বলবিদ্যার প্রাথমিক ধারণা (Elementary Ideas of Mechanics) | Part 2
‘বলবিদ্যা’(Mechanics) শব্দটির বিশ্লেষণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়-বল সংশ্লিষ্ট জ্ঞান। সুতরাং বলবিদ্যা অধ্যয়ন করলে, বল দি, তার প্রকারভেদ এবং প্রয়োগ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন সম্ভব। আমরা জানি প্রয়োজন, উদ্দীপনা ও উৎসাহ এই তিনটি বিষয়ের কারণেই মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কার করে চলেছে। বর্তমান এই আধুনিক বিশ্বের অতি সহজসাধ্য দুইটি শব্দ হচ্ছে, বস্তুর স্থিতি ও গতি, এই শব্দযুগল সম্পর্কে গাণিতিক ধারণা পাওয়ার জন্য ‘বল’ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন অত্যাবশ্যক।
বস্তুর স্থিতি ও গতি (State and Motion of an object):
যদি সময়ের পরিবর্তনে কোনো বস্তু তার পারিপার্শ্বিক বস্তুসমূহের সাপেক্ষে অবস্থান পরিবর্তন করে তবে বস্তুটিকে স্থিতিশীল বা স্থির বস্তু এবং বস্তুর অবস্থাকে স্থিতি অবস্থা বলা হয়। আর যদি পারিপার্শ্বিক বস্তুসমূহের সাপেক্ষে অবস্থান পরিবর্তন করে তবে ঐ বস্তুটিকে গতিশীল বস্তু এবং তার অবস্থাকে গতিশীল অবস্থা বলা হয়।
দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মতে, ‘বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোনো বস্তুই স্থির নয়। কেননা সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ ও নক্ষত্র গতিশীল। তাহলে স্থিতির প্রসঙ্গ কেন আসছে, এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝানোর জন্য নিম্নের উদাহরণ দেওয়া হলো:
ক্লাসে পাঠদানের সময় শিক্ষক চেয়ারে বসে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলেন, আমি স্থির না গতিশীল এর সঠিক উত্তর কী হবে? সঠিক উত্তর হলো- ‘গতিশীল’। কারণ, যে পৃথিবীতে দাড়িয়ে শিক্ষক পাঠদান করছেন সেই পৃথিবী প্রচণ্ড বেগে সূর্যের চতুর্দিকে এবং নিজ অক্ষের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করছে। কিন্তু যদি প্রশ্নটি এমন হতো, ‘আমি তোমাদের সাপেক্ষে স্থির না গতিশীল?’ তাহলে সঠিক উত্তর হতো ‘স্থির’। অর্থাৎ বস্তুর স্থিতি অবস্থা ও গতিশীল অবস্থা একটি আপেক্ষিক বিষয় যা Theory of Relativity নামে পদার্থবিদ্যা ও ফলিত গণিতের উচ্চতর শ্রেণিতে পাঠ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
আমরা বস্তুটিকে স্থির বা গতিশীল বলার জন্য অবশ্যই পারিপার্শ্বিক বা চতুর্দিকে অবস্থিত বস্তুর সাপেক্ষেই বিবেচনা করব। কারণ ব্যবহারিক জীবনে এটি আমাদের সর্বদা প্রয়োজন, অর্থাৎ এর গুরুত্ব অপরিসীম।
বল (Force):
যা কোনো স্থির বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তাকে গতিশীল করে বা করতে চায় এবং কোনো গতিশীল বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তার গতির পরিবর্তন করে বা করতে চায় তাকে বল(Force) বলা হয়। যেমন: একটি ফুটবল একজন খেলোয়াড় হতে অন্য খেলোয়াড়ের নিকট এমনিতেই যায় না। ফুটবলের উপর বল প্রয়োগের ফলেই সেটা ঘটে। আবার গোল করার লক্ষ্যে ফুটবলটি ছুড়ে দিলে গোলকিপার তা ধরে ফেলে এক্ষেত্রে তাকে বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।
বলবিদ্যা (Mechanics):
যে শাস্ত্রে কোনো বস্তুর স্থিতি বা গতিশীল অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাকে বলবিদ্যা(Mechanics) বলা হয়। বলবিদ্যা দুইটি অংশে বিভক্ত। যথা: (i) স্থিতি বিদ্যা, (ii) গতিবিদ্যা।
স্থিতিবিদ্যা (Statics):
বলবিদ্যার যে শাখায় স্থিতিশীল বস্তুর উপর কার্যরত বল সম্পর্কিত আলোচনা করা হয় তাকে স্থিতিবিদ্যা(Statics) বলা হয়।
গতিবিদ্যা (Dynamics):
বলবিদ্যার যে শাখায় গতিশীল বস্তুর উপর কার্যরত বল সম্পর্কিত আলোচনা করা হয় তাকে গতিবিদ্যা(Dynamics) বলা হয়।
বলের ক্রিয়াবিন্দুর স্থানান্তর বিধি (Transmissibility of point of application of force)
একটি বল কোনো জড়বস্তুর কোনো বিন্দুতে ক্রিয়া করলে যে ফলাফল পাওয়া যায় বস্তুর ওপর অবস্থিত ঐ বলের ক্রিয়া রেখার অপর যে কোনো বিন্দুতে একই ক্রিয়ারেখা বরাবর বলটিকে প্রয়োগ করা হলেও একই ফলাফল পাওয়া যাবে।
মনে করি, F বলটি কোনো জড় বস্তুর A বিন্দুতে AX রেখা বরাবর ক্রিয়া করে। AX রেখার উপর জড় বস্তুর ওপর একটি বিন্দু B নিই। এখন B তে BA এবং BX বরাবর দুইটি সমান বল F প্রয়োগ করি। সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগের ফলে বস্তুটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না।
এখন A বিন্দুতে হওয়ায় AB বরাবর কার্যরত F বল এবং B বিন্দুতে BA বরাবর কার্যরত F বল পরস্পর সমান ও বিপরীতমুখী হওয়ায় তারা একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করবে।
সুতরাং বস্তুটির উপর একমাত্র কার্যরত বল হলো B বিন্দুতে BX বরাবর ক্রিয়ারত F বল। এই বলটি A বিন্দুতে AX বরাবর ক্রিয়ারত F বলের সমান। অতএব বলের ক্রিয়াবিন্দু বলের কার্যরেখার যেকোনো বিন্দুতে ধরা যায়।
বলের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া (Action and Reaction if Forces) :
যখন কোনো বস্তু অপর একটি বস্তুর উপর ঠেস (বা হেলান) দেওয়া অথবা একটি বস্তু অপর কোনো বস্তুর উপর রাখা হয় অথবা একটি বস্তু যখন অপর একটি বস্তুকে আঘাত করে তখন বস্তুদ্বয়ের স্পর্শ বিন্দুতে উভয় বস্তুর উপরই একটি করে বল ক্রিয়া করে। প্রথম বস্তুটি দ্বিতীয় বস্তুর উপর যে বল প্রয়োগ করে তাকে ক্রিয়া এবং দ্বিতীয় বস্তুটি প্রথম বস্তুর উপর যে বল প্রয়োগ করে তাকে প্রতিক্রিয়া বলা হয়।
নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রানুসারে, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বলদ্বয় সমান ও বিপরীতমুখী। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য পাশের চিত্রটি লক্ষ করি:
একটি টেবিলের উপর একটি বই রাখা আছে। এখানে বইটি টেবিলের উপর যে বল প্রয়োগ করেছে ঠিক সমপরিমাণ। বল টেবিলও বই এর উপর প্রয়োগ করেছে। বই দ্বারা টেবিলে যে বল প্রয়োগ হয়েছে তাকে ক্রিয়া এবং টেবিল দ্বারা। বইয়ের যে বল প্রয়োগ হয়েছে তাকে প্রতিক্রিয়া বলা হয়। এখানে উভয় বলই বই ও টেবিলের সাথে পরস্পর লম্ব ।
বলবিদ্যায় ব্যবহৃত কয়েকটি প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা (Some essential definitions used in mechanics):
- অন্তঃকেন্দ্র (Incentre):
ত্রিভুজের অন্তঃস্থ কোণত্রয়ের সমদ্বিখণ্ডকত্রয়ের ছেদবিন্দুকে ত্রিভুজের অন্তঃকেন্দ্র বলা হয়। অন্তঃকেন্দ্র হলো ত্রিভুজে অন্তলিখিত বৃত্তের কেন্দ্র। ABC ত্রিভুজের অন্তঃকেন্দ্র I কেননা IA, IB, IC যথাক্রমে A,B ও C কোণকে সমদ্বিখণ্ডিত করে।
- পরিকেন্দ্র (Circumcentre):
ত্রিভুজের বাহুত্রয়ের লম্ব সমদ্বিখণ্ডকত্রয়ের ছেদবিন্দুকে ত্রিভুজের পরিকেন্দ্র বলা হয়। পরিকেন্দ্র হলো ত্রিভুজের পৱিলিখিত বৃত্তের কেন্দ্র। ∆ABC– এর পরিকেন্দ্র O; A,B,C হিন্দু হতে সমদূরবর্তী। OA=OB=OC এবং OD,OE,OF যথাক্রমে BC,CA,AB বাহুত্রয়ের লম্বদ্বিখণ্ডক ।
- ভরকেন্দ্র (Centroid):
কোনো ত্রিভুজের মধ্যমাত্রয়ের ছেদবিন্দুকে ত্রিভুজের ভরকেন্দ্র বলা হয়। ভরকেন্দ্রের প্রতিটি মধ্যমাকেই 2:1 অনুপাতে বিভক্ত করে। চিত্রে, G ভরকেন্দ্র; AD, BE CF মধ্যমা।
- লম্বকেন্দ্র (Orthocentre):
কোনো ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুত্রয় হতে বিপরীত বাহুর ওপর অঙ্কিত লম্বত্রয়ের ছেদবিন্দুই হলো লম্বকেন্দ্র। চিত্রে, ∆ABC এর লম্বকেন্দ্র H
দুইটি বলের লব্ধি :
সমবিন্দু বল: একাধিক বলের ক্রিয়ারেখা যদি একটি বিন্দুতে মিলিত হয়, তাহলে ঐ বলগুলিকে সমবিন্দু বল বলে। P, Q, R সমতলীয় বল তিনটির ক্রিয়ারেখা পরস্পর O বিন্দুতে মিলিত হওয়ায় তারা সমবিন্দু বল। কিছু সংখ্যক (সমতীয় বা ভিন্ন ভিন্ন তলীয়) বল যদি একটি বস্তুকণার উপর ক্রিয়া করে, তাহলে তারা সমবিন্দু বল।
বিভিন্ন প্রকারের বল (Different kinds of forces) :
উৎস বা প্রয়োগ ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে বলকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন:
- টান (Tension): কোনো বস্তুকে একটি সরু রশি বা তার দ্বারা টানা হলে ঐ রশি বা তার বরাবর বস্তুটির উপর যে বল ক্রিয়া করে তাকে টান বলা হয়।
চিত্রে W ওজনের একটি বস্তু P সুতা দিয়ে বেঁধে সুস্থিত রাখা হয়েছে। এখানে, BA বরাবর সুতার টান, T ক্রিয়াশীল থেকে P বস্তুটিকে ঝুলিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
- চাপ (Pressure): যখন একটি বস্তুকে অপর একটি বস্তুর উপর রাখা হয়, তখন প্রথম বস্তুটি দ্বিতীয় বস্তুর উপর যে বল প্রয়োগ করে তাকে চাপ বলা হয়।
- ঠেলা (Thrust): অনেক সময় দেখা যায় বাস (বা অন্য কোনো গাড়ী) কোনো স্থানে রাখা ছিল, এখন স্টার্ট দেওয়ার সময় স্টার্ট নিচ্ছে না। এমতাবস্থায় বাসটিকে কতকগুলি লোক বল প্রয়োগে সামনে বা পিছনে সরানোর চেষ্টা করে এবং গড়ালেই ড্রাইভার স্টার্ট করতে সক্ষম হন। এই ক্ষেত্রে যে বল প্রয়োগে গাড়ীকে গড়ানো হয় তাকে ঠেলা বা ধাক্কা বলা হয়।
- ঘর্ষণ (Friction): একটি বস্তু অপর একটি বস্তুর উপর দিয়ে (স্পর্শ করে) চলতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেমন- তুমি যদি একটি ফুটবলে শট দাও তবে তা কিছুক্ষণ ভূমিতে গড়ানোর পরে থেমে যাবে। ফুটবলটি নিশ্চয়ই কোনো বাধার কারণে থেমে গেছে। এখানে ভূমির স্পর্শে গড়ানোর কারণে যে বল বাধা হিসেবে কাজ করে তাকে ঘর্ষণ বল বা সংক্ষেপে ঘর্ষণ এবং যে বিন্দুতে স্পর্শ করে ঐ বিন্দুকে ঘর্ষণ বিন্দু বলা হয়।
- আকর্ষণ (Attraction): বাহ্যিক কোনো বল (যেমন- চাপ, ঠেলা, ধাক্কা) প্রয়োগ ব্যতিরেকে একে অপরকে স্পর্শ করেনি এরূপ দুইটি বস্তু যে বলের ক্রিয়ার কারণে একে অপরের দিকে অথবা যে কোনো একটি অপরটির দিকে অগ্রসর হয় বা হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয় তাকে আকর্ষণ বল বা সংক্ষেপে আকর্ষণ বলে। যেমন, একটি লৌহ খন্ড চুম্বকের আকর্ষণে চুম্বকের দিকে অগ্রসর হয়, পৃথিবীর আকর্ষণে বৃন্তচ্যুত ফল মাটিতে পড়ে।
- বিকর্ষণ (Repulsion): বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ ব্যতিরেকে একে অপরকে স্পর্শ করেনি এরূপ দুইটি বস্তু যে বলের ক্রিয়ার ফলে একটি অন্যটি থেকে সরে যায়, তাকে বিকর্ষণ বল বা সংক্ষেপে বিকর্ষণ বলে।চুম্বকের সমজাতীয় দুই মেরু কাছাকাছি আনলে চুম্বকদ্বয় পরস্পর হতে দূরে সরে যাবে। একে বিকর্ষণ বলা হয়।
- ওজন (Weight): কোনো বস্তুকে পৃথিবী তার কেন্দ্রের দিকে যে পরিমাণ আকর্ষণ বল দ্বারা টানে তাকে ঐ বস্তুর ওজন বলা হয়। বস্তুর ওজন সর্বদা বস্তুর ওপরস্থ একটি নির্দিষ্ট বিন্দু দিয়ে খাড়া নিচের দিকে ক্রিয়াশীল।ঐ নির্দিষ্ট বিন্দুটিকে বস্তুর ভরকেন্দ্র (Centre of gravity) বলা হয়।