নিউক্লিয়াসের গঠন (Structure of nucleus)
1911 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড এবং তাঁর সহযোগী গাইগার ও মার্সডেন আলফা কণার বিক্ষেপণ হতে আবিষ্কার করেন যে পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্রে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে একটি ঘন জমাট ভারী গোলাকার বস্তু পিণ্ড রয়েছে। এর নাম নিউক্লিয়াস। পরমাণুর আকারের (ব্যাস প্রায় 10^{-8} cm) তুলনায় নিউক্লিয়াসের আকার (ব্যাস প্রায় 10^{-12} cm) অত্যন্ত ক্ষুদ্র। বিটা রশ্মির বর্ণালি হতে নিউক্লিয়াসে আরও একটি কণার অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এর নাম নিউট্রিনো (Neutrino), এটি চার্জ নিরপেক্ষ ভরহীন কণা। মহাজাগতিক রশ্মির (Cosmic ray) গবেষণা হতে জানা যায় নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে আরও একটি মৌলিক কণা রয়েছে। এর নাম মেসন (Meson)।
ইলেকট্রনের ভর 9.1 \times 10^{-31} kg, চার্জ 1.6 \times 10^{-19} C; প্রোটনের ভর 1.672 \times10^{-27} kg, চার্জ 1.6 \times 10^{-19} C; নিউট্রনের ভর 1.675 \times 10^{-27} kg বা 1.675 \times 10^{-24} g যা ইলেকট্রনের ভরের 1839 গুণ।
নিউক্লিয়াসের সংকেত : নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটনের সংখ্যাকে পারমাণবিক সংখ্যা (Z) এবং প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে ভর সংখ্যা (A) বলে। A এবং Z এর বিয়োগফলই নিউট্রন সংখ্যা (N)। অর্থাৎ N=A–z।
একটি নিউক্লিয়াসকে সাধারণত \underset{\mathrm{Z}}{\mathrm{A}} \mathrm{X} রূপে প্রকাশ করা হয়। যেমন ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে \begin{array}{r} 235 \\ 92 \end{array}U রূপে লেখা হয়। এক্ষেত্রে 235 হলো ভর সংখ্যা (A) এবং 92 হলো পারমাণবিক সংখ্যা (Z)।
আর, A-Z=235-92=143
= N = নিউট্রন সংখ্যা।
নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ : নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ এর ভর সংখ্যার ওপর নির্ভর করে। বিভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ ভিন্ন। একটি নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ R নিম্নলিখিত সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা যায়।
\mathrm{R}=\mathrm{r}_{0} \mathrm{~A}^{1 / 3}
এখানে, \mathrm{r}_{0}= ধ্রুব সংখ্যা, A= ভর সংখ্যা। যেহেতু নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ এর ভর সংখ্যার ওপর নির্ভর করে, তাই বিভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধও বিভিন্ন হবে।
\mathrm{r}_{0} এর মান প্রায় 12 \times 10^{-15} \mathrm{~m} \mid 10^{-15} \mathrm{~m}=1 ফেমটোমিটার (fm)।
নিউক্লিয়াসের আয়তন ও ঘনত্ব : নিউক্লিয়াসের আয়তন, V=\frac{4}{3} \pi R^{3}
=\frac{4}{3} \pi r_{0}{ }^{3} \mathrm{~A} \quad\left[\mathrm{R}=\mathrm{r}_{0} \mathrm{~A}^{1 / 3}\right]অতএব, নিউক্লিয়াসের আয়তন পৃথকভাবে নিউট্রন বা প্রোটন সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না; নিউক্লিয়াসের মোট সংখ্যার ওপর নির্ভর করে।
আবার, প্রোটনের ভর = নিউট্রনের ভর = m ধরলে,
নিউক্লিয়াসের ভর = Am, এখানে A = নিউক্লিয়াসের ভরসংখ্যা
∴ নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব, \rho_{\mathrm{N}}=\frac{\mathrm{Am}}{\frac{4}{3} \pi \mathrm{r}_{0}{ }^{3} \mathrm{~A}}=\frac{3 \mathrm{~m}}{4 \pi \mathrm{r}_{0}{ }^{3}}
এই রাশিমালায় A অনুপস্থিত; সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব সকল মৌলের নিউক্লিয়াসের ক্ষেত্রে সমান।
প্রোটন-নিউট্রন তত্ত্ব (Proton-neutron theory)
1932 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী চ্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করেন।
কোনো একটি নিউক্লিয়াসকে দুটি সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একটি হলো ভর সংখ্যা A এবং অপরটি হলো পারমাণবিক সংখ্যা Z। সমগ্র পরমাণুর গঠনসম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মত এই যে A ভর সংখ্যা এবং Z পারমাণবিক সংখ্যার পরে নিউক্লিয়াসে Z সংখ্যক প্রোটন, (A–Z)=N সংখ্যক নিউট্রন এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে Z সংখ্যক ইলেকট্রন থাকবে। যেমন হিলিয়াম নিউক্লিয়াসকে { }_{2}^{4} \mathrm{He} দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এখানে A=4, Z=2। অতএব, এর নিউক্লিয়াসে 2টি প্রোটন (4-2)=2 টি নিউট্রন এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে 2টি ইলেকট্রন থাকবে।
প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তায় বিটা কণা অর্থাৎ ইলেকট্রন নির্গমন এবং প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তায় পজিট্রন (ধনাত্বকচার্জ যুক্ত ইলেকট্রন বা অ্যান্টি ইলেকট্রন) নির্গমনের নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা দেয়া যায়। ইলেকট্রন প্রকৃতপক্ষে নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে না, কিন্তু নিউট্রন রূপান্তরিত হয়ে প্রোটনে পরিণত হওয়ার সময় ইলেকট্রন নির্গত হয়।
n \rightarrow p^{+}+e^{-}আবার প্রোটন যদি রূপান্তরিত হয়ে নিউট্রনে পরিণত হয় তখন পজিট্রন নির্গত হয়।
p^{+} \rightarrow n+e^{-}নিউক্লিয়াসের গঠন সম্পর্কে প্রোটন-নিউট্রন তত্ত্বের সাহায্যে পরমাণু ও নিউক্লিয়াসের অনেক জটিল সমস্যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউট্রন ভেঙ্গে প্রোটন ও ইলেকট্রনে পরিণত হয়।
ইলেকট্রন বিটা রশ্মি হিসেবে নির্গত হয়। আবার পাউলির মতবাদ অনুসারে এর সঙ্গে নিউট্রনো নামক আর একটি কণা নির্গত হয়।
n \rightarrow p^{+}+e^{-} নিউট্রিনো
নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। যেহেতু নিউট্রনগুলি চার্জহীন প্রোটন ধনাত্মক চার্জধর্মী হওয়া সত্ত্বেও প্রোটন-প্রোটন বিকর্ষণ করে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে না কেন ?
নিউক্লিয়াসে প্রোটন ধনাত্মক চার্জগ্রস্ত এবং নিউট্রন চার্জহীন হওয়ায় এক্ষেত্রে প্রোটন-প্রোটন বিকর্ষণ বল অর্থাৎ কুলম্ব বল ক্রিয়া করে। অপরদিকে নিউক্লিয়াসে নিউক্লীয় উপাদান তথা নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রে আবদ্ধ রাখতে নিউক্লীয় বল কার্যকর হয়। এই নিউক্লীয় বলের মান কুলম্ব বলের তুলনায় বেশি হওয়ায় প্রোটন-প্রোটন বিকর্ষণ বলের ক্রিয়াকে নাকচ করে দেয়। তাই নিউক্লিয়াস থেকে প্রোটন বেরিয়ে আসতে পারে না।
নিউক্লীয় বল (Nuclear force)
নিউক্লিয়নগুলোর (প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর) মধ্যে একটি শক্তিশালী আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে। এক ধরনের আন্তঃক্রিয়ার জন্যই এই মধ্যে ক্রিয়ারত এই বলের উদ্ভব হয়।
নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্বের জন্য নিউক্লিওনগুলোর মধ্যে যে আকর্ষণধর্মী বল ক্রিয়া করে তাকে নিউক্লীয় বল বলে।
কুলম্বীয় বা মহাকর্ষ বল অপেক্ষা এই বল ভিন্নতর। এই বল আধান নিরপেক্ষ; শুধুই আকর্ষণ বল। এই বল শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসের ভেতরে পরপর থেকে খুব কম দূরত্বের মধ্যে (r<2 \times 10^{-15} m) ক্রিয়াশীল। 10^{-14} m অপেক্ষা বেশি দূরত্বের এই বলের মান শূন্য হয়।
নিউক্লীয় বলের বৈশিষ্ট্য
নিউক্লীয় বলের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে—
১। এই বল অত্যন্ত তীব্র। অন্য সকল ধরনের বলের চেয়ে এর তীব্রতা অনেক বেশি।
২। এটি শুধুই আকর্ষণ বল।
৩। এই বল আধান নিরপেক্ষ। অর্থাৎ একই দূরত্বে প্রোটন-প্রোটন, প্রোটন-নিউট্রন বা নিউট্রন-নিউট্রন বলগুলির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
৪। এটি খুবই স্বল্প পাল্লার বল। এই পাল্লা মাত্র 10^{-14} m (প্রায়)। এই বল দ্বারা নিউক্লিয়নগুলি কেবলমাত্র নিকটবর্তী নিউক্লিয়নগুলির সঙ্গেই আবদ্ধ থাকে।
৫। প্রোটন, নিউট্রন এবং অন্য কিছু বিশেষ কণাই কেবল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ইলেকট্রন এবং বেশ কিছু মৌলিক কণা আছে, যাদের মধ্যে এই নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া নেই।