10 Minute School
Log in

আলোকের অপবর্তন (Diffraction of light)

আলোকের অপবর্তন
(Diffraction of light)

আমরা জানি, স্বচ্ছ সমসত্ত্ব মাধ্যমে আলোক সরল পথে গমন করে কিন্তু আলোকের পথে একটি অস্বচ্ছ বস্তু স্থাপন করলে, অস্বচ্ছ বস্তুর পিছনে একটি কালো জায়গা পরিলক্ষিত হয়। এর নাম ছায়া। এই ছায়া সৃষ্টিই আলোকের রৈখিক গতির প্রমাণ। তবে ছায়াকে বিশেষভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, আলোকের রৈখিক গতির নিয়মানুসারে ছায়া যেমন হওয়া উচিত তা হয় না। ছায়ার কিনারা বরাবর কিছু অংশ আলোকিত দেখায়। এটি হতে প্রতীয়মান হয় যে, আলোক বস্তুর কিনারা দিয়ে সরল পথে গমন না করে সামান্য ঘুরে বাঁকা পথে চলে।

সংজ্ঞা : কোনো প্রতিবন্ধকের কিনারা বা ধার ঘেষে বা সরু চিড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলের মধ্যে আলোর বেঁকে যাওয়ার ঘটনাকে আলোর অপবর্তন(Diffraction of light) বলে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেলে এই ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শব্দ যেহেতু তরঙ্গধর্মী, সুতরাং শব্দেরও অপবর্তন হয় এবং একে শব্দের অপবর্তন(Diffraction of sound) বলে।

অপবর্তনের শর্ত (Conditions of diffraction)

অপবর্তন সৃষ্টির দুটি শর্ত রয়েছে; যথা—
(১) খাড়া ধারের (straight edge) ক্ষেত্রে : ধার খুব তীক্ষ্ম হতে হবে এবং এর প্রস্থ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য \lambda -এর সমান বা কাছাকাছি মানের হতে হবে।
(২) সরু ছিদ্রের ক্ষেত্রে : ছিদ্র খুবই সরু হতে হবে যাতে এর ব্যাস তরঙ্গদৈর্ঘ্যের \lambda -এর সমান বা কাছাকাছি
মানের হতে হয়।

আলোকের অপবর্তন দুই প্রকার। যথা—
(১) ফ্রেনেল শ্রেণি অপবর্তন (Fresnel’s class of diffraction) এবং
(২) ফ্রনহফার শ্রেণি অপবর্তন (Fraunhofers class of diffraction)।

ফ্রেনেল শ্রেণি অপবর্তন (Fresnel’s class of diffraction):

প্রতিবন্ধক বা ছিদ্র থেকে আলোক উৎস বা পর্দা অথবা উভয়ই সসীম দূরত্বে থাকলে যে সকল অপবর্তনের ঘটনাবলি ঘটে তাদের ফ্রেনেল শ্রেণি অপবর্তন বলে।

খাড়া ধারে (straight edge), সরু তারে (narrow wire) এবং অল্প পরিসর ছিদ্রে (narrow slit) এই ধরনের অপবর্তন ঘটে। এক্ষেত্রে আপতিত তরঙ্গমুখ গোলীয় বা সিলিন্ডার আকৃতির হয়।

ফ্রনহফার শ্রেণি অপবর্তন (Fraunhofers class of diffraction):

প্রতিবন্ধক বা ছিদ্র থেকে আলোক উৎস এবং পর্দা উভয়ই অসীম দূরত্বে থাকলে যে সকল অপবর্তন ঘটনাবলি ঘটে তাদের ফ্রনহফার শ্রেণি অপবর্তন বলে। এই অপবর্তনের ক্ষেত্রে তরঙ্গমুখ সমতল হয়ে থাকে। কোনো উত্তল লেন্সের ফোকাস তলে একটি আলোক উৎস স্থাপন করলে লেন্সে প্রতিসরণের পর সমান্তরাল রশ্মি গুচ্ছ উৎপন্ন হয় সেগুলোকে কোনো প্রতিবন্ধক বা চিড়ের ওপর আপতিত করে এ ধরনের অপবর্তন পাওয়া যায়। একক রেখা ছিদ্র বা চিড়ের (Single slit), যুগ্ম রেখা ছিদ্র (Double slit) এবং গ্রেটিং বা ঝাঁঝরি (Grating) দ্বারা এই অপবর্তন সৃষ্টি করা হয়।

একক রেখাচিত্রে ফ্রেনেল ও ফ্রনহফার অপবর্তন ঝালরের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কী ?

একক রেখাচিত্রে ফ্রনহফার ব্যতিচার ঝালরে কেন্দ্রীয় পট্টি সর্বদা উজ্জ্বল। কিন্তু ফ্রেনেল ব্যতিচার ঝালরের কেন্দ্রীয় পট্টি উজ্জ্বল কিংবা অন্ধকার হতে পারে, যা নির্ভর করে একক রেখাচিত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য অঞ্চলের সংখ্যার ওপর।

জোরে জোরে কথা বললে পাশের কক্ষ থেকে শোনা যায় অর্থাৎ অপবর্তন সৃষ্টি করে কিন্তু একটি সুচের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে আলোর অপবর্তন লক্ষ করা যায় না কেন, ব্যাখ্যা কর।

দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 4\times10^{-7}m থেকে 7\times10^{-7}m এবং শ্রুতিগোচর শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যথেষ্ট দীর্ঘ (প্রায় 1.6 cm থেকে 16 m পর্যন্ত) হয়। আমরা জানি, কোনো তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি হয় অপবর্তনের মাত্রা অর্থাৎ বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ তত বৃদ্ধি পায়। তাই ঘরের দরজা, জানালার ছিদ্র শব্দ তরঙ্গের গতিপথের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটায়। এই কারণে জোরে জোরে কথা বললে পাশের ঘর থেকে শোনা যায়। কিন্তু সুচের পিছনের ছিদ্রের আকার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক বড় হওয়ায় আলোর গতিপথের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটায় না, তাই এতে আলোর অপবর্তন সহজে দেখা যায় না।

একক রেখাছিদ্র বা চিড়ের জন্য অপবর্তন
(Diffraction at a single slit)

একক রেখাছিদ্রে বা চিড়ে ফ্রন্‌হফার অপবর্তন (Fraunhofer diffraction at a single slit) : মনে করি, AB একটি রেখা চিড় যার বেধ = a [চিত্র ]। 

diffraction-of-light

ধরি , λ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এক রঙা সমান্তরাল আলোক গুচ্ছ সমতল তরঙ্গমুখে AB ছিদ্রের ওপর লম্বভাবে আপতিত হলো। AB-এর মধ্য দিয়ে নির্গত আলোকগুচ্ছকে একটি উত্তল লেন্স L দ্বারা এর ফোকাস তলে MN পর্দার ওপর একত্রীভূত করা হয়। ফলে আপতনের অভিমুখে রেখাছিদ্রের মুখোমুখি একটি উজ্জ্বল কেন্দ্রীয় পট্টি এবং এর দুই পার্শ্বে এর সমান্তরালে একান্তরভাবে সজ্জিত অন্ধকার ও কম উজ্জ্বল কয়েকটি পট্টি সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় উজ্জ্বল পট্টির তুলনায় অন্যান্য উজ্জ্বল পট্টির ঔজ্জ্বল্য অনেক কম এবং বাইরের দিকে দ্রুত হ্রাস পায়। শুধু তাই নয়, পড়িগুলোর বেধ সমান থাকে না [চিত্র ]।

ব্যাখ্যা : AB রেখাচিত্রে অবস্থিত সমতল তরঙ্গমুখের প্রতিটি কণা সমদশাসম্পন্ন। ওই সব কণা হতে গৌণ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। যে সব আড় তরঙ্গ ব্যবর্তিত না হয়ে সোজা DO-এর সমান্তরালে গমন করে L লেন্স দ্বারা পর্দার O বিন্দুতে একত্রিত হয় তারা ওই বিন্দুকে খুব উজ্জ্বল বিন্দুতে পরিণত করে, এখানে AB রেখার ঠিক মধ্য বিন্দু D।

কারণ O বিন্দুতে পৌছতে তরঙ্গসমূহের কোনো পথ পার্থক্য থাকে না। তারা সমদশায় O বিন্দুতে পৌছে গঠনমূলক ব্যতিচার সৃষ্টি করে। এখানে O বিন্দুকে মুখ্য চরম বিন্দু (Principal maxima) বলা হয়। এই বিন্দুর ঔজ্জ্বল্য সর্বাধিক।

আবার কিছু সংখ্যক আড় তরঙ্গ θ কোণে ব্যবর্তিত হয়ে DP অভিমুখের সমান্তরালে চলে L লেন্স দ্বারা P বিন্দুতে একত্রিত হয়। এ ক্ষেত্রে আড় তরঙ্গসমূহ সমান পথ অতিক্রম করে না বলে P বিন্দুতে ওই সব তরঙ্গের দশা সমান হয় না। এই পথ পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য B বিন্দু হতে কোণে ব্যবর্তিত BQ রেখার ওপর AC লম্ব টানি। তা হলে, \angle PDO = \theta

\therefore   A ও B বিন্দু হতে নির্গত তরঙ্গের মধ্যে পথ পার্থক্য = BC
কিন্তু bc = AB \sin\theta = a \sin\theta
কাজেই, উজ্জ্বল বিন্দুর জন্য :
a \sin \theta=(2 n+1) \frac{\lambda}{2}                                                             
এবং অন্ধকার বিন্দুর জন্য :
a \sin\theta = n\lambda                                                                              
এখানে n একটি সংখ্যা এবং n = 1,2,3, 4 ইত্যাদি।

এখন a \sin\theta = n\lambda  হলে, সব তরঙ্গের দরুন P বিন্দুতে লব্ধি সরণ শূন্য হবে। কারণ A বিন্দু হতে নির্গত তরঙ্গ ও রেখাছিদ্রের মধ্যবিন্দু D হতে নির্গত তরঙ্গের মধ্যে পথ পার্থক্য হবে \lambda /2 এবং পরস্পরের প্রভাব নাকচ করে দিবে। এমনিভাবে তরঙ্গমুখের উভয় অর্ধের প্রতি দুটি অনুরূপ বিন্দুর (Corresponding points) মধ্যে পথ পার্থক্য \lambda /2 হয়ে ওই সব বিন্দু হতে নির্গত তরঙ্গগুলো পরস্পরের প্রভাব নাকচ করবে।

\therefore O বিন্দুর উভয় পার্শ্বে প্রথম অবম বিন্দুর (n = 1) ক্ষেত্রে অপবর্তন কোণ \theta   হলে,

a \sin\theta = \lambda  

বা, \sin\theta = \lambda / n  

তেমনি O বিন্দুর উভয় পার্শ্বে -তম অবম বিন্দুর ক্ষেত্রে অপবর্তন কোণ \theta_n হলে,

a \sin\theta_n = \lambda n  

L লেন্স হতে AB রেখাছিদ্র খুব নিকটে থাকলে অথবা L লেন্স হতে পর্দা বেশ দূরে থাকলে x_n = OP_n = মুখ্য চরম বিন্দু O হতে n-তম অবম বিন্দুর দূরত্ব এবং লেন্সের ফোকাস দূরত্ব f হলে আমরা পাই, 

\sin \theta_{n}=\frac{n \lambda}{a}=\frac{x_{n}}{f}  

বা, x_{n}=\frac{n \lambda f}{a}

উক্ত সমীকরণের সাহায্যে মুখ্য চরম বিন্দু হতে বিভিন্ন অবম বিন্দুর (n = 1, 2, 3 ইত্যাদি) অবস্থান পাওয়া যায়।

পূন: , a \sin \theta=\frac{3 \lambda}{2}, \frac{5 \lambda}{2}, \frac{7 \lambda}{2} \ldots \ldots \ldots \ldots \ldots \ldots(2 n+1) \lambda / 2

হলে ব্যাখ্যা করা যায় যে তারা O বিন্দুর উভয় পার্শ্বে আরও কতগুলো চরম বিন্দু উৎপন্ন করবে এবং পর্যায়ক্রমে তারা প্রতি দুটি অবম বিন্দুর মধ্যে অবস্থান করবে। এ সব চরম বিন্দুকে গৌণ বা সম্পূরক চরম বিন্দু (Secondary or Subsidiary maxima) বলে।

-তম গৌণ চরম বিন্দুর ক্ষেত্রে অপবর্তন কৌণ θ’n এবং O হতে ওই বিন্দুর দুরত্ব x^{\prime}_n   হলে,

a \sin \theta^{\prime}{ }_{n}=(2 n+1) \frac{\lambda}{2}=\frac{a \cdot x^{\prime} n}{f}                                                      

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মুখ্য চরম বিন্দুর উভয় পার্শ্বে অপবর্তনের দরুন পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অবম ও চরম বিন্দু গঠিত হচ্ছে। গৌণ চরম বিন্দুগুলোর উজ্জ্বলতা বা দীপন মাত্রা ক্রমশ হ্রাস পায়।

একক রেখাছিদ্র দ্বারা সৃষ্ট ফ্রনহফার অপবর্তন ঝালরের চরম ও অবম বিন্দুর শর্ত কী ?

একক রেখাছিদ্র দ্বারা সৃষ্ট ফ্রনহার অপবর্তন ঝালরে চরম ও অবম বিন্দুর শর্ত হলো-

কেন্দ্রীয় উজ্জ্বল পট্টি (\theta = 0) এর উভয় দিকে গৌণ চরম বিন্দুগুলির ক্ষেত্রে পথ পার্থক্য a \sin\theta = (2n+1)\frac{\lambda}{2^{\prime}} , যখন রেখাছিদ্রের বেধ = a, আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য = \lambda , অপবর্তন কোণ \theta এবং n = 1, 2, 3, ……। সঠিক হিসাব অনুযায়ী \text { a } \sin \theta=\pm 1^{\prime} 43 \lambda, \pm 2^{\prime} 46 \lambda \ldots \ldots  ইত্যাদি। অর্থাৎ গৌণ চরম বিন্দুগুলির মধ্যে দূরত্ব সমান নয়।

আবার অবম বিন্দুগুলির ক্ষেত্রে পথ পার্থক্য \text { a } \sin \theta=\pm \mathrm{n} \lambda , অর্থাৎ অবম বিন্দুগুলি পরস্পর সমদূরবর্তী,
যখন n = 1, 2, 3 …… ইত্যাদি।

আলোকের অপবর্তনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of diffraction of light)

১। একটি তরঙ্গমুখের বিভিন্ন অংশ হতে নির্গত গৌণ তরঙ্গসমূহের ব্যতিচারের ফলে অপবর্তন সৃষ্টি হয়।
২। অপবর্তন ঝালরে পট্টিগুলোর বেধ কখনও সমান হয় না।
৩। অপবর্তনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল পট্টি ও অন্ধকার পটিগুলোর অন্তর্বর্তী দূরত্বগুলো ক্রমাগত কমতে থাকে।
৪। অপবর্তনে অন্ধকার পট্টিগুলো সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে না। এতে সর্বদা কিছু আলো থেকে যায়।
৫। অপবর্তনে উজ্জ্বল পট্টিগুলোর প্রত্যেকটিতে আলোক প্রাবল্য কখনই সমান থাকে না। এই প্রাবল্যের মান কেন্দ্রীয় পট্টিতে সর্বাধিক হয় এবং উভয় পার্শ্বস্থ পট্টিগুলোতে এই প্রাবল্য ক্রমশ হ্রাস পায়।

আলোর অপবর্তন এবং ব্যতিচারের মধ্যে পার্থক্য
Distinction between diffraction and interference of light

ব্যতিচার অপবর্তন
১। একই উৎস হতে নির্গত দুটি সুসঙ্গত তরঙ্গমুখ থেকে প্রাপ্ত তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে ব্যতিচার সৃষ্টি তরঙ্গসমূহের উপরিপাতনের ফলে অপবর্তনের সৃষ্টি হয়। উৎস দুটি ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম হতে হবে। ১। একই তরঙ্গমুখের বিভিন্ন অংশ হতে নির্গত গৌণ তরঙ্গসমূহের উপরিপাতনের ফলে অপবর্তনের সৃষ্টি হয়।
২। ব্যতিচারে সৃষ্ট অন্ধকার ডোরাগুলোতে কোনো আলো থাকে না। ২। অপবর্তনে সৃষ্ট অন্ধকার ডোরাগুলো কখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার হয় না। এতে সব সময় কিছু আলো থাকে।
৩। ব্যতিচারে সৃষ্ট ডোরাগুলোর পথ সমান হতেও পারে, নাও পারে। ৩। অপবর্তনে সৃষ্টি ডোরাগুলো প্রস্থ সমান হয় না।
৪। ব্যতিচারে সৃষ্ট সকল উজ্জ্বল ডোরার তীব্রতা তথা উজ্জ্বলতা সমান হয়। ৪। অপবর্তনে সৃষ্টি সকল উজ্জ্বল ডোরার তীব্রতা সমান হয় না।