10 Minute School
Log in

কোষ, সাইটোপ্লাজম এবং নিউক্লিয়াস (Cell, Cytoplasm and Nucleus)

জীবকোষ (Cell)

আগের শ্রেণিতে তোমরা জেনেছ যে জীবকোষ হচ্ছে জীবদেহের একক। এই জনকোষ কী? কোনো কোনো বিজ্ঞানী জীবকোকে জীবদেহের ক্রিয়াকলাপের একক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। লোয়ি (Loewy) এবং সিকেভিজ (Sickevitz) 1969 সালে বৈষম্য ভেদ্য (selectively permeable) পর্দা দিয়ে আবৃত এবং জীবজ ক্রিয়াকলাপের একক যা অন্য সজীব মাধ্যম ছাড়াই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে, এমন সত্তাকে কোষ বলেছেন।

 

কোষের প্রকারভেদ (Types of cells)

সকল জীবকোষ এক রকম নয়। এদের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য যেমন আছে তেমনই আছে আকৃতি ও কাজের পার্থক্য। নিউক্লিয়াসের গঠনের ভিত্তিতে কোষ দুই ধরনের, আদি কোষ এবং প্রকৃত কোষ।

 

(i) আদিকোষ বা প্রাককেন্দ্রিক কোষ (Prokaryotic cell) 

  1. এ ধরনের কোষে কোনো সুগঠিত নিউক্লিয়াস (nucleus) থাকে না।
  2. এদের আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত কোষও বলা হয়।
  3. এসব কোষের নিউক্লিয়াস কোনো পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে না, তাই নিউক্লিও-বস্তু সাইটোপ্লাজমে ছড়ানো থাকে।
  4. এসব কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া, প্লাস্টিড, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ইত্যাদি অঙ্গাণু থাকে না তবে 
  5. রাইবোজোম থাকে।
  6. ক্রোমোজোমে কেবল DNA থাকে।
  7. নীলাভ সবুজ শৈবাল বা ব্যাকটেরিয়ায় এ ধরনের কোষ পাওয়া যায়।

 

(ii) প্রকৃত কোষ বা সুকেন্দ্রিক কোষ (Eukaryotic cell) 

  1. এসব কোষের নিউক্লিয়াস সুগঠিত অর্থ নিউক্লিয়ার (nuclear membrane) দিয়ে নিউক্লিও-বস্তু পরিবেষ্টিত ও সুসংগঠিত।
  2. এসব কোষে রাইবোজোমসহ সকল অঙ্গাণু উপস্থিত থাকে।
  3. ক্রোমোজোমে DNA, প্রোটিন, হিস্টোন এবং অন্যান্য উপাদান থাকে।
  4. অধিকাংশ জীবকোষ এ ধরনের হয়।

 

কাজের ভিত্তিতে প্রকৃত কোষ দুই ধরনের: 

  1. দেহকোষ  
  2. জননকোষ

 

দেহকোষ (Somatic cell): 

  1. বহুকোষী জীবের দেহ গঠনে এসব কোষ অংশগ্রহণ করে।
  2. মাইটোসিস পদ্ধতিতে বিভাজনের মাধ্যমে দেহকোষ বিভাজিত হয়।
  3. দেহের বৃদ্ধি ঘটে।
  4. বিভিন্ন তন্ত্র ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনে দেহকোষ অংশ নেয়। 

 

জননকোষ (Gametic cell):

যৌন প্রজনন ও জনঃক্রম দেখা যায়, এমন জীবে জননকোষ উৎপন্ন হয়। মিয়োসিস পদ্ধতিতে জনন মাতৃকোষের বিভাজন ঘটে এবং জনন কোষ উৎপন্ন হয়। অপত্য জননকোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যার অর্ধেক থাকে। পুং ও স্ত্রী জননকোষ মিলিত হয়ে নতুন জীবের দেহ গঠনের সূচনা করে। পুং ও স্ত্রী জননকোষের মিলনের ফলে সৃষ্ট এই প্রধান কোষটিকে জাইগোট (Zygote) বলে। জাইগোট বারবার বিভাজনের মাধ্যমে জীবদেহ গঠন করে।

 

উদ্ভিদ ও প্রাণিকোষের প্রধান অঙ্গাণু এবং তাদের কাজ (The main Organelle of plants and animals and their functions)

 

উচ্চশ্রেণির উদ্ভিদ ও প্রাণীরা সকলেই প্রকৃত কোষী। প্রতিটি কোষ কতগুলো অঙ্গাণু নিয়ে তৈরি হয়। 

 

  1. কোষপ্রাচীর (cell wall) 

উদ্ভিদ কোষের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এটি মৃত বা জড়বস্তু দিয়ে তৈরি। প্রাণিকোষে কোষপ্রাচীর থাকে না। কোষপ্রাচীরের রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল এতে সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ, লিগনিন, পেকটিন, সুবেরিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। তবে ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীর প্রোটিন, লিপিড ও পলিস্যাকারাইড দিয়ে এবং ছত্রাকের কোষপ্রাচীর কাইটিন দিয়ে তৈরি। প্রাথমিক কোষপ্রাচীরটি একস্তরবিশিষ্ট। মধ্য পর্দার উপর প্রোটোপ্লাজম থেকে নিঃসৃত কয়েক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য জমা হয়ে ক্রমশ গৌণপ্রাচীর সৃষ্টি করে। এই প্রাচীরে মাঝে মাঝে ছিদ্র থাকে, যাকে কূপ বলে। কোষপ্রাচীর কোষকে দৃঢ়তা প্রদান করে কোষের আকার আকৃতি বজায় রাখে। পাশের কোষের সাথে প্লাজমোডেজমাটা (আণুবীক্ষণিক নালি) সৃষ্টির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং পানি ও খনিজ লবণ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।

  1. প্রোটোপ্লাজম (Protoplasm)

কোষের ভিতরে যে অর্ধস্বচ্ছ, থকথকে জেলির মতো বস্তু থাকে তাকে প্রোটোপ্লাজম বলে। কোষঝিল্লি দিয়ে ঘেরা সবকিছুই প্রোটোপ্লাজম, এমনকি কোষঝিল্লি নিজেও প্রোটোপ্লাজমের অংশ। কোষঝিল্লি ছাড়াও এখানে আছে সাইটোপ্লাজমীয় অঙ্গাণুগুলো এবং নিউক্লিয়াস।

 

2.1 কোষঝিল্লি (Plasmalemma)

প্রোটোপ্লাজমের বাইরে দুই স্তরের যে স্থিতিস্থাপক পর্দা থাকে, তাকে কোষঝিল্লি বা প্লাজমালেমা বলে। কোষঝিল্লির ভাঁজকে মাইক্লোভিলাই বলে। এটি প্রধানত লিপিড এবং প্রোটিন দিয়ে তৈরি। কোষঝিল্লি একটি বৈষম্যভেদ্য পর্দা হওয়ায় অভিস্রবণের মাধ্যমে পানি ও খনিজ লবণ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এবং পাশাপাশি কোষগুলোকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রাখে।

2.2 সাইটোপ্লাজমীয় অঙ্গাণু (Cytoplasmic organelles) 

প্রোটোপ্লাজম থেকে নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রিকাটিকে সরিয়ে দিলে যে জেলির মতো বস্তুটি থেকে যায় সেটিই সাইটোপ্লাজম। এই সাইটোপ্লাজমের মধ্যে অনেক ধরনের অঙ্গাণু থাকে। এদের প্রত্যেকের কাজ আলাদা হলেও একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই অঙ্গাণুগুলোর কোনো কোনোটি ঝিল্লিযুক্ত আবার কোনো কোনোটি ঝিল্লিবিহীন। অঙ্গাণুগুলো হল:

ঝিল্লিযুক্ত সাইটোপ্লাজমীয় অঙ্গাণু (Membrane cytoplasmic organelles)

 

(a) মাইটোকড্রিয়া (Mitochondria)

  1. এ অঙ্গাণুটি 1898 সালে বেনডা (Benda) অবিষ্কার করেন।
  2. এটি দুই স্তরবিশিষ্ট আবরণী ঝিল্লি দিয়ে ঘেরা।
  3. ভিতরের স্তরটি ভিতরের দিকে ভাঁজ হয়ে থাকে। এদের ক্রিস্টি (cristae) বলে।
  4. ক্রিস্টির গায়ে বৃন্তযুক্ত গোলাকার বস্তু থাকে, এদের অক্সিজোম (onliomes) বলে।
  5. অক্সিজোমে উৎসেচকগুলো (enzymes) সাজানো থাকে।
  6. মাইটোকন্ড্রিয়নের ভেতরে থাকে ম্যাট্রিক্স (matrix)।
  7. জীবের শ্বসনকার্যে সাহায্য করা মাইটোকন্ড্রিয়ার প্রধান কাজ।

তোমরা পরে দেখবে যে শ্বসন ক্রিয়ার ধাপ চারটি; গ্লাইকোলাইসিস, অ্যাসিটাইল কো-এ সৃষ্টি, ক্রেবস চক্র এবং ইলেকট্রন প্রবাহ তন্ত্র। 

এর প্রথম গ্লাইকোলাইসিসের বিক্রিয়াগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ায় ঘটে না। তবে দ্বিতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ক্রেবস চক্রের বিক্রিয়াগুলো এই অঙ্গাণুর মধ্যেই সম্পন্ন হয়। ক্রেবস চক্রে অংশগ্রহণকারী সব উৎসেচক এতে উপস্থিত থাকায় বিক্রিয়াগুলো মাইটোকন্ড্রিয়াতেই সম্পন্ন হয়। তোমরা দেখবে, ক্রেবস চক্রে সবচেয়ে বেশি শত্তি উৎপাদিত হয়। এজন্য মাইটোকন্ড্রিয়াকে কোষের ‘শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র’ বা ‘পাওয়ার হাউস’ বলা হয়। এই শক্তি জীব তার বিভিন্ন কাজে খরচ করে কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া সকল উদ্ভিদকোষ ও প্রাণিকোষে মাইটোকন্ড্রিয়া পাওয়া যায়।

প্রাককেন্দ্রিক কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে না। এমনকি কিছু সুকেন্দ্রিক কোষেও (যেমন: Trichomonas, Monocercomonoides ইত্যাদি প্রোটোজোয়াতে) মাইটোকন্ড্রিয়া অনুপস্থিত। তাহলে এমন কি হতে পারে যে বিবর্তনীয় ইতিহাসের কোনো এক সময়ে সুকেন্দ্রিক কোষের ভিতর মাইটোকন্ড্রিয়া (কিংবা তার পূর্বসূরী) ঢুকে পড়েছিল এবং তারপর থেকে সেটি কোষের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে? এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে এই ব্যাখ্যাটিই অনুমান করা হয়। এই ঘটনাকে এন্ডোসিমবায়োসিস বলে।

 

(b) প্লাস্টিড (Plastid)

প্লাস্টিড উদ্ভিদ কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু। প্লাস্টিডের প্রধান কাজ খাদ্য প্রস্তুত করা, খাদ্য সঞ্চয় করা এবং উদ্ভিদদেহকে বর্ণময় এবং আকর্ষণীয় করে পরাগায়নে সাহায্য করা। প্লাস্টিড তিন ধরনের- 

  1. ক্লোরোপ্লাস্ট,
  2. ক্রোমোপ্লাস্ট
  3. লিউকোপ্লাস্ট।

b. a.  ক্লোরোপ্লাস্ট (Chloroplast):

  1. সবুজ রজের প্লাস্টিডকে ক্লোরোপ্লাস্ট বলে।
  2. পাতা, কচি কান্ড ও অন্যান্য সবুজ অংশে এদের পাওয়া যায়।
  3. প্লাস্টিডের গ্রানা (grana) অংশ সূর্যালোককে আবদ্ধ করে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
  4. এই আবদ্ধ সৌরশস্তি স্ট্রোমাতে (stroma) অবস্থিত উৎসেচক।
  5. সমষ্টি, বায়ু থেকে গৃহীত কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং কোষের ভিতরকার পানি ব্যবহার করে সরল শর্করা তৈরি করে।
  6. এই প্লাস্টিডে ক্লোরোফিল থাকে, তাই এদের সবুজ দেখায়।
  7. এছাড়া এতে ক্যারোটিনয়েড নামে এক ধরনের রঞ্জকও থাকে।

(ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এবং সরলভাবে উপস্থাপিত)

 

b. b. ক্রোমোপ্লাস্ট (Chromoplast):

  1. এগুলো রঙিন প্লাস্টিড তবে সবুজ নয়।
  2. এসব প্লাস্টিডে জ্যান্থফিল, ক্যারোটিন, ফাইকোএরিথ্রিন, ফাইকোসায়ানিন ইত্যাদি রঞ্জক থাকে, তাই কোনোটিকে হলুদ, কোনোটিকে নীল আবার কোনোটিকে লাল দেখায়।
  3. এদের মিশ্রণজনিত কারণে ফুল, পাতা এবং উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
  4. রঙিন ফুল, পাতা এবং গাজরের মূলে এদের পাওয়া যায়।
  5. ফুলকে আকর্ষণীয় করে পরাগায়নে সাহায্য করা এদের প্রধান কাজ।
  6. এরা বিভিন্ন ধরনের রঞ্জক পদার্থ সংশ্লেষণ করে জমা করে রাখে।

 

b. c. লিউকোপ্লাস্ট (Leucoplast): 

  1. সেসব প্লাস্টিডে কোনো রঞ্জক পদার্থ থাকে না, তাদের লিউকোপ্লাস্ট বলে।
  2. যেসব কোষে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, যেমন মূল, রূপ, জননকোষ ইত্যাদি সেখানে এদের পাওয়া যায়। 
  3. এদের প্রধান কাজ খাদ্য সঞ্চয় করা।
  4. আলোর সংস্পর্শে এলে লিউকোপ্লাস্ট ক্লোরোপ্লাস্টে রূপান্তরিত হতে পারে।

 

(c) গলজি বস্তু (Golgi body) 

গলজি বস্তু (কিংবা গলগি বস্তু) প্রধানত প্রাণিকোষে পাওয়া যায়, তবে অনেক উদ্ভিদকোষেও এদের দেখা যায়। এটি সিস্টার্নি ও কয়েক ধরনের ভেসিকল নিয়ে তৈরি। এর পর্দায় বিভিন্ন উৎসেচকের পানি বিয়োজন সম্পন্ন হয়। জীবকোষে বিভিন্ন পদার্থ নিঃসৃতকরণের সাথে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হরমোন নিঃসরণেও এর ভূমিকা লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো বিপাকীয় কার্যের সাথেও এরা সম্পর্কিত এবং কখনো কখনো এরা প্রোটিন সঞ্চয় করে রাখে।

 

(d) এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম (Endoplasmic reticulum) 

এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম এর আবরণীর গায়ে প্রায়ই রাইবোজোম লেগে থাকে, তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব স্থানে প্রোটিন সংশ্লেষণের ঘটনা ঘটে। কোষে উৎপাদিত পদার্থগুলোর প্রবাহ পথ হিসেবে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ব্যবহৃত হয়। এগুলো কখনো কখনো প্লাজমা মেমব্রেনের সাথে যুক্ত থাকে, তাই ধারণা করা হয়, এক কোষ থেকে অন্য কোষে উৎসেচক ও কোষে উৎপাদিত অন্যান্য দ্রবাদি এর মাধ্যমে চলাচল করে। মাইটোকন্ড্রিয়া, কোষগহ্বর এগুলো সৃষ্টিতে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয় কোষেই এরা উপস্থিত থাকে।

 

(e) কোষগহ্বর (Vacuole)

সাইটোপ্লাজমে কোষের মধ্যে যে আপাত ফাঁকা স্থান দেখা যায়, সেগুলোই হচ্ছে কোষগহ্বর। বৃহৎ কোষগহ্বর উদ্ভিদ কোষের বৈশিষ্ট্য। এর প্রধান কাজ কোষরস ধারণ করা। বিভিন্ন ধরনের অজৈব লবণ, আমিষ, শর্করা, চর্বিজাতীয় পদার্থ, জৈব এসিড, রঞ্জক পদার্থ, পানি ইত্যাদি এই কোষরসে থাকে। প্রাণিকোষে কোষগহ্বর সাধারণত অনুপস্থিত থাকে, তবে যদি কখনো থাকে, তবে সেগুলো আকারে ছোট হয়।

 

(f) লাইসোজোম (Lysosome) 

লাইসোজোম জীবকোষকে জীবাণুর থেকে রক্ষা করে। এর উৎসেচক আগত জীবাণুগুলোকে হজম করে ফেলে। এর পরিপাক করার উৎসেচকগুলো একটি পর্দা দিয়ে আলাদা করা থাকে, তাই অন্যান্য অঙ্গাণু এর সংস্পর্শে এলেও হজম হয় না।

দেহে অক্সিজেনের অভাব হলে বা বিভিন্ন কারণে লাইসোজোমের পর্দা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তখন এর আশেপাশের অঙ্গগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কখনে কোষটিই মারা যায়।

ঝিল্লিবিহীন সাইটোপ্লাজমীয় অঙ্গাণু (Membraneless cytoplasmic organelles)

 

(a) কোষ কঙ্কাল (Cytoskeleton) 

কোষঝিল্লি অতিক্রম করে কোষের ভিতরে ঢুকলে প্রথমেই কোষকঙ্কাল নজরে পড়বে। সেটি এবং মোটা-চিকন মিলিয়ে অসংখ্য দড়ির মতো বস্তু যা কোষের চারদিকে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। কোষকঙ্কাল ভিতর থেকে কোষটাকে ধরে রাখে। অ্যাকটিন, মায়োসিন, টিউবিউলিন ইত্যাদি প্রোটিন দিয়ে কোষ কঙ্কালের বিভিন্ন ধরনের তন্তু নির্মিত হয়। মাইক্রোটিউবিউল, মাইক্রোফিলামেন্ট কিংবা ইন্টারমিডিয়েট ফিলামেন্ট এ ধরনের তন্তুর উদাহরণ।

 

(b) রাইবোজোম (Ribosome)

  1. প্রাণী এবং উদ্ভিদ উভয় ধরনের কোষেই এদের পাওয়া যায়।
  2. এই পর্ববিহীন অঙ্গাণুটি প্রধানত প্রোটিন সংশ্লেষণে সাহায্য করে।
  3. প্রোটিনের পলিপেপটাইড চেইন সংযোজন এই রাইবোজোমে হয়ে থাকে।
  4. এছাড়া রাইবোজোম এ কাজে প্রয়োজনীয় উৎসেচক সরবরাহ করে থাকে।
  5. উৎসেচক বা এনজাইনের কাজ হলো প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া বাড়িয়ে দেওয়া।

 

(c) সেন্ট্রোজোম (Centrosome)

  • এটি প্রাণিকোষের বৈশিষ্ট্য, প্রধানত প্রাণিকোষে এদের পাওয়া যায়।
  • নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদ কোষে কদাচিৎ এদের দেখা যায়।
  • প্রাণিকোষের নিউক্লিয়াসের কাছে দুটি ফাঁপা নলাকার বা দণ্ডাকার অঙ্গাণু দেখা যায়, তাদের সেন্ট্রিওল বলে।
  • সেন্ট্রিওলের চারপাশে অবস্থিত গাঢ় তরলকে সেন্ট্রোস্ফিয়ার এবং সেন্ট্রোস্ফিয়ারসহ সেন্ট্রিওলকে সেন্ট্রোজোম বলে।
  • সেন্ট্রোজোমে থাকা সেন্ট্রিওল কোষ বিভাজনের সময় অ্যাস্টার রে তৈরি করে।
  • এছাড়া স্পিন্ডল যন্ত্র সৃষ্টিতেও সেন্ট্রোজোমের অবদান রয়েছে।
  • বিভিন্ন ধরনের ফ্লাজেলা সৃষ্টিতে এরা অংশগ্রহণ করে।

নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রিকা (Nucleus)

জীবকোষের প্রোটোপ্লাজমে নির্দিষ্ট পদার্থের ক্রোমোজোম বহনকারী সুস্পষ্ট যে বস্তুটি দেখা যায় সেটিই হচ্ছে নিউক্লিয়াস। এর আকৃতি গোলাকার, ডিম্বাকার বা নলাকার। সিভকোষ এবং লোহিত রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না। নিউক্লিয়াসে বংশগতির বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে। এটি কোষে সংঘটিত বিপাকীয় কার্যাবলিসহ সব ক্রিয়া-বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। সুগঠিত নিউক্লিয়াসে নিচের অংশগুলো দেখা যায়।

 

(a) নিউক্লিয়ার ঝিল্লি (Nuclear membrane)

নিউক্লিয়াসকে ঘিরে রাখে যে তাকে নিউক্লিয়ার ফিল্পি বা কেন্দ্রিকা বিন্নি বলে। এটি দুই বিশিষ্ট এই বিল্লি লিপিড ও প্রোটিনের সমন্বয়ে তৈরি হয়। এই ঝিল্পিতে মাঝে মাঝে কিছু ছিদ্র থাকে, যেগুলোকে নিউক্লিয়ার রা বলে। এই ছিদ্রের ভিতর দিয়ে নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজমের মধ্যে কিছু বস্তু চলাচল করে। নিউক্লিয়ার বিল্লি সাইটোপ্লাজম থেকে নিউক্লিয়াসের অন্যান্য বস্তুতে পৃথক রাখে এবং বিভিন্ন বস্তুর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।

 

(b) নিউক্লিওপ্লাজম (Nucleoplasm)

নিউক্লিয়ার ঝিল্লির ভিভরে জেলির মতো বস্তু বা রস থাকে। একে কেন্দ্রিকারস বা নিউক্লিওপ্লাজম বলে। নিউক্লিওপ্লাজমে নিউক্লিক এসিড, প্রোটিন, উৎসেচক ও কতিপয় খনিজ লবণ থাকে।

 

(c) নিউক্লিওলাস (Nucleolus)

নিউক্লিওপ্লাজমের মধ্যে ক্রোমোজোমের সাথে সংলগ্ন গোলাকার বস্তুকে নিউক্লিওলাস বা কেন্দ্রিকাণু বলে। ক্রোমোজোমের রংঅগ্রাহী অংশের সাথে এরা লেগে থাকে। এরা RNA প্রোটিন দিয়ে তৈরি হয়। এরা রাইবোজোম সংশ্লেষণ করে।

 

(d) ক্রোমাটিন জালিকা (Chromatin reticulum) 

কোষের বিশ্রামকালে অর্থাৎ যখন কোষ বিভাজন চলে না, তখন নিউক্লিয়াসে কুণ্ডলী পাকানো সূক্ষ্ম সুতার মতো অংশই হচ্ছে ক্রোমাটিন জালিকা বা নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম। কোষ বিভাজনের সময় এরা মোটা এবং খাটো হয়, তাই তখন তাদের আলাদা আলাদা ক্রোমোজোম হিসেবে দেখা যায়। ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিনগুলো বংশগতির গুণাবলি বহন করে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিয়ে যায়। কোনো একটি জীবের ক্রোমোজোম সংখ্যা ঐ জীবের জন্য নির্দিষ্ট। এসব ক্রোমোজোমে বংশধারা বহনকারী জিন (gene) অবস্থান করে এবং বংশের বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় -বহন করা ক্রোমোজোমের কাজ।

উদ্ভিদ ও প্রাণীর কাজ পরিচালনায় বিভিন্ন প্রকার কোষের ভূমিকা (The role of different types of cells in managing the work of plants and animals)

কোষ জীবদেহের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) গঠনের একক। এককোষী ও বহুকোষী প্রাণীদের কোষের কাজ ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। পৃথিবীর আদি প্রাণের আবির্ভাবের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত এককোষী প্রাণী প্রোটোজোয়া পর্বের প্রজাতিগুলো তাদের দেহের সব ধরনের ক্রিয়াকলাপ- যেমন খাদ্যগ্রহণ, দেহের বৃদ্ধি ও প্রজনন ঐ একটি কোষের মাধ্যেমেই সম্পন্ন করে থাকে। বহুকোষী প্রাণীদের দেহকোষের মাঝে ভিন্নতা আছে, আছে বৈচিত্র্য।