অণুজীব ও ভাইরাস
অণুজীব (Microbe/Micro-Organism)
অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Microscope) এর সাহায্যে যে ‘জীব’ কে দেখতে হয়, সেই ক্ষুদ্র জীবদের অণুজীব বলে।
ভাইরাস (Virus)
ভাইরাস অকোষীয়। অর্থাৎ এতে কোনো কোষ নেই। শুধুমাত্র নিউক্লিক এসিড (DNA অথবা RNA-এর একটি) এবং প্রোটিন দিয়ে ভাইরাস গঠিত।
আবিষ্কার:
- বিজ্ঞানী Edward Jenner (এডওয়ার্ড জেনার) ১৭৯৬ সালে প্রথম ভাইরাসঘটিত বসন্ত রোগের কথা উল্লেখ করেন।
- Adolf Mayer ১৮৮৬ সালে তামাক গাছের পাতার ছোপ ছোপ দাগবিশিষ্ট রোগকে টোবাকো মোজাইক রোগ হিসেবে উল্লেখ করেন।
- পরে ১৮৯২ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী Dmitri Ivanovsky (দিমিত্রি আইভানোভসকি) প্রমাণ করেন যে, রোগাক্রান্ত তামাক পাতার রস ব্যাকটেরিয়ারোধক ফিল্টার দিয়ে ফিল্টার করার পরও সুস্থ তামাক গাছে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
- তারও পরে ১৮৯৮ সালে আরেক হল্যান্ড বিজ্ঞানী Martinus Beijerinck (মার্টিনাস বিজারিঙ্ক) তামাকের মোজাইক রোগের ভাইরাসকে টোবাকো মোজাইক ভাইরাস বা TMV হিসেবে উল্লেখ করেন।
- Walter Reed (ওয়াল্টার রিড) ১৯০১ সালে সর্বপ্রথম মানবদেহের পীত জ্বর (yellow fever) সৃষ্টিকারী ভাইরাস আবিষ্কার করেন।
- ১৯৩৫ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী Wendel Meredith Stanley TMV কে পৃথক করে কেলাসিত করেন, যে কারণে তিনি ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ।
- Stanley মোজাইক আক্রান্ত ১ টন তামাক পাতা থেকে মাত্র এক চামুচ পরিমাণ ভাইরাস কৃস্টাল সংগ্রহ করেন।
- ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ডের দুজন বিজ্ঞানী F. C. Bawden (ব্যাডেন) এবং N. W. Pirie (পিরি) বলেন যে, TMV নিউক্লিক অ্যাসিড এবং প্রোটিন দিয়ে গঠিত।
- ১৯৫১ সালে R. S. Shafferman (শেফারম্যান) এবং M. E. Morris (মরিস) নীলাভ-সবুজ শৈবাল (সায়ানোব্যাকটেরিয়া) ধ্বংসকারী ভাইরাস সায়ানোফায আবিষ্কার করেন।
- A. M. Lwoff ১৯৫২ সালে ভাইরাসের প্রকৃতি সম্বন্ধে বলেছেন, ভাইরাস ভাইরাসই। এটি জীবীয় বস্তুও
নয়, আবার জড় রাসায়নিক বস্তুও নয়। জীবীয় ও জড় বস্তুর মধ্যবর্তী পর্যায়ের কোনো একটি কিছু। - ১৯৮৪ সালে Gallow (গ্যালো) মানুষের মরণব্যাধি এইডস রোগের ভাইরাস HIV আবিষ্কার করেন।
- ১৯৮৯ সালে Hervey J. Alter (হারভে জে. অল্টার) মানুষের নীরব ঘাতকব্যাধি হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস আবিষ্কার করেন।
- F. C. Bawden এবং N. W. Pirie ভাইরাসের রাসায়নিক প্রকৃতি বর্ণনা করেন। ২০১৯ সালের শেষ দিকে নভেল করোনা ভাইরাস আবিষ্কার হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ ধরনের ভাইরাসের বর্ণনা করা হয়েছে।
ভাইরাসের ভৌত গঠন (The physical structure of the virus):
১। কেন্দ্রে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বস্তু তথা নিউক্লিক অ্যাসিড যা DNA অথবা RNA দিয়ে গঠিত (একসাথে উভয়টি নয়)।
২। কেন্দ্রীয় বস্তুকে ঘিরে অবস্থিত ক্যাপসিড তথা প্রোটিন আবরণ। ক্যাপসিডের প্রোটিন অণুর বিন্যাসই ভাইরাসের আকার-আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। প্রোটিন অণু সজ্জিত হয়ে দণ্ডাকৃতির হেলিক্স এবং গোলাকৃতির পলিহেড্রন কাঠামো গঠন করে। ক্যাপসিড কতগুলো সাবইউনিট নিয়ে গঠিত। সাবইউনিটকে বলা হয় ক্যাপসোমিয়ার (capsomere)। ক্যাপসোমিয়ারের সংখ্যা ও ধরন বিভিন্ন প্রকার ভাইরাসে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ক্যাপসিডের বহিঃস্থ আবরণ মসৃণ, কখনো কণ্টকিতও হতে পারে।
৩। কোনো কোনো ভাইরাসে ক্যাপসিডের বাইরে ক্যাপসিডকে ঘিরে অপর একটি আবরণ থাকে।
ভাইরাসের রাসায়নিক গঠন (The chemical structure of the virus):
রাসায়নিকভাবে ভাইরাস প্রধানত দুই প্রকার বস্তু দিয়ে গঠিত; যথা : নিউক্লিক অ্যাসিড (কেন্দ্রীয় বস্তু) এবং প্রোটিন (ক্যাপসিড)।
১। নিউক্লিক অ্যাসিড (কেন্দ্রীয় বস্তু) : ভাইরাসের কেন্দ্রে অবস্থিত নিউক্লিক অ্যাসিড। নির্দিষ্ট ভাইরাসে নিউক্লিক এসিড DNA অথবা RNA এর যেকোনো এক ধরনের হয়। কখনো একই সাথে DNA ও RNA অবস্থান করে না । অন্যান্য জীবদেহে একই সাথে DNA ও RNA অবস্থান করে। সাধারণত অধিকাংশ উদ্ভিদ ভাইরাসে RNA এবং অধিকাংশ প্রাণী ভাইরাসে DNA থাকে।
১। নিউক্লিক অ্যাসিড (কেন্দ্রীয় বস্তু) : ভাইরাসের কেন্দ্রে অবস্থিত নিউক্লিক অ্যাসিড। নির্দিষ্ট ভাইরাসে নিউক্লিক এসিড DNA অথবা RNA এর যে কোনো এক ধরনের হয়। কখনো একই সাথে DNA ও RNA অবস্থান করে না । অন্যান্য জীবদেহে একই সাথে DNA ও RNA অবস্থান করে। সাধারণত অধিকাংশ উদ্ভিদ ভাইরাসে RNA এবং অধিকাংশ প্রাণী ভাইরাসে DNA থাকে।
৩। বহিস্থ আবরণ : কোনো কোনো ভাইরাসে (যেমন-ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, হার্পিস ভাইরাস, HIV ইত্যাদি) ক্যাপসিডের বাইরে জৈব পদার্থের একটি আবরণ থাকে। এটি রাসায়নিকভাবে সাধারণত লিপিড, লিপোপ্রোটিন, শর্করা বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ দিয়ে গঠিত। লিপিড বা লিপোপ্রোটিন স্তরের একককে পেপলোমিয়ার বলা হয়। লিপোপ্রোটিন আবরণবিশিষ্ট ভাইরাসকে লিপোভাইরাস বলা হয়।
কতিপয় ভাইরাসের গঠন
(The structure of certain viruses)
১. টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (Tobacco Mosaic Virus)
গঠন:
এটি দণ্ডাকৃতির ভাইরাস। এটির দৈর্ঘ্য প্রস্থের প্রায় ১৭ গুণ। TMV এর দৈর্ঘ্য ২৮০ nm-৩০০ nm এবং প্রস্থ ১৫ nm-১৮ nm। RNA এবং প্রোটিন দিয়ে TMV গঠিত। এর বাইরে একটি পুরু প্রোটিন আবরণ আছে। প্রোটিন আবরণকে ক্যাপসিড বলে।
ক্যাপসিড বহু উপ-একক দ্বারা গঠিত। উপ একককে ক্যাপসোমিয়ার বলে। ক্যাপসোমিয়ার কতগুলো আঙ্গুরের থোকার ন্যায় পরপর সজ্জিত থাকে। TMV-তে প্রায় ২১৩০-২২০০টি ক্যাপসোমিয়ার থাকে। প্রতিটি ক্যাপসোমিয়ারে ১৫৮টি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে।
ক্যাপসিডের অভ্যন্তরে একসূত্ৰক RNA কোর (core) আছে। RNA সূত্রটি ৬৫০০টি নিউক্লিয়োটাইড দ্বারা গঠিত। ওজন হিসেবে এর শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগই প্রোটিন। TMV এর আণবিক ওজন ৩৭ মিলিয়ন ডাল্টন এবং RNA এর আণবিক ওজন ২.৪ মিলিয়ন ডাল্টন। প্রত্যেকটি প্রোটিন সাবইউনিটের আণবিক ওজন ১৭০০০ ডাল্টন।
২। T_{2} ব্যাকটেরিওফায
গঠন: এটি একটি সর্বাধিক পরিচিত ভাইরাস। এর গঠন সমন্ধেও অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে জানা গেছে। ভাইরাসের দেহকে দুটি প্রধান অংশে ভাগ করা চলে, যথা : মাথা এবং লেজ।
মাথা (Head):
মাথাটি স্ফীত ও ষড়ভুজাকৃতির প্রিজমের ন্যায় এবং প্রোটিন অণু দিয়ে তৈরি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৩-১০০nm এবং প্রস্থ ৬৫nm। থলি আকৃতির এ স্ফীত অংশের ভেতরে রিং আকৃতির দ্বি-সূত্রক একটি DNA অণু পেঁচানো অবস্থায় থাকে। ৬০,০০০ জোড়া নিউক্লিয়োটাইড দিয়ে এই DNA গঠিত। এতে প্রায় ১৫০টি জিন থাকে। মাথার অধিকাংশ স্থানই ফাঁপা বলে মনে হয়। T_{2} ফাযের DNA দ্বিসূত্রক এবং মোট ওজনের প্রায় ৫০%।
লেজ (Tail):
মাথার পেছনে সরু অংশটির নাম লেজ। লেজটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫-১১০ nm এবং ব্যাস প্রায় ১৫-২৫ nm । লেজের উপরিভাগে সুস্পষ্ট চাকতির মতো একটি কলার আছে এবং লেজের প্রধান অংশটি একটি ফাঁপা নলের মতো। এর অভ্যন্তরে কোনো DNA নেই। নিচের দিকে ১টি বেসপ্লেট, কাঁটার মতো কয়েকটি স্পাইক এবং ছয়টি স্পর্শক তন্তু আছে। লেজ, কলার, বেসপ্লেট, স্পাইক এবং স্পর্শক তন্তু সবই প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এতে নিউক্লিয়াস, কোষঝিল্লি, সাইটোপ্লাজম, কোষ প্রাচীর ও অন্য কোনো ক্ষুদ্রাঙ্গ ইত্যাদি নেই।
ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি:
ভাইরাসের যেহেতু কোষ নেই, তাই এর দৈহিক বৃদ্ধি হয় না। ভাইরাসের গাঠনিক উপাদান গুলো তৈরি হয়। পরে সেসব একত্রিত হয়ে নতুন ভাইরাস তৈরি হয়।
ব্যাকটেরিওফায – এর সংখ্যাবৃদ্ধি দুইভাবে ঘটে থাকে। যথা-
১. লাইটিক চক্র
২. লাইসোজেনিক চক্র