প্ল্যাঙ্ক-এর কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব (Planck’s black body radiation and Quantum Theory)
প্ল্যাঙ্ক-এর কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ (Planck’s black body radiation)
আমরা জানি তাপমাত্রার কারণে কোনো বস্তু থেকে বিকিরণ নিঃসৃত হয়। তাপ বিকিরণের বৈশিষ্ট্য বস্তুর ধর্ম ও তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। একটি আদর্শ কৃষ্ণ বস্তু সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপশক্তি শোষণ করতে পারে। আবার যথাযথ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপশক্তি বিকিরণ করতে পারে। a দিয়ে যদি বস্তুটিতে আপতিত বিকিরণের শোষিত অংশ, r দিয়ে প্রতিফলিত অংশ এবং t দিয়ে যদি সঞ্চালিত অংশ বোঝায় তাহলে সাধারণ বস্তুর বেলায় a+r+t=1 হয়।
কিন্তু আদর্শ কৃষ্ণ বস্তুর বেলায় কোনো বিকিরণ প্রতিফলিত ও সঞ্চালিত হয় না। এক্ষেত্রে r = 0 এবং t = 0 এবং a = 1 হয়। কালো বস্তুর শোষণ ক্ষমতা 1 অর্থাৎ কৃষ্ণ বা কালো বস্তু আপতিত বিকিরণের সম্পুন্নটাই শোষণ করে। এটিই কৃষ্ণ ও বাস্তব বিকিরণের প্রধান পার্থক্য।
চিত্রতে তিনটি তাপমাত্রার জন্য একটি কৃষ্ণ কস্তুর বিকিরণের বিকীর্ণ শক্তি বনাম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেখচিত্র দেখান হয়েছে। লেখচিত্র হতে দেখা যায় যে,
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে কৃষ্ণ বস্তু হতে মোট বিকীর্ণ শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং
- যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তি বিকীর্ণ হয় তা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে হ্রাস পায়।
নিম্ন তাপমাত্রায় তাপ সকল বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অবলোহিত (Infrared) অঞ্চলে থাকে বলে এই বিকিরণ চোখে দেখা যায় না। বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে লাল রং এর আভা ক্রমশ সাদা রং ধারণ করে। তাপ বিকিরণের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায় যে, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বণ্টন বর্ণালির অবলোহিত রেখা অঞ্চল হতে অতিবেগুনি রেখা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কৃষ্ণ কায়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে কৃষ্ণকায়া কর্তৃক নিঃসৃত মোট শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তি বিকীর্ণ হয় তা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে হ্রাস পায়।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব বা সূত্র দ্বারা কৃষ্ণ বস্তুর বর্ণালির সকল পরিসরের শক্তি বণ্টন ব্যাখ্যা করা যায় না। কৃষ্ণ বস্তুর ব্যাখ্যা প্রদান করার জন্য 1900 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির বিখ্যাত পদার্থবিদ প্লাঙ্ক (Planck) কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের মতবাদ (black body radiation) প্রতিষ্ঠা করেন। এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা লাভের পর পদার্থবিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সৃষ্টি হয়। ভিয়েন-এর শক্তি বণ্টন সূত্রের সাহায্যে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের শক্তি বণ্টন নির্ণয় করা যায়।
আবার র্যালেজিন্স -এর শক্তি বণ্টন সূত্রের সাহায্যে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের শক্তি বণ্টন ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু আদর্শ কৃষ্ণ বস্তু ক্ষুদ্র ও দীর্ঘ অর্থাৎ সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ নিঃসরণ করে। সুতরাং উপরোল্লেখিত সূত্র দুটি দ্বারা কৃষ্ণ বস্তুর বর্ণালির সকল পরিসরের শক্তি বণ্টন ব্যাখ্যা করা যায় না। কৃষ্ণ বস্তুর বর্ণালির সকল পরিসরের শক্তি বণ্টন ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানী প্ল্যাঙ্ক একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। প্ল্যাঙ্ক এর প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্বকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা তেজকণাবাদ (quantum theory) বলে ।
প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব (Planck’s quantum theory)
প্ল্যাঙ্কের অভিমত অনুসারে কোনো বস্তু হতে শক্তির বিকরণ বা বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে শক্তির বিনিময় নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ধারাবাহিক নাই। শক্তির নিঃসরণ বিচ্ছিন্নভাবে খণ্ড খণ্ড আকারে বা এক একটি গুচ্ছে বা প্যাকেটে নির্গত বা শোষিত হয়। প্রত্যেকটি শক্তিকণা বা শক্তিগুচ্ছ এক একটি অবিভাজ্য একক। শক্তির এই অবিভাজ্য এককের নাম কোয়ান্টাম বা ফোটন। এই কোয়ান্টাম বা ফোটনকে শক্তির পরমাণু (atoms of energy) বলে। যদি কোয়ান্টাম বা ফোটনের কম্পাঙ্ক \vartheta এবং প্ল্যাঙ্ক-এর ধুবক h হয় তবে প্রতিটি ফোটনে শক্তির পরিমাণ,
E = h \varthetaকিন্তু যদি n সংখ্যক ফোটন একসাথে নির্গত বা শোষিত হয়, তবে মোট শক্তির পরিমাণ = nh \vartheta
এখানে n= 0, 1, 2, … ইত্যাদি। এটাই প্ল্যাঙ্ক-এর বিকিরণ সূত্র। প্ল্যাঙ্ক-এর ধ্রুবক h=6.63 \times 10^{-34} জুল সে.। প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মাত্রা [h]=\mathrm{ML}^{-2} \mathrm{~T}^{-2} \mathrm{~s}^{-1}; বিকিরণের এই তত্ত্ব কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা তেজকণা তত্ত্ব (Quantum theory) নামে পরিচিত।