জিনতত্ত্ব (Genetics)
জীববিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, কাজ, বংশপরম্পরায় সঞ্চারণের ধরণ ও ফলাফল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় তাকে বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স (Genetics) বলে। উইলিয়াম বেটসন (William Bateson, 1861–1926) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম Genetics শব্দ প্রচলন করেন।
গ্রেগর জোহান মেন্ডেল-জিনতত্ত্বের জনক (Gregor Johann Mendel – Father of Genetics)
জিনতত্ত্বের জনক বলে পরিচিত গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪) অস্ট্রিয়াবাসী একজন ধর্মযাজক ছিলেন। দীর্ঘ সাত বছর বিভিন্ন মটরশুটি (Pea) গাছের উপর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি বংশগতির দুটি “সূত্র” প্রবর্তন করেন। তাঁর সূত্রগুলোকে মেন্ডেলের সূত্র বা মেন্ডেলিজম (Mendlelism) বলে আখ্যায়িত করা হয়। মেন্ডেল প্রদত্ত তত্ত্ব বর্তমান জিনতত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
পরীক্ষার জন্য মেন্ডেলের মটরগাছ বেছে নেয়ার কারণ−
বাগানের মটরগাছে (garden pea) নিমোক্ত কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হওয়ায় মেন্ডেল তার পরীক্ষার জন্য মটর গাছকে নমুনা হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।
১. মটরগাছ একবর্ষজীবী হওয়ায় খুবই সহজেই বাগানের জমিতে ও টবে ফলানো যায়।
২. মটরগাছের প্রতিটি জনুর আয়ুষ্কাল অল্প হওয়ায় খুব কম সময়ের মধ্যেই সংকরায়ন পরীক্ষার ফল পাওয়া যায়।
৩. মটরফুল উভলিঙ্গ হওয়ায় সহজেই স্ব-পরাগায়ন ঘটে।
৪. মটরফুল স্ব-পরাগী হওয়ায় বাইরে থেকে আসা অন্য কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সহজে মিশে যেতে পারে না, ফলে বংশপরম্পরায় নির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শুদ্ধ সন্তান-সন্ততি উৎপাদন সম্ভব।
৫. ফুলগুলো আকারে বড় হওয়ায় মটর গাছে খুব সহজেই পরপরাগায়নও ঘটানো সম্ভব হয়।
৬. মটরগাছে সুস্পষ্ট তুলনামূলক বংশগতি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়-এ জন্য মটর গাছের বহু প্রকরণ (varieties) উপস্থিত।
৭. সংকরায়নের ফলে সৃষ্ট বংশধরগুলো উর্বর (fertile) হয়; অর্থাৎ এগুলো জননক্ষম হওয়ায় নিয়মিত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
জিনতত্ত্বে ব্যবহৃত কতকগুলো শব্দের ব্যাখ্যা
(Interpretation of some words used in genetics)
জিনতত্ত্ব সহজভাবে বুঝতে হলে নিমোক্ত শব্দগুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।
১. ফ্যাক্টর (Factor) বা জিন (Gene) : DNA অণুর একটি খন্ডাংশ যা জীবের বংশগতির মৌলিক ভৌত ও কার্ষিক একক এবং বংশ থেকে বংশান্তরে জীবের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
২. লোকাস (Locus) : ক্রোমোজোমে জিনের নির্দিষ্ট স্থান-এর নাম লোকাস। একটি নির্দিষ্ট জিনের অ্যালিলগুলো সমসংস্থ ক্রোমোজোমের একই লোকাসে অবস্থান করে।
৩. অ্যালিল বা অ্যালিলোমর (Allele or Allelomorph) : সমসংস্থ (homologous) ক্রোমোজোম জোড়ের নির্দিষ্ট লোকাসে অবস্থানকারী নির্দিষ্ট জিন-জোড়ার একটিকে অপরটির অ্যালিল বলে। অ্যালিলদুটি একই ধর্মী (যেমন—TT) অথবা একে অপরের বিপরীত ধর্মী (যেমন—Tt) হতে পারে। যখন দুটি বিপরীতধর্মী অ্যালিল থাকে তখন একটিকে প্রকট অ্যালিল (অর্থাৎ T), অন্যটিকে প্রচ্ছন্ন অ্যালিল (t) বলে।
৪. হোমোজাইগাস (Homozygous) : কোনো জীবে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী অ্যালিলদুটি সমপ্রকৃতির হলে, তাকে হোমোজাইগাস বলে। যেমন-BB= কালো পশম, bb= বাদামী পশম ইত্যাদি।
৫. হেটারোজাইগাস (Heterozygous) : কোনো জীবে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী অ্যালিলদুটি অসমপ্রকৃতির হলে, তাকে হেটারোজাইগাস জীব বলে। যেমন T এবং t অর্থাৎ Tt-ধারী জীবটি লম্বা হলেও তা হেটারোজাইগাস।
৬. প্রকট বৈশিষ্ট্য (Dominant character) : একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হোমোজাইগাস জীবে (TT এবং tt) সংকরায়ন ঘটালে F1 জনুতে সৃষ্ট হেটারোজাইগাস জীবে যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, তাকে প্রকট বৈশিষ্ট্য বলে। যেমন: \mathbf{F}_{\mathbf{1}} জনুর মটরগাছে লম্বা ও খাটো উভয় ধরনের লক্ষণের জন্যে একটি করে জিন থাকলেও (Tt) শুধুমাত্র লম্বা বৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত হয়। অতএব মটরগাছে লম্বা বৈশিষ্ট্যটি প্রকট।
৭. প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য (Recessive character) : হেটারোজাইগাস জীবে দুটি বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের উপাদান একত্রে থাকলেও একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়, অন্যটি অপ্রকাশিত থাকে। জীবের অপ্রকাশিত বৈশিষ্ট্যকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে। যেমন- \mathbf{F}_{\mathbf{1}} জনুর মটরগাছে লম্বা ও খাটো উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি করে জিন থাকলেও (Tt) শুধুমাত্র লম্বা বৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত হয়। অতএব মটরগাছে খাটো বৈশিষ্ট্যটি প্রচ্ছন্ন।
৮. ফিনোটাইপ (Phenotype) : জিনোটাইপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবের বাহ্যিক লক্ষণকে ফিনোটাইপ বলে। এটি জীবের আকার, আকৃতি, বর্ণ প্রভৃতি প্রকাশ করে। সদৃশ ফিনোটাইপধারী দুটি জীবের জিনোটাইপ একই রকম বা ভিন্ন হতে পারে। যেমন-বিশুদ্ধ লক্ষণযুক্ত লম্বা ও খাটো মটর গাছের মধ্যে পরাগসংযোগ ঘটালে \mathbf{F}_{\mathbf{1}} জনুতে সবগুলো উদ্ভিদই লম্বা আকৃতির হয় যদিও এদের মধ্যে দুধরনের ফ্যাকটরই (Tt) থাকে। এখানে ফিনোটাইপ হলো লম্বা।
৯. জিনোটাইপ (Genotype) : কোনো জীবের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণকারী জিন যুগলের গঠনকে জিনোটাইপ বলে। একটি জীবের জিনোটাইপ তার পূর্ব বা উত্তর পুরুষ থেকে জানা যায়। সদৃশ জিনোটাইপধারী জীবেরা যদি একই পরিবেশে বাস করে তাহলে ওদের ফিনোটাইপও সদৃশ হবে। একটি লম্বা গাছের জিনোটাইপ হতে পারে TT বা Tt আর খাটো গাছের জিনোটাইপ হবে tt।
১০. প্যারেন্টাল জেনারেশন ও অপত্য বংশ (Parental generation & Filial generation) : কোন ক্রসে ব্যবহৃত পিতা-মাতাকে “প্যারেন্টাল জেনারেশন” বা P_{1} এবং উৎপন্ন সন্তান-সন্ততিকে প্রথম অপত্য বংশ বা\mathbf{F}_{\mathbf{1}} জনু বলে। আবার \mathbf{F}_{\mathbf{1}} সন্তান-সন্ততির মধ্যে ক্রস করলে উৎপন্ন সন্তান-সন্ততিকে দ্বিতীয় অপত্য বংশ বা \mathbf{F}_{\mathbf{1}} জনু বলে।
১১. একসংকর বা মনোহাইব্রিড ক্রস (Monohybrid cross) : জীবের একজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের উপর দৃষ্টি রেখে যে সংকরায়ন বা ক্রস ঘটানো হয়, তাকে একসংকর ক্রস বা মনোহাইব্রিড ক্রস বলে। যেমন-কালো ও বাদামী বর্ণের গিনিপিগের মধ্যে ক্রস। মনোহাইব্রিড ক্রসে ২য় বংশধরে (\mathbf{F}_{\mathbf{2}} জনু) প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যের অনুপাত সাধারণত ৩ : ১ হয়। মেন্ডেল তাঁর প্রথম সূত্রটি একসংকর ক্রসের উপর ভিত্তি করেই প্রণয়ন করেছিলেন।
১২. দ্বিসংকর বা ডাইহাইব্রিড ক্রস (Dihybrid cross) : জীবের দুজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের উপর দৃষ্টি রেখে সংকরায়ন বা ক্রস। যেমন: কালোবৰ্ণ-ছোট লোমধারী ও বাদামীবর্ণ-লোমযুক্ত গিনিপিগের ক্রস। ডাইহাইব্রিড ক্রসে ২য় বংশধরে (\mathbf{F}_{\mathbf{2}} জনু) জিনের স্বাধীন সঞ্চারণের ফলে সাধারণত ৯ : ৩ : ৩ : ১ অনুপাতে চার ধরনের বৈশিষ্ট্যসমন্বিত সন্ততি পাওয়া যায়।
১৩. টেস্ট ক্রস (Test cross) : \mathbf{F}_{\mathbf{1}} বা F2 জনুর বংশধরগুলো হোমোজাইগাস না হেটারোজাইগাস তা জানার জন্য সেগুলোকে মাতৃবংশের বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন লক্ষণবিশিষ্ট জীবের সাথে সংকরায়ন বা ক্রস। এভাবে এদের \mathbf{F}_{\mathbf{1}} এবং \mathbf{F}_{\mathbf{2}} জনুর জিনোটাইপ বের করা যায়। যেমন-সংকর লম্বা মটরগাছ (Tt) এবং বিশুদ্ধ খাটো মটরগাছ (tt) এর সংকরায়ন ঘটালে এদের ফিনোটাইপিক এবং জিনোটাইপিক অনুপাত হবে ১ : ১।
১৪. ব্যাক ক্রস (Back cross) : \mathbf{F}_{\mathbf{1}} জনুর একটি হেটারোজাইগাস জীবের সাথে পিতৃ-মাতৃবংশীয় এক সদস্যের সঙ্গে সংকরায়ন।
১৫. জিনোম (Genome) : জীবের একটি জননকোষের ক্রোমোজামে বিদ্যমান জিনের সমষ্টি।