রাণী: Hydra
Hydra হচ্ছে নিডারিয়া (Cnidaria) পর্বভুক্ত সরল গড়নের জলজ প্রাণী। প্রাণীজগতের দুটি পর্ব দ্বিস্তরী বা ডিপ্লোব্লাস্টিক প্রাণী (diploblastic animal) নামে পরিচিত। একটি হচ্ছে নিডারিয়া, অন্যটি টিনোফোরা (Ctenophora)। সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতিবিজ্ঞানি আব্রাহাম ট্রেম্বলে (Abraham Trembley, 1710-1784) ১৭৪৪ সালে হাইড্রার প্রচন্ড পুনরুৎপত্তি ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যমে এর প্রাণীপ্রকৃতিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যার ফলে হাইড্রার ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। এজন্য ট্রেম্বলেকেই হাইড্রার অবিষ্কারক হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৭৫৮ সালে ক্যারোলাস লিনিয়াস (Carolus Linnaeus, 1707-1778) এর নাম দেন Hydra। গ্রিক রূপকথার নয় মাথাওয়ালা ড্রাগনের নামানুসারে Hydra-র নামকরণ করা হয়। ঐ ড্রাগনটির একটি মাথা কাটলে তার বদলে দুই বা তার বেশি মাথা গজাতো। Hydra ঐ ড্রাগনের মতো হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে, তাই অনেক সময় বহু মাথাওয়ালা সদস্য আবির্ভূত হয়। মহাবীর হারকিউলিস (Hercules) অবশেষে এ দানবকে বধ করেন।
বাংলাদেশে 𝑯𝒚𝒅𝒓𝒂−র বিভিন্ন প্রজাতি (Different species of Hydra in Bangladesh)
বর্তমানে পৃথিবীতে 𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎-র প্রজাতি-সংখ্যা ৪০টির মতো। গায়ের রং, কর্ষিকার সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য এবং জননাঙ্গের অবস্থান ও আকৃতির ভিত্তিতে হাইড্রার শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। ২০০৮ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের চতুর্দশ খণ্ডের (Bangladesh Encyclopedia of Flora and Fauna, vol. 14) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির হাইড্রার উল্লেখ পাওয়া যায়: ১. বাদামী বর্ণের 𝑯𝒚𝒅𝒓𝒂 𝒐𝒍𝒊𝒈𝒂𝒄𝒕𝒊𝒔 (=𝑯. 𝒇𝒖𝒔𝒄𝒂), ২. সবুজ বর্ণের 𝑯𝒚𝒅𝒓𝒂 𝒗𝒊𝒓𝒊𝒅𝒊𝒔𝒔𝒊𝒎𝒂 (=𝑯. 𝒗𝒓𝒊𝒅𝒊𝒔, 𝑪𝒉𝒍𝒐𝒓𝒐𝒉𝒚𝒅𝒂 𝒗𝒊𝒓𝒊𝒅𝒊𝒔𝒔𝒊𝒎𝒂) এবং ৩. বর্ণহীন বা হলুদ বাদামী 𝑯𝒚𝒅𝒓𝒂 𝒗𝒖𝒍𝒈𝒂𝒓𝒊𝒔। বিভিন্ন প্রজাতির 𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎-র মধ্যে বাংলাদেশে Hydra vulgaris সুলভ বলে এখানে এ প্রজাতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
বাসস্থান ও স্বভাব (Habitat and temperament):
𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎 একটি একক মুক্তজীবী প্রাণী। মিঠাপানিতে (খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ, ঝর্ণা) নিমজ্জিত কঠিন বস্তু এবং জলজ উদ্ভিদের পাতার নিম্নপৃষ্ঠে সংলগ্ন থেকে নিম্নমুখী হয়ে ঝুলে থাকে। স্থির, শীতল ও পরিষ্কার পানিতে এদের বেশি পাওয়া যায়। ঘোলা, উষ্ণ ও চলমান পানিতে এদের খুব কম পাওয়া যায়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেহ ও কর্ষিকাকে সর্বোচ্চ প্রসারিত করে পানিতে দুলতে থাকে। কোন কিছুর সংস্পর্শে দেহকে সঙ্কুচিত করে ফেলে। এরা মাংসাশী (অর্থাৎ অন্য কোনো প্রাণী খেয়ে জীবন ধারণ করে)। কর্ষিকার সাহায্যে খাদ্য গ্রহণ করে। চলাফেরা করে দেহের সংকোচন-প্রসারণ ও কর্ষিকার সাহায্যে। দেহপ্রাচীরের মাধ্যমে ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ায় শ্বসন ও রেচন সম্পন্ন করে। মুকুলোদগম ও দ্বিবিভাজনের মাধ্যমে অযৌন জনন এবং জননকোষ সৃষ্টির মাধ্যমে যৌন জনন সম্পন্ন করে। 𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎−র পুনরুৎপত্তি (regeneration) ক্ষমতা প্রচন্ড।
শ্রেণিতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic Position)
Kingdom: Animalia (প্রাণী)
Phylum: Cnidaria (নিডোসাইট ও সিলেন্টেরন উপস্থিত)
Class: Hydrozoa (অবিভক্ত সিলেন্টেরন)
Order: Hydroida (পলিপ দশা প্রধান)
Family: Hydridae (এককভাবে বসবাস করে)
Genus: Hydra (পুনরুৎপত্তি ক্ষমতাসম্পন্ন)
Species: Hydra vulgaris
আকার-আকৃতি : Hydra-র দেহ নরম ও অনেকটা নলাকার। দেহের একপ্রান্ত খোলা (ওরাল বা মৌখিক প্রান্ত) এবং অপরপ্রান্ত বন্ধ (অ্যাবওরাল বা বিমৌখিক প্রান্ত)। খোলা প্রান্তে মুখছিদ্র অবস্থিত, আর বন্ধ প্রান্তটি কোনো বস্তুর সাথে যুক্ত থাকে। দেহ অরীয় প্রতিসম (radial symmetry) এবং ১০ থেকে ৩০ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা ও প্রায় ১ মিলিমিটার চওড়া।
বর্ণ : প্রজাতিভেদে Hydra-র বর্ণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। Hydra vulgaris প্রায় বর্ণহীন (হালকা হলুদ-বাদামী) তবে গৃহীত খাদ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী বর্ণ বৈষম্য দেখা যায়।
বহির্গঠন : একটি পরিণত Hydra-র দেহকে প্রধানত তিনটি অংশে ভাগ করা যায়: ১. হাইপোস্টোম, ২. দেহকান্ড ও ৩. পদতল বা পাদ-চাকতি। নিচে এসব অংশের বর্ণনা দেয়া হলো।
১. হাইপোস্টোম (Hypostome) : এটি দেহের মুক্ত প্রান্তে অবস্থিত, মোচাকৃতি, ছোট ও সংকোচন প্রসারণশীল অংশ। এর চূড়ায় বৃত্তাকার মুখছিদ্র অবস্থিত। মুখছিদ্রপথে খাদ্য গৃহীত ও অপাচ্য অংশ বহিষ্কৃত হয়।
২. দেহকান্ড (Trunk) : হাইপোস্টোমের নিচ থেকে পাদ-চাকতির উপর পর্যন্ত সংকোচন-প্রসারণশীল অংশটি দেহকাণ্ড। এতে নিচে বর্ণিত অংশগুলো পাওয়া যায়।
- কর্ষিকা (Tentacle) : হাইপোস্টোমের গোড়ার চতুর্দিক ঘিরে ৬-১০টি সরু, সংকোচনশাল, দেহ অপেক্ষা লম্বা ও ফাঁপা সুতার মতো কর্ষিকা অবস্থিত। কর্ষিকার বহিঃপ্রাচীরে অসংখ্য ছোট টিউমারের মতো নেমাটোসিস্ট ব্যাটারী (nematocyst battery) থাকে। প্রত্যেক ব্যাটারীতে থাকে কয়েকটি করে বিভিন্ন ধরনের নেমাটোসিস্ট। কর্ষিকা ও নেমাটোসিস্ট পারস্পরিক সহযোগিতায় আহার সংগ্রহ, চলন এবং আত্মারক্ষায় অংশ নেয়।
- মুকুল (Bud) : গ্রীষ্মকালে যখন পর্যাপ্ত আহার পাওয়া যায় তখন মুকুল সৃষ্টির অনুকূল সময়। এমন পরিবেশে দেহের প্রায় মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে এক বা একাধিক মুকুল সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক মুকুল একেকটি নতুন সদস্যের জন্ম দেয়। মুকুলোদগম Hydra-র অন্যতম অযৌন জনন প্রক্রিয়া।
- জননাঙ্গ (Gonad): হেমন্ত ও শীতকালে দেহকান্ডের উপরের অর্ধাংশে এক বা একাধিক কোণাকার শুক্রাশয় (testes) এবং নিচের অর্ধাংশে এক বা একাধিক গোলাকার ডিম্বাশয় (ovaries) নামক অস্থায়ী জননাঙ্গ দেখা যায়। জননাঙ্গ যৌন জননে অংশগ্রহণ করে।
৩. পাদ-চাকতি (Pedal disc) : দেহকাণ্ডের নিম্নপ্রান্তে অবস্থিত গোল ও চাপা অংশটি পাদ-চাকতি বা পদতল। পাদ-চাকতি থেকে ক্ষরিত আঠাল রসের সাহায্যে প্রাণী কোনো তলের সাথে লেগে থাকে। এ চাকতি বুদবুদ (bubble) সৃষ্টি করে প্রাণীকে ভাসিয়ে রাখতেও সাহায্য করে। চাকতির ক্ষণপদ গঠনকারী কোষের সাহায্যে গ্লাইডিং চলন সম্পন্ন হয়।
চিত্র : হাইড্রার বহির্গঠন
দ্বিস্তরী বা দ্বিভ্রূণস্তরী প্রাণী (Diploblastic animal)
ভ্রূণাবস্থায় যেসব প্রাণীর দেহপ্রাচীরের কোষগুলো কেবল এক্টোডার্ম ও এন্ডোডার্ম নামক দুটি নির্দিষ্ট স্তরে বিন্যস্ত থাকে, সেগুলোকে দ্বিস্তরী বা বিভ্রূণস্তরী প্রাণী বলে। পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে স্তরদুটি যথাক্রমে এপিডার্মিস ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস এ পরিণত হয়। এই দুই স্তরের মাঝখানে মেসোগ্লিয়া নামক অকোষীয় ও জেলির মতো (কখনও কিছু কোষ ও তন্তুযুক্ত) একটি স্তর থাকে। Hydra দ্বিস্তরী বা ডিপ্লোব্লাস্টিক প্রাণীর এক আদর্শ উদাহরণ।
Hydra-র অন্তর্গঠন (Internal Structure of Hydra)
Hydra দ্বিভ্রূণস্তরী (diploblastic) প্রাণী অর্থাৎ এর ভ্রূণাবস্থার এক্টোডার্ম ও এন্ডোডার্ম কোষীয় স্তরদুটি পরিণত দেহে এপিডার্মিস ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস নামক দুটি কোযস্তরে পরিবর্তিত হয়ে বিন্যস্ত থাকে। এ দুটি কোষস্তরের মাঝে মেসোগ্লিয়া (mesoglea) নামে একটি অকোষীয় জেলির মতো স্তর থাকে। Hydra-র দেহ মূলত দেহপ্রাচীর ও কেন্দ্রীয় পরিপাকসংবহন গহ্বর (gastrovascular cavity) বা সিলেন্টেরন (coelenteron) নিয়ে গঠিত।
Hydra-র দেহপ্রাচীরের কোষসমূহ
(Cells in the body wall of Hydra)
কোষসমূহ | ||
এপিডার্মিস | মেসোগ্লিয়া | গ্যাস্ট্রোডার্মিস |
১. পেশি-আবরণী কোষ
২. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ ৩. সংবেদী কোষ ৪. স্নায়ু কোষ ৫. গ্রন্থি কোষ ৬. জনন কোষ এবং ৭. নিডোসাইট |
কোন কোষস্তর নয়, একে সংযোগকারী স্তর বলা হয়। | ১. পুষ্টি কোষ
২. গ্রন্থি কোষ ৩. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ, ৪. সংবেদী কোষ এবং ৫. স্নায়ু কোষ |
প্রতীক প্রাণী: Hydra
এপিডার্মিস (বা বহিঃত্বক)-এর কোষসমূহ
কাজের ভিন্নতা অনুযায়ী Hydra-র এপিডার্মিসের কোষের গঠনে বৈচিত্র্য দেখা যায়। একটি পাতলা ও নমনীয় কিউটিকল (cuticle)-এ আবৃত এপিডার্মিস Hydra-র বহিরাবরণ গঠন করে। Hydra-র এপিডার্মিস নিচে বর্ণিত সাত ধরণের কোষ নিয়ে গঠিত।
১. পেশি-আবরণী কোষ (Musculo-Epithelial cell): এপিডার্মিসের সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে এ কোষ অবস্থান করে। বহির্মুখী চওড়া ও অন্তর্মূখী সরু প্রান্তবিশিষ্ট এ কোষগুলো দেখতে কোণাকার। এগুলোর চওড়া প্রান্ত গহ্বরযুক্ত সাইটোপ্লাজোম পূর্ণ, মিউকাস-বস্তুযুক্ত এবং পরস্পর মিলিত হয়ে একটি অভিন্ন আবরণ গঠন করে। ভিতরের সরু প্রান্তের শেষে মায়োনিম (এক ধরনের নমনীয় ও সংকোচন-প্রসারণশীল তন্তু) নির্মিত দুটি পেশি-প্রবর্ধন দেহ অক্ষের সমান্তরালে অবস্থান করে। কর্ষিকায় কোষগুলো বেশ বড় ও চাপা এবং কয়েকটি করে নিডোব্লাস্ট (পরিস্ফুটনরত নিডোসাইট) ধারণ করে।
কাজ : আবরণী কোষের মতো দেহাবরণ সৃষ্টি করে দেহকে রক্ষা করে। প্রবর্ধনগুলো সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে দেহের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে পেশির মতো কাজ করে। মিউকাস দানা কিউটিকল ক্ষরণ করে ও দেহ পিচ্ছিল রাখে। কোষগুলো একাধিক নেমাটোসিস্ট বহন করে। একদিকে দেহাবরণ হিসেবে, অন্যদিকে পেশির মতো কাজ করে বলে এসব কোষকে ‘‘পেশি-আবরণী কোষ” বলা হয়ে থাকে
২. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ (Interstitial cell): পেশি-আবরণী কোষের অন্তর্মুখী সরু প্রান্তের ফাঁকে ফাঁকে, গুচ্ছাকারে, মেসোগ্লিয়া ঘেঁষে এসব কোষ অবস্থান করে। এগুলো গোল বা তিনকোণা এবং সুস্পষ্ট নিউক্লিয়াস, মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা, রাইবোজোম ও কিছু মাইটোকন্ড্রিয়া যুক্ত।
কাজ: এসব কোষ প্রয়োজনে অন্য যে কোনো ধরনের বহিঃত্বকীয় কোষে পরিণত হয়। পুনরুৎপত্তি ও মুকুল সৃষ্টিতে অংশ নেয় এবং কিছুদিন পরপর অন্যান্য কোষে পরিণত হয়ে দেহের পুরনো কোষের স্থান পূরণ করে।
৩. সংবেদী কোষ (Sensory cell): এগুলো পেশি-আবরণী কোষের ফাঁকে ফাঁকে, সমকোণে ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে, তবে কর্ষিকা, হাইপোস্টোম ও পদতলের চারদিকে বেশি দেখা যায়। প্রতিটি কোষ লম্বা ও সরু। এর মুক্ত প্রান্ত থেকে সূক্ষ্ম সংবেদী রোম (sensory hair) বেরোয় এবং অপর প্রান্ত থেকে গুটিকাময় বা নোডিওল যুক্ত (nodulated) সূক্ষ্ন তন্তু নির্গত হয়ে স্নায়ুতন্তুর সাথে যুক্ত হয়।
কাজ: পরিবেশ থেকে বিভিন্ন উদ্দীপনা (যেমন আলো, তাপ প্রভৃতি) গ্রহণ করে স্নায়ুকোষে সরবরাহ করে।
৪. স্নায়ু কোষ (Nerve cell): এসব কোষ মেসোগ্লিয়া ঘেঁষে অবস্থিত, অনিয়ত আকারবিশিষ্ট এবং একটি ক্ষুদ্র কোষদেহ ও দুই বা ততোধিক নোডিওলযুক্ত সূক্ষ্ন শাখান্বিত স্নায়ুরোম নিয়ে গঠিত। তন্তুগুলো পরস্পর মিলে স্নায়ু-জালিকা গঠন করে।
কাজ: সংবেদী কোষে সংগৃহীত উদ্দীপনা দেহের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে।
৫. গ্রন্থি কোষ (Gland cell): এগুলো ক্ষরণকারী দানাবিশিষ্ট এক ধরনের পরিবর্তিত লম্বাকার এপিডার্মাল কোষ। মুখছিদ্রের চারদিকে ও পাদ-চাকতিতে প্রচুর গ্রন্থি কোষ দেখা যায়।
কাজ: মিউকাস ক্ষরণ করে দেহকে কোনো বস্তুর সঙ্গে লেগে থাকতে সাহায্য করে; বুদবুদ সৃষ্ট করে ভাসতে সাহায্য করে। ক্ষণপদ সৃষ্টির মাধ্যমে চলনে অংশগ্রহণ করে এবং মুখছিদ্রের গ্রন্থিকোষের ক্ষরণে সাহায্য করে।
৬. জনন কোষ (Germ cell): এসব কোষ জননাঙ্গে অবস্থান করে। জননকোষ দুধরনের: শুক্রাণু ও ডিম্বাণু। পরিণত শুক্রাণু অতি ক্ষুদ্র এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত একটি স্ফীত মস্তক, সেন্ট্রিওলযুক্ত একটি সংকীর্ণ মধ্যখন্ড ও একটি লম্বা বিচলনক্ষম লেজ নিয়ে গঠিত। এর সাথে তিনটি পোলার বডি (polar bodies) যুক্ত থাকে।
কাজ: যৌন জননে অংশগ্রহণ করা।
৭. নিডোসাইট (Cnidocyte): Hydra-র পদতল ছাড়া বহিঃত্বকের সর্বত্র বিশেষ করে কর্ষিকার পেশি-আবরণী কোষের ফাঁকে ফাঁকে বা ঐসব কোষের ভিতরে নিডোসাইট অনুপ্রবিষ্ট থাকে। কোষগুলো গোল, ডিম্বাকার বা পেয়ালাকার এবং নিচের দিকে নিউক্লিয়াসবাহী ও দ্বৈত আবরণবেষ্টিত বড় কোষ। কোষের মুক্তপ্রান্তে ক্ষুদ্র, দৃঢ়, সংবেদী নিডোসিল (cnidocil) এবং অভ্যন্তরে গহবর ও প্যাঁচানো সুতাযুক্ত নেমাটোসিস্ট বহন করে। গহ্বরটি অপারকুলাম (operculum) দিয়ে ঢাকা। আদর্শ নেমাটোনিস্টের সুতার গোড়ায় ৩টি বড় কাঁটার মতো বার্ব (barb) থাকে এবং গহ্বরটি হিপনোটক্সিন (Hypnotoxin) নামক বিষাক্ত রসে পূর্ণ। পরিস্ফুটনরত নিডোসাইটকে নিডোব্লাস্ট (cnidoblast) বলে।
কাজ: নিডোসাইটের নেমাটোসিস্ট অঙ্গাণু প্রাণীর খাদ্য গ্রহণ, চলন ও আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
প্রতীক প্রাণী: Hydra
আদর্শ নিডোসাইটের গঠন (Structure of a typical Cnidocyte)
Hydra-র একটি আদর্শ নিডোসাইট দেখতে গোল, ডিম্বাকার, নাশপাতি আকার, পেয়ালাকার বা লাটিম আকৃতির এবং নিচে বর্ণিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত।
১. আবরণ (Membrane) : প্রতিটি কোষ দ্বিস্তরী আবরণে আবৃত। স্তরদুটির মাঝখানে দানাদার সাইটোপ্লাজম এবং কোষের গোড়ার দিকে একটি নিউক্লিয়াস থাকে।
২. নেমাটোসিস্ট (Nematocyst) : নিডোসাইটের অভ্যন্তরে অবস্থিত, কাইটিনের মতো পদার্থে নির্মিত আবরণে আবৃত ও সুত্রকযুক্ত একটি ক্যাপসুলের নাম নেমাটোসিস্ট। আদর্শ নিডোসাইটে ক্যাপসুলটি প্রোটিন ও ফেনল-এর সমন্বয়ে গঠিত বিষাক্ত তরল হিপনোটক্সিন (Hypnotoxin) এ পূর্ণ থাকে। লম্বা, সরু, ফাঁপা সূত্রকটি যা প্রকৃতপক্ষে ক্যাপসুলেরই অগ্রপ্রান্তের অভিন্ন প্রসারিত অংশ সেটি অবস্থান করে। সূত্রকের চওড়া গোড়াটিকে বাট (butt) বা শ্যাফট (shaft) বলে। এতে তিনটি বড় তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বার্ব (barb) এবং সর্পিল সারিতে বিন্যস্ত ক্ষুদ্রতর কাঁটার মতো অসংখ্য বার্বিওল (barbules) দেখা যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় সূত্রকটি বাট ও কাঁটাসহ থলির ভিতর ঢুকানো থাকে।
৩. অপারকুলাম (Operculum) : স্বাভাবিক অবস্থায় নেমাটোসিস্টের সূত্রক ও ক্যাপসুল যে ঢাকনা দিয়ে আবৃত থাকে তার নাম অপারকুলাম। উন্মুক্ত অবস্থায় এটি পাশে সরে যায়।
৪. নিডোসিল (Cnidocil) : নিডোসাইট কোষের মুক্ত প্রান্তের শক্ত, দৃঢ়, সংবেদনশীল কাঁটাটি নিডোসিল। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি রূপান্তরিত সিলিয়াম (cilium)। নিডোসিল ট্রিগারের মতো কাজ করে ফলে অপারকুলাম সরে যায় এবং প্যাঁচানো সূত্রকটি বাইরে বেরিয়ে আসে।
৫. পেশিতন্তু ও ল্যাসো (Muscle fibre & Lasso) : কোষের সাইটোপ্লাজম ও নেমাটোসিস্টের প্রাচীরে সংকোচনশীল কিছু পেশিতন্তু থাকে। এছাড়াও কোষের নিচের প্রান্তে ল্যাসো নামের একটি প্যাঁচানো সূত্রক দেখা যায়।
নেমাটোসিস্টের প্রকারভেদ (Types of nematocysts)
নিক্ষিপ্ত সূত্রকের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানী ভার্ণার (Werner) ১৯৬৫ সালে নিডারিয়া জাতীয় প্রাণীদের দেহ থেকে ২৩ ধরনের নেমাটোসিস্ট শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে নিম্নোক্ত চার ধরনের নেমাটোসিস্ট Hydra-তে পাওয়া যায়।
চিত্র : বিভিন্ন ধরনের নেমাটোসিস্ট ; ক. স্টিনোস্টিক, খ. ভলভেন্ট,
গ. স্ট্রেপটোলিন গ্লুটিন্যান্ট ও ঘ. স্টেরিওলিন গ্লুটিন্যান্ট
১. স্টিনোটিল বা পেনিট্র্যান্ট (Stenotile or Penetrant) : Hydra-র চার ধরণের নেমাটোসিস্টের মধ্যে এগুলোই বৃহত্তম। এদের সূত্রক লম্বা, ফাঁপা, শীর্ষ উন্মুক্ত, বাট প্রশস্ত এবং তিনটি বড় তীক্ষ্ণ বার্ব ও তিন সারি সর্পিলাকারে সজ্জিত অতি ক্ষুদ্র বার্বিউলযুক্ত। এর ভিতরে হিপনোটক্সিন (hypnotoxin) নামক বিষাক্ত তরল থাকে। শিকারের দেহে সূত্রক বিদ্ধ করে বিষাক্ত হিপনোটক্সিন প্রবেশ করিয়ে তাকে অজ্ঞান ও অবশ করে ফেলে।
২. ভলভেন্ট (Valvent) : এগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। সূত্রকটি খাটো, মোটা, স্থিতিস্থাপক, কাঁটাবিহীন এবং বদ্ধ শীর্ষযুক্ত নেমাটোসিস্ট। ক্যাপসুলের ভিতর সূত্রকের একটি মাত্র প্যাঁচ থাকে, কিন্তু নিক্ষিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে কর্ক-স্ক্রুর মতো অনেকগুলো প্যাঁচের সৃষ্টি করে। এটি শিকার কিংবা কোন বস্তুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে।
৩. স্ট্রেপটোলিন গ্লুটিন্যান্ট (Streptoline glutinant) : এর সূত্রক লম্বা, সর্পিলাকারে সজ্জিত কাঁটাযুক্ত, বাট সুগঠিত নয় এবং শীর্ষদেশ উন্মুক্ত। এগুলো আঠালো রস ক্ষরণ করে চলনে এবং শিকার আটকাতে সাহায্য করে।
৪. স্টেরিওলিন গুটিন্যান্ট (Stereoline glutinant) : এগুলো ক্ষুদ্রতম নেমাটোসিস্ট; সূত্রক লম্বা, কাঁটাবিহীন, বাট সুগঠিত নয় এবং শীর্ষদেশ উন্মুক্ত। এগুলোও এক ধরনের আঠালো রস ক্ষরণ করে চলন ও শিকার আটকে রাখতে সাহায্য করে।
নেমাটোসিস্টের সুত্রক নিক্ষেপের কৌশল
(Mechanism of discharge of Nematocyst-thread)
নেমাটোসিস্টের সুত্রক নিক্ষেপ যুগপৎভাবে একটি রাসায়নিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। শিকারের বা শত্রুর সন্ধান অথবা অন্য যেকোনো কারণে নিডোসাইট উদ্দীপ্ত হলে এ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। কোনো শিকার 𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎-র কর্ষিকার নিকটবর্তী হলে শিকার-দেহের রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে নেমাটোসিস্ট প্রাচীরের পানিভেদ্য ক্ষমতা বেড়ে যায়। এতে থলির ভিতরে দ্রুত পানি প্রবেশ করায় ভিতরের অভিস্রবণিক চাপও বেড়ে যায়। এসময় শিকার নিডোসাইটের নিডোসিল স্পর্শ করামাত্র এর অপারকুলাম খুলে যখন দ্রুত পানি ভিতরে প্রবেশ করায় হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপ (hydrostatic pressure) বেড়ে গেলে নেমাটোসিস্ট-সূত্রক ক্ষিপ্র গতিতে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
নেমাটোসিস্টের সুত্রক নিক্ষেপ যুগপৎভাবে একটি রাসায়নিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। শিকারের বা শত্রুর সন্ধান অথবা অন্য যেকোনো কারণে নিডোসাইট উদ্দীপ্ত হলে এ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। কোনো শিকার 𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎-র কর্ষিকার নিকটবর্তী হলে শিকার-দেহের রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে নেমাটোসিস্ট প্রাচীরের পানিভেদ্য ক্ষমতা বেড়ে যায়। এতে থলির ভিতরে দ্রুত পানি প্রবেশ করায় ভিতরের অভিস্রবণিক চাপও বেড়ে যায়। এসময় শিকার নিডোসাইটের নিডোসিল স্পর্শ করামাত্র এর অপারকুলাম খুলে যখন দ্রুত পানি ভিতরে প্রবেশ করায় হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপ (hydrostatic pressure) বেড়ে গেলে নেমাটোসিস্ট-সূত্রক ক্ষিপ্র গতিতে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
নিডোসাইট ও নেমাটোসিস্টের মধ্যে পার্থক্য | |
নিডোসাইট | নিডোসাইট |
১. নিডারিয়া পর্বভূক্ত প্রাণীদের বহিঃত্বকে যে বিশেষ ধরনের পেয়ালাকার কোষ থাকে, তাকে নিডোসাইট বলে। | ১. নিডোসাইটের স্ফীত অংশের মধ্যে ফাঁপা ও প্যাঁচানো সূত্রকযুক্ত যে একটি গোলাকার বা ডিম্বাকার থলি থাকে, তাকে নেমাটোসিস্ট বলে। |
২. সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াস থাকে। | ২. এগুলো অনুপস্থিত, তবে ‘হিপনোটক্সিন’ নামক এক প্রকার বিষাক্ত রস থাকে। |
৩. নিডোসিল নামক একটি সংবেদনশীল অভিক্ষেপ থাকে। | ৩. কাঁটাযুক্ত বা কাঁটাবিহীন সূত্রক থাকে। |
৪. নেমাটোসিস্ট ধারণ ও সংরক্ষণ এর কাজ। | ৪. খাদ্যগ্রহণ, চলন ও আত্মত্মরক্ষায় সাহায্য করা এর কাজ। |