10 Minute School
Log in

প্রাণীর সমন্বয় প্রক্রিয়া (Animal Coordination Method)

আমাদের সারা শরীরের বিভিন্ন কাজের ভিতর সুসংবদ্ধতা আনার জন্য লক্ষ লক্ষ কোষের কাজের সমন্বয় সাধন ( Coordination ) করতে হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কাজের সমন্বয় সাধনের জন্য স্নায়ুতন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হরমোনাল প্রভাব (Hormonal effects)

প্রাণীর প্রয়োজনীয় সমন্বয় কাজ স্নায়ু ছাড়াও হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। হরমোনের কারণে প্রাণী তার কার্যকলাপ অর্থাৎ নড়াচড়া বা আচরণের পরিবর্তন করে থাকে। এই বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রচুর গবেষণা হয়েছে। নানা ধরনের নালিহীন গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়। নালিহীন গ্রন্থিগুলো একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার স্নায়ুতন্ত্র নালিহীন গ্রন্থির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কার্যক্রমে হরমোনকে যদি কারখানার শ্রমিক ধরা হয়, তাহলে সার্বিকভাবে কোন শ্রমিক কোথায়, কতক্ষণ কাজ করবে, সেটি যেরকম ব্যবস্থাপক নিয়ন্ত্রণ করেন, স্নায়ুতন্ত্রও তেমনি ব্যবস্থাপকের মতো হরমোনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। উল্টো দিকে স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ এবং কাজের উপর রয়েছে হরমোনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।

প্রথমে ধারণা ছিল, সব হরমোনই বুঝি উত্তেজক পদার্থ। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে সব হরমোন উত্তেজক নয়, এদের মধ্যে কিছু কিছু নিস্তেজকও আছে। হরমোন অতি অল্প পরিমাণে বিশেষ বিশেষ শারীরবৃত্তীয় কাজ বা পদ্ধতি

সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এরা উত্তেজক বা নিস্তেজক হিসেবে দেহের পরিস্ফুটন, বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন টিস্যুর কার্য নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তির আচরণ, স্বভাব এবং আবেগপ্রবণতার উপরও হরমোনের প্রভাব অপরিসীম। এগুলো রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে উৎপত্তিস্থল থেকে দেহেরদূরবর্তী কোনো কোষ বা অঙ্গকে উদ্দীপিত করে। এজন্য এদেরকে কখনো কখনো রাসায়নিক দূত (Chemical messenger) হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনে নানা প্রাণী হরমোন ব্যবহার করে। পিপড়া খাদ্যের খোঁজ পেলে খাদ্যের উৎস থেকে বাসায় আসার পথে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত করে, যাকে ফেরোমন বলে। এর উপর নির্ভর করে অন্য পিঁপড়াগুলোও খাদ্য উৎসে যায় এবং খাদ্য সংগ্রহ করে বাসায় ফিরে আসে। এ কারণে পিপড়াদের এক সারিতে চলাচল করতে দেখা যায়। খাদ্য শেষ হলে পিঁপড়া ফেরোমন নিস্বরণ বন্ধ করে দেয়, যা সহজেই বাতাসে উবে যায়, তখন অন্য পিপড়া আর খাদ্য সংগ্রহে যায় না। কোনো কোনো পতঙ্গ ফেরোমন দিয়ে তার স্বপ্রজাতির সঙ্গীকে খুঁজে পেতে পারে। দেখা গেছে কোনো কোনো পতঙ্গ বাতাসে ফেরোমন নিঃসৃত করলে 2-4 কিলোমিটার দূর থেকে তার সঙ্গীরা আকৃষ্ট হয়। তোমরা হয়তো ফেরোমন ব্যবহার করে পোকা ধ্বংসের ফাঁদ তৈরি করার কথা শুনেছ। এ পদ্ধতিতে ফেরোমনের কারণে আকৃষ্ট হয়ে অনিষ্টকারী পোকা ফাঁদে এসে পানিতে ডুবে মারা যায়। অনিষ্টকারী পোকা দমনে এ পদ্ধতিটিই খুবই পরিবেশবান্ধব।

স্নায়বিক প্রভাব (Nervous effects)

হাঁটাচলা, উঠাবসা, কথা বলা, চিন্তা করা, লেখা-পড়া করা, হাসিকান্না ইত্যাদি কাজ করার জন্য দেহের বিভিন্ন অঙ্গ অংশ নেয়। এ অঙ্গগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে একটি সমন্বয় ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। স্নায়ুতন্ত্র এবং হরমোনতন্দ্র মিলে দেহের এই কাজ পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় করে। যে তন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী উত্তেজনায় সাড়া দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে সংযোগ রাখে, তাদের কাজে শৃঙ্খলা আনে এবং শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, তাকেই স্নায়ুতন্ত্র বলে। আমাদের সারা শরীরের বিভিন্ন কাজের ভিতর সুসংবদ্ধতা আনার জন্য লক্ষ লক্ষ কোষের কাজের সমন্বয় সাধন (Co-ordination) করতে হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কাজের সমন্বয় সাধনের জন্য স্নায়ুতন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের দেহ চলে পরিবেশের উদ্দীপনায় সাড়া জাগানোর ফলে। দেহের বাইরের জগৎ হলো বাহ্যিক পরিবেশ এবং দেহের ভিতর হলো অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। বাহ্যিক পরিবেশের উদ্দীপক হলো আলো, গন্ধ, স্বাদ এবং স্পর্শ— এগুলো আমাদের চোখ, কান, নাক, জিহ্বা এবং ত্বকের অনুভূতিবাহী স্নায়ুপ্রান্তে উদ্দীপনা জাগায়। আবার অভ্যন্তরীণ পরিবেশের উদ্দীপক হলো চাপ, তাপ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তু। এরা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কেন্দ্রমুখী প্রান্তে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই দুই ধরনের উদ্দীপকই যে অনুভূতি কিংবা কেন্দ্রমুখী স্নায়ুতে তাড়না সৃষ্টি করে। এই তাড়না মস্তিষ্কে পৌঁছে, মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ্ঞাবাহী (বা মোটরস্নায়ু) এর মাধ্যমে পেশি কিংবা গ্রন্থিতে সাড়া জাগায় এবং কোনো কাজ করতে শতার সাহায্য করে।

 

স্নায়ুতন্ত্র (Nervous System) 

স্নায়ুতন্ত্র দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং তন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় করে, দেহের বিভিন্ন অংশে উদ্দীপনা বহন করে এবং দেহের উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে।

নীচে স্নায়ুতন্ত্রের বিন্যাস ছকে দেওয়া হলো:

[PICTURE]

কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (Central Nervous System) 

মস্তিষ্ক এবং মেরুমজ্জা (বা সুষুম্নকাণ্ড) দিয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠিত। মস্তিষ্ক করোটিকার মধ্যে সুরক্ষিত থাকে।

Animal Coordination Method

মস্তিষ্ক (Brain)

সুষুম্মাকাণ্ডের শীর্ষে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে স্ফীত অংশ করোটিকার মধ্যে অবস্থান করে তাকে মস্তিষ্ক বলে।

মস্তিষ্ক ৩টি অংশে বিভক্ত। যথা-

১. অগ্রমস্তিষ্ক।

২. মধ্যমস্তিষ্ক।

৩. পশ্চাৎমস্তিষ্ক।

 

১. অগ্রমস্তিষ্ক (Forebrain)

অগ্রমস্তিষ্ক

  • মস্তিষ্কের মধ্যে অগ্রমস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম সবচেয়ে বড় অংশ। সেরিব্রামকে গুরু মস্তিষ্ক বলা হয়।
  • সেরিব্রামের ডান অংশকে ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার ও বাম অংশকে বান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার বলে।
  • ডান ও বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার একগুচ্ছ নিউরন দিয়ে সংযুক্ত থাকে। একে কার্পাস ক্যালোসাম বলে।
  • সেরিব্রামের বাইরের স্তরের নাম কর্টেক্স। কর্টেক্সের অপর নাম গ্রে ম্যাটার বা ধূসর পদার্থ।
  • সেরিব্রামের ভিতরের স্তরটি সাদা রঙের মায়েলিন দ্বারা আবৃত। যাকে হোয়াইট ম্যাটার বলে।
  • বাম সেরিব্রালে হেমিস্ফিয়ার দেহের ডান অংশ এবং ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের বাম অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের এ অংশটির উপরিভাগ ঢেউ তোলা। এটি মেনেনজেস নামক পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে।

২. মধ্যমস্তিষ্ক (Midbrain)

  • এটি অগ্র ও পশ্চাৎ মস্তিষ্ককে সংযুক্ত করে।
  • মধ্যমস্তিষ্কের পিছনে অবস্থিত নলাকৃতি বৃহৎ অংশকের নাম পনস। এটি সেরিবেলাম ও মেডুলা অবলংগাটার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

কাজ (Function) :

  • বিভিন্ন পেশির কাজের সমন্বয় সাধন করে।
  • ভারসাম্য রক্ষা করে।
  • দর্শন ও স্রবণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. পশ্চাৎ মস্তিষ্ক (Hindbrain) 

  • এটি সেরিবেলাম, পনস ও মেডুলা অবলংগাটা নিয়ে গঠিত।
  1. i) সেরিবেলাম (Cerebellum) :

কাজ (Function) :

  • সেরিবেলাম দেহের পেশির টান নিয়ন্ত্রণ করে।
  • চলনে সমন্বয় সাধন করে।
  • দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে।
  • দৌড়ানো ও লাফানোর কাজে জড়ির পেশিগুলোর কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে।
  1. ii) পনস (Pons) :

  • মেডুলা অবলংগাটা এবং মধ্যমস্তিষ্কের মাঝখানে পনস অবস্থিত। এটি একগুচ্ছ স্নায়ুর সমন্বয়ে গঠিত।

iii) মেডুলা অবলংগাটা (Medulla Oblongata) :

  • এটি সামনের দিকে পনস এবং পিছনের দিক সুষুম্নাকাণ্ডের উপরিভাগের সাথে যুক্ত।
  • মেডুলা অবলংগাটা থেকে আট জোড়া করোটিক স্নায়ু উৎপন্ন হয়।
  • এই স্নায়ুগুলো স্রবণ ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনে কাজ করে।

 

মেরুরজ্জু (Spinal cord) 

 

Spinal cord

 

  • দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ছিদ্র দিয়ে মেরুরজ্জু থেকে ৩১ জোড়া মেরুরজ্জীয় স্নায়ু বের হয়।
  • এগুলা ঘাড়, গলা, বুক, পিঠ, হাত ও পায়ের স্নায়ু।
  • মেরুরজ্জুতে শ্বেত পদার্থ থেকে কার্টেক্স-এ এবং ভিতরের দিকে থাকে ধূসর পদার্থ।

 

নিউরন (Neuron)

প্রতিটি নিউরন দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা:

১. কোষদেহ।

২. প্রলম্বিত অংশ।

১. কোষদেহ (Cell body) :

  • কোষদেহ প্লাজমামেমব্রেন, সাইটোপ্লাজম এবং নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত।
  • গোলাকার, তারকাকার, ডিম্বাকার বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে।
  • সাইটোপ্লাজমে মাইটোকন্ড্রিয়া, গলজিবস্তু, লাইসোজোম, চর্বি, গ্লাইকোজেন ও রঞ্জক-কনাসহ অসংখ্য নিসল দানা থাকে।

 

Cell body

 

২) প্রলম্বিত অংশ (Elongated part) :

কোষদেহ থেকে সৃষ্ট শাখা- প্রশাখাকেই প্রলম্বিত অংশ বলে।

  1. i) ডেনড্রন (Dendron):
  • কোষদেহের চারদিকে শাখাযুক্ত ক্ষুদ্রক্ষুদ্র প্রলম্বিত অংশকে ডেনড্রন বলে।
  • ডেনড্রন থেকে যে শাখা বের হয় তাকে ডেনড্রাইট বলে।
  • ডেনড্রাইট অন্য নিউরন থেকে স্নায়ু তাড়না গ্রহন করে।
  1. ii) অ্যাক্সন (Axon) :
  • কোষ দেহ থেকে উৎপন্ন লম্বা তন্তুটিকে অ্যাক্সন বলে।
  • এর চারদিকে পাতলা আবরণটিকে নিউরিলেমা বলে।
  • নিউরিলেমা ও অ্যাক্সনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে স্নেহ পদার্থের স্তরটিকে মায়েলিন বলে।