10 Minute School
Log in

হরমোনের প্রভাব (Effects of Hormone)

দেহের বৃদ্ধিতে হরমোনের প্রভাব (Effects of Hormone in the growth of the body)

মানবদেহের বৃদ্ধিতে দুটি হরমোন প্রধান ভূমিকা পালন করে। একটি হচ্ছে পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত গ্রোথ হরমোন এবং অন্যটি থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরক্সিন (Thyroxine)।

গ্রোথ হরমোনের ভূমিকা (Role of Growth Hormone)

  1. তরুণাস্থি ও অস্থির কোষগুলোর পূর্ণতা প্রাপ্তিসহ এগুলোর বৃদ্ধি, অস্থিতে ক্যালসিয়াম আয়ন সঞ্চয় ইত্যাদি কাজে ভূমিকা রাখে।
  2. কোষের অ্যামিনো এসিড গ্রহণ ও প্রোটিন সংশ্লেষণ হার বৃদ্ধি করে, ফলে দেহের পেশির বৃদ্ধি ঘটে।
  3. ক্ষুধার্ত অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজ ও মুক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেহের ক্ষয়রোধ করে।
  4. অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম আয়ন শোষণ ও বৃক্ক থেকে বিভিন্ন আয়ন পুনঃশোষণ করে দেহের বিভিন্ন আয়নের পরিমাণ বর্ধন ও দৈহিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।
  5. দেহের সকল নরম অঙ্গের (মস্তিষ্ক ছাড়া) আকার বৃদ্ধি ও স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখে।
  6. বেশি দুধ উৎপাদনে স্তনগ্রন্থিকে প্রভাবিত করে যা শিশুর দৈহিক বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রাখে।
  7. এরিথ্রোপোয়েসিস (erythropoiesis) প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে রক্তেদর লোহিত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে।

থাইরক্সিন হরমোনের ভূমিকা (Role of Thyroxine Hormone)

  1. পিটুইটারি গ্রন্থিকে গ্রোথ হরমোন ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে।
  2. প্রোটিন সংশ্লেষের হার বাড়িয়ে দেহের বৃদ্ধি ঘটার।
  3. কঙ্কাল পেশির বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।
  4. বিভিন্ন টিস্যুর বিভেদ ও পরিপক্কতার জন্য এটি অত্যাবশ্যক।
  5. খাদ্যের বিপাকীয় হার বৃদ্ধি করে।

শারীরবৃত্তীয় কাজে হরমোনের প্রভাব (Effect of Hormone in Physiological Functions)

  1. পৌষ্টিকনালির অন্তঃক্ষরা কোষ থেকে নিঃসৃত গ্যাস্ট্রিন, সিক্রেটিন ও কোলেসিস্টোকাইনিন হরমোন পরিপাক ক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এনজাইমগুলোর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  2. থাইরক্সিন, ইনসুলিন, গ্লুকাগন, গ্লুকোকর্টিকয়েড হরমোন শর্করা বিপাক করে।
  3. থাইরক্সিন হরমোন প্রোটিন, স্নেহদ্রব্য ও খনিজ আয়ন বিপাক এবং টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রোটিন বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে।
  4. এপিনেফ্রিন, নরএপিনেফ্রিন হরমোন হৃৎক্রিয়া ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করে।
  5. অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত অ্যালডোস্টেরন Na+, K+ আয়নের সমতা রক্ষা করে।
  6. স্টেরয়েডধর্মী হরমোনগুলো প্রোটিন সংশ্লেষণে, গ্রোথ হরমোন ফ্যাটকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদনে প্রভাবিত করে।
  7. ADH হরমোন পানি শোষণ ও পানি সাম্য বজায় রাখে। বৃক্ক থেকে ক্ষরিত এরিথ্রোপোয়েটিন হরমোন লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
  8. ইস্ট্রোজেন ঋতুচক্র ও স্তনগ্রন্থির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে, প্রোজেস্টেরন জরায়ুর প্রাচীরে নিষিক্ত ডিম্বাণু স্থাপন এবং গর্ভাবস্থায় স্তনগ্রন্থির বিকাশ ঘটায়, টেস্টোস্টেরন শুক্রাণুজনন (spermatogenesis)-এ শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে।
  9. প্রসবের সময় রিলাক্সিন শ্রেণিদেশীয় লিগামেন্ট ও পেশির প্রসারণ ঘটিয়ে এবং অক্সিটোসিন জরায়ুর সঙ্কোচন ঘটিয়ে প্রসব ত্বরান্বিত করে।
  10. টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।
  11. গ্রোথ হরমোন, থাইরক্সিন, ইস্ট্রোজেন, প্রোল্যাকটিন সন্তান প্রসবকারী মায়ের স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

আচরণ পরিবর্তনে হরমোনের প্রভাব (Effect of Hormone in Behavior Change)

মানবদেহের যে কোনো আচরণের রহস্য উদঘাটনে অবাক হতে হয় কতো নিখুত মিশ্রণে দেহ পরিচালিত হচ্ছে। এর জন্যে রয়েছে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। জীবনের প্রত্যেক ধাপে বিভিন্ন উপায়ে নারী, পুরুষ ও শিশুদেহের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনে হরমোনের প্রভাব রয়েছে।

নারীদের আচরণগত পরিবর্তন (Behavioral changes of women)

  • রজচক্র চলাকালীন সময় নারীর দেহের কিছু হরমোন ক্ষরণে তারতম্যের সষ্টি হয়। এর ফলে নারীদের মধ্যে পুরুষের সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার প্রবণতা বেড়ে যায়, খাদ্য গ্রহণ কমে যায় ইত্যাদি। সাধারণত নারীর দেহে ডিম্বপাতের সময় এগিয়ে আসলে এ ধরনের আচরণ করে থাকে।
  • রজঃচক্র বন্ধকালীন সময় এগিয়ে আসলে ডিম্বাশয়ে প্রোজেস্টেরন, ইস্ট্রোজেন ও অ্যান্ডোজেন হরমোন কম মাত্রায় ক্ষরিত হয়। এ পরিবর্তনের ফলে নারীরা অল্প কিছুতে রেগে যায়, ঘুম ঠিকমতো হয় না, অনেকে আবার বিষণ্নতায় ভুগে থাকে।
  • গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের হরমোন যেমন- hCG (Human Chorionic Gonadotropin), প্রোজেস্টেরন, রিলাক্সিন ইত্যাদি হরমোন ক্ষরণে তারতম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে দেখা যায় অনেকে অল্পতে রেগে উঠে, হঠাৎ কেঁদে ফেলে ইত্যাদি নানান পরিবর্তন দেখা যায়।

পুরুষদের আচরণগত পরিবর্তন (Behavioral changes of women)

  • টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ বেড়ে গেলে যৌন আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়।
  • অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন ক্ষরণে স্বভাবে হিংস্রতা সৃষ্টি হয়।
  • টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ কমে গেলে বিষণ্ণতায় ডুবে যায়
  • শুক্র নিবৃত্তি বা অ্যান্ড্রোপজের সময় কাছে চলে আসলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায়

শিশুদের আচরণগত পরিবর্তন (Behavioral changes of children)

শিশু যখন বয়সন্ধিকালীন অবস্থায় উপনীত হয় তখন হরমোনের আচরণগত প্রভাব স্পষ্ট হয়।

অনিয়ন্ত্রিত হরমোন ব্যবহারের ফলাফল (Result of Uncontrolled Use of Hormone)

দেহ সচল, কর্মক্ষম রাখতে অতি অল্প ও নির্দিষ্ট পরিমাণ হরমোন দেহে প্রয়োজন হয়। কারও দেহে পরিমিত হরমোন ক্ষরিত না হলে নানা জটিলতা দেখা দিয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট হরমোন ব্যবহার করতে হয়।  নিচে কয়েকটি প্রধান হরমোনের অনিয়মিত ব্যবহারের ফলাফল উল্লেখ করা হলো।

বৃদ্ধি হরমোন (Growth hormone) :

স্থিতিশীল ও বৃদ্ধিসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত বৃদ্ধি হরমোন ব্যবহারের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে প্রচুর ফ্যাট, ডায়াবেটিস‌, সন্ধি ব্যথা, হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়ায় হার্ট ফেইলিউর এবং হাত, পা, মাথার হাড় অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাওয়া।

থাইরক্সিন (Thyroxine) :

থাইরক্সিনের স্বল্পতা পূরণে যে সংশ্লেষিত হরমোন (Levothyroxine) ব্যবহার করা হয় তাতে কেবল থাইরয়েড হরমোন স্বল্পতাই পূরণ হয় না, সে সঙ্গে থাইরয়েড ক্যান্সার এবং গলগন্ড প্রতিরোধেও সহায়ক হয়। কিন্তু অতিমাত্রায় ব্যবহার হলে যেসব জটিলতা দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ ছদ্ম-গলগণ্ড হতে পারে; তা ছাড়া দ্রুত হৃৎস্পন্দন, চিন্তাগ্রস্ততা, খিটখিটে মেজাজ, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধাবৃদ্ধি প্রভৃতি। অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ায় শ্বাসকষ্ট, ঘনঘন শ্বাস নেয়া এবং মুখমন্ডল ও জিহবা ফুলে যায়। হার্ট ফেইলিউর এবং রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস মাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে।

 

এপিনেফ্রিন/অ্যাড্রেনালিন (Epinephrine/Adrenaline) :

ফুসফুসের ভিতরে বাতাস চলাচলের নালি খুলতে, রক্তবাহিকা সংকীর্ণ করতে এবং বিভিন্ন মারাত্মক অ্যালার্জিক ক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সংশ্লেষিত এপিনেফ্রিন ব্যবহৃত হয়। অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হলে দেখা দেয় উচ্চরক্তচাপ, সঙ্গে মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, দুঃশ্চিন্তা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বুকব্যথা, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, হঠাৎ দুর্বলতা, কথাবলা বা হাঁটাচলায় ভারসাম্যহীনতা, ঘনঘন শ্বাস নেয়া প্রভৃতি।

 

টেস্টোস্টেরন (Testosterone) :

এটি পুরুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হরমোন। এর স্বাভাবিক ক্ষরণে পুরুষ যৌনাঙ্গ সুগঠিত রাখে, গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ ঘটিয়ে পৌরুষ প্রদর্শন করে। বড়ি বা ইনজেকশনের মাধ্যমে টেস্টোস্টেরনের অভাব পূরণে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু এর অতিব্যবহারে প্রথমে দুর্বলতা, নিদ্রালুভাব, গায়ে ব্যথা, জ্বালাপোড়া ভাব, মনোযোগহীনতা, হাত-পায়ের আঙ্গুল ঠান্ডা হয়ে আসা প্রভৃতি দেখা দেয়। পরে শুক্রাশয়ে ব্যথা, দ্রুত বা মন্থর হৃৎস্পন্দন, মূত্রথলিতে ব্যথা, পিঠের দুপাশে বা মাঝখান ধরে ব্যথা, ডায়রিয়া প্রভৃতি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

ইস্ট্রোজেন (Estrogen) :

ইস্ট্রোজেন নারীদেহের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। পরিমিত ইস্ট্রোজেন নারী দেহকে সুস্থ, সবল ও সুদর্শন রাখে। কোন কারনে অপর্যাপ্ত হরমোন উৎপন্ন হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইস্ট্রোজেনবাহী বড়ি বা  ইনজেকশন ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এসব সামগ্রীর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে নারী বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে, যেমন- স্তন দৃড় হয়ে যাওয়া, ঢুলুঢুলুভাব, অতিরিক্ত রক্তস্রাব, মাথাব্যথা, মানসিক ভাবের পরিবর্তন, বমিভাব, ত্বকে ফুসকুড়ি, মূত্রের রং পরিবর্তন ইত্যাদি।

 

ইনসুলিন (Insulin) :

আজকাল অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন দিয়ে জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এর ব্যবহার কঠোর নিয়ন্ত্রণে না থাকলে নতুন নতুন জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা থাকে, যেমন হাইপোগ্লাইসেমিয়া, অবসাদ, ঢুলুঢুলুভাব, মাথাব্যথা, ক্ষুধা, মনোযোগে ব্যর্থ হওয়া, বমিভাব, স্নায়ুদৌর্বল্য, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন, দ্রুত হৃৎস্পন্দন, ঘুমে ব্যাঘাত, খিঁচুনি, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।