গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ও পরিবার পরিকল্পনা (Birth Control Methods and Family Planning)
গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ও পরিবার পরিকল্পনা (Birth Control Methods and Family Planning)
গর্ভ নিরোধ (Contraception)
গর্ভ নিরোধ হচ্ছে গর্ভধারণে বাধা দেয়া, অর্থাৎ শুক্রাণুকে ডিম্বাণুর সাথে মিলনে বাধা সৃষ্টি করা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা সীমিত রাখার জন্যই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সন্তানের জন্ম বিভিন্ন উপায়ে রোধ করা সম্ভব। বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা গর্ভনিরোধকের নানা পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ও গবেষনা অব্যাহত রেখেছেন। বর্তমান সময়ে যেসব গর্ভনিরোধক পদ্ধতি অনুসৃত হয় সে সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো। গর্ভনিরোধক সকল ব্যবস্থাকে প্রধানত দুভাবে শ্রেণিভুক্ত করা যায়, অস্থায়ী পদ্ধতি এবং স্থায়ী পদ্ধতি।
ক. অস্থায়ী পদ্ধতি (Temporary Methods)
১. শারীরিক পদ্ধতি : গর্ভনিরোধক এর শারীরিক পদ্ধতি হচ্ছে নিরাপদ সময় নির্বাচন ও শিশ্ন বহিষ্করণ।
- নিরাপদ সময় নির্বাচন : মাসিক রজঃচক্রের প্রথম ও শেষ সপ্তাহের দিনগুলোতে ফেলোপিয়ান নালিতে কোনো পরিপক্ক ডিম্বাণু থাকেনা বলে ঐ সময়কে যৌন মিলনের নিরাপদ সময় বলে।
- শিশ্ন বহিষ্করণ : সঙ্গমকালে শুক্রাণু স্খলনের মুহূর্তে যদি শিশ্নকে প্রত্যাহার করে দেহের বাইরে স্খলিত করা হয় তাহলে শুক্রাণু নিষেক ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।
২. রাসায়নিক পদ্ধতি : শুক্রনাশক জেলি, ক্রিম, ফেনা বা ফোম বড়ি, জেল প্রভৃতি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যৌনমিলনের আগে স্থাপন করতে হয়। এটি ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত কার্যক্ষম থেকে স্থলিত শুক্রাণুকে বিনষ্ট করে দেয়।
৩. যান্ত্রিক পদ্ধতি : জন্মনিরোধক হিসেবে বেশ কয়েক ধরনের যান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে :
- কনডম : এটি পুরুষের ব্যবহারের জন্য এক ধরনের পাতলা, লম্বাটে রাবারের থলি। সঙ্গমের পূর্বে শিশ্ন কনডমে আবৃত করে নিলে স্খলিত শুক্রাণু আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে মহিলাও কনডম ব্যবহার করতে পারে।
- ডায়াফ্রাম : এটি মিলনের পূর্বে জেলি বা ফোম সহযোগে স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের সহায়তায় যোনিতে স্থাপন করতে হয় এবং যৌন মিলনের পর অন্ততঃ ৬ ঘন্টা সেখানেই রাখতে হয়। ডায়াফ্রাম ব্যবহারে কোন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই, বরং জরায়ুর ক্যান্সার এবং কিছু যৌন রোগ প্রতিরোধ সহায়ক।
- স্পঞ্জ : এটি ভিজিয়ে যোনিতে স্থাপন করতে হয় এবং পর মুহূর্ত থেকেই কার্যক্ষম হলে ২৪ ঘন্টা অনবরত প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকে।
- অন্তর্জরায়ু গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা : এ ব্যবস্থায় পলিথিন, তামা, রূপা বা স্টেনলেস স্টিল নির্মিত একটি ফাঁস (loop) জরায়ুর অভ্যন্তরে স্থাপন করলে তা জরায়ুর ভিতরে নিষিক্ত ডিম্বাণু রোপণে বাধা দান করে।
৪. শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতি: এ ব্যবস্থার প্রধান উপকরণ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ইনজেকশন।
- জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি : এটি বিভিন্ন অনুপাতে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মিশ্রণে তৈরি এবং মুখে গ্রহণযোগ্য বড়ি। রজঃচক্রের ৫-২৫ তম দিন পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে বড়ি গ্রহণ করতে হয়। এগুলো মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের উপর কাজ করে ডিম্বপাতে বাধা দেয় এবং জরায়ুকন্ঠের মিউকাস ঝিল্লিকে শুক্রাণু প্রবেশের বিরোধী করে তোলে। এটি একটি বহুল প্রচলিত জন্মনিরোধক পদ্ধতি কিন্তু অনেক নারীর সাময়িক বমি বমি ভাব, ফোঁটা ফোঁটা স্রাব, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
- ইনজেকশন : বেশ কয়েকমাস যাতে গর্ভধারণ ঝুঁকি নিরাপদে এড়ানো যায় তার জন্য ইদানিং এক ধরনের ইনজেকশন আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকায় এর গুণগত মান উন্নয়নের চেষ্টা চলছে।
৫. গর্ভপাত : অস্ত্রোপচারের সাহায্যে ২-৩ মাস বয়সী ভ্রূণকে বিচ্যুত করিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
খ. স্থায়ী পদ্ধতি (Permanent Methods)
জন্মনিরোধের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি অবলম্বন করাকে বন্ধ্যাকরণ (sterilisation) বলে। এটি নিচে বর্ণিত দুধরনের।
১. ভ্যাসেকটমি (Vasectomy): এ পদ্ধতিতে পুরুষের ক্ষেত্রে উভয় দিকের শুক্রনালির অংশকে কেটে বেঁধে দেয়া হয় যাতে শুক্রাণু বাইরে আসতে না পারে।
২. টিউবেকটমি (Tubectomy) বা লাইগেশন (Ligation): এ পদ্ধতিতে মহিলাদের ক্ষেত্রে উভয় দিকের ফেলোপিয়ান নালির (ডিম্বনালি) অংশ কেটে বেঁধে দেয়া হয় যাতে শুক্রাণু প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অধিক সন্তানবতী বা যারা একেবারেই আর সন্তান চান না বা গর্ভধারণের জন্য শারীরিকভাবে অসুস্থ তাদের জন্য এ পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পরিবার পরিকল্পনা (Family Planning)
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আজ নানা কারণে ভয়াবহ অনুভূত হচ্ছে। তাই সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিটি দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম জোরদার করে একে আয়ত্তে আনার প্রচেষ্টা চলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারলেই আমরা পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাও সহজেই বুঝতে পারব। জনবহুলতার ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলো হচ্ছে : খাদ্যের অপ্রতুলতা; বস্ত্রের অপর্যাপ্ততা; উপযুক্ত বাসস্থানের অভাব; সুচিকিৎসার অভাব; পরিবেশ দূষণের ফলে বিশুদ্ধ পেয় পানির এমনকি কোন কোন অঞ্চলে বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব; শিক্ষার অভাব; অপূরণীয় খনিজ সম্পদের বর্ধিত হারে উত্তোলন ও ব্যবহার; অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা; বেকারত্ব বৃদ্ধি; এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এক কথায় বলতে গেলে, মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় (Ways to control the population)
প্রত্যেকটি দেশই অনন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত। যে কোন বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আগে এ দিকটি খতিয়ে দেখতে হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকেও প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো নিম্নোক্ত ধরনের হতে পারে:
১. বিয়ের বয়স : নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স নির্ধারিত থাকবে এবং আইন লংঘনকারীদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান থাকবে।
২. সন্তান সংখ্যা : দম্পতি পিছু “এক সন্তানই যথেষ্ট”এ শ্লোগান কার্যকর করতে হবে।
৩. বিবাহ বন্ধনের নিয়মকানুন : বিভিন্ন ধর্মমতের বিবাহ পদ্ধতিকে উৎসাহিত করতে হবে। কোথাও বহুবিবাহ সিদ্ধ থাকলে সেক্ষেত্রে সন্তানসংখ্যা সম্পর্কে কঠোর আইন এবং আইন লংঘনকারীর উপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে হবে।
৪. শিক্ষা : প্রাথমিক পর্যায় থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্বন্ধে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রত্যেক। দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এজন্য দক্ষ মাঠকর্মী নিয়োগ ও অদক্ষদের ছাঁটাই করতে হবে।
৫. গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা : কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যা ও তা নির্দিষ্ট বয়স অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সক্ষম। দম্পতিদের স্থায়ী গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করাতে হবে। এ বিষয়ে গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও শহরের। ওয়ার্ড কমিশনারদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : নির্ধারিত সময়ের পর বিয়ে এবং এক সন্তান / দুই সন্তানবিশিষ্ট পরিবারকে লেখাপড়া, ভ্রমণ ও চাকুরীতে বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।