10 Minute School
Log in

অস্থিভঙ্গ বা হাড়ভাঙ্গা,স্থানচ্যুতি, মচকানো এবং প্রাথমিক চিকিৎসা

অস্থিভঙ্গ বা হাড়ভাঙ্গা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা (Fracture of Bone and First Aid)

অস্থিভঙ্গ হচ্ছে এমন এক চিকিৎসাগত অবস্থা যেখানে রোগী অভিন্ন হাড়ের কোথাও ভেঙ্গে যাওয়াজনিত অসুস্থতায় ভোগে। প্রচন্ড শক্তি, চাপ কিংবা বিভিন্ন অসুখে (অস্টিওপোরোসিস, অস্থিক্যান্সার ইত্যাদি) ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ায় অস্থিভঙ্গ অবস্থার সৃষ্টি হয়। অস্থিভঙ্গ প্রধানত তিন ধরনের : সাধারণ, যৌগিক জটিল। 

সাধারণ হাড়ভাঙ্গা (Simple Fracture) 

যে ধরনের অস্থিভঙ্গে ভঙ্গ অস্থি চামড়া বিদীর্ণ করে বের হয় না তাকে সাধারণ অস্থিভঙ্গ বলে। এ ধরনের অস্থিভঙ্গ-এ হাড় শুধু দুই টুকরা হয়ে যায়, এর বেশি কিছু নয়। হাড় ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে না বলে এ ধরনের অস্হিভঙ্গের আরেক নাম বদ্ধ অস্থিভঙ্গ (closed fracture)।

যে ধরনের অস্থিভঙ্গে ভঙ্গ অস্থি চামড়া বিদীর্ণ করে বের হয় না তাকে সাধারণ অস্থিভঙ্গ বলে। এ ধরনের অস্থিভঙ্গ-এ হাড় শুধু দুই টুকরা হয়ে যায়, এর বেশি কিছু নয়। হাড় ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে না বলে এ ধরনের অস্হিভঙ্গের আরেক নাম বদ্ধ অস্থিভঙ্গ (closed fracture)।

  • সাধারণ অস্থিভঙ্গের লক্ষণ (Symptoms of Simple Fracture)
    • আঘাতপ্রাপ্ত স্থান সঙ্গে সঙ্গে ফুলে যায়।
    • রক্ত জমে কাল শিরা পড়ে।
    • আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গ নাড়াচড়া করতে ব্যাথা লাগে এবং ভিতরে সূঁচ ফুটার মতো ব্যথা অনুভূত হয়।
    • প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
    • সামান্য ভারী কোনো জিনিস তুলতে পারে না।
    • হাত, পা অসাড় হয়।
  • প্রাথমিক চিকিৎসা (First Aid)

অস্থিভঙ্গের কারণে দেহকষ্ট যেন না বাড়ে সে জন্য দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োজন। এ চিকিৎসা সম্বন্ধে অজ্ঞ কোনো ব্যক্তি যেন আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় হাতও না দেয় সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং দ্রুত যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে হবে তা হচ্ছে:

  • অস্থিভঙ্গের মাত্রা ও সঠিক স্থান চিহ্নিত করতে হবে।
  • আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির নড়াচড়া বন্ধ রাখতে হবে।
  • সমস্ত ক্ষত পরিষ্কার করতে হবে।
  • রক্ত সঞ্চালনে বাধা হতে পারে এমন টাইট জামা-কাপড়, গয়না-গাটি সরিয়ে ফেলতে হবে তা না হলে ভাঙ্গা হাড়ে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।
  • ভাঙ্গা হাড়ের জায়গায় রক্তপ্রবাহ, সংবেদন ও সংবেদন পরীক্ষা করতে হবে।
  • ভাঙ্গা হাড় যথাস্থানে বসানোর জন্য তার সঙ্গে কাঠের খন্ড বা বাঁশের চটি বেঁধে দিতে হবে।
  • রক্ত প্রবাহ ও সঞ্চালন পুনর্বার পরীক্ষা করতে হবে।
  • ভাঙ্গা হাড়ের জায়গাটি যেন ফুলে না উঠে সে জন্য আঘাত পাওয়া জায়গা ৬-১০ ইঞ্চি উঁচুতে রাখতে হবে।
  • অস্থিভঙ্গের জায়গায় বরফ দেওয়া যেতে পারে তবে দেখতে হবে জায়গাটি যেন ঠান্ডায় অসাড় না হয়ে যায়।
  • হঠাৎ ও মারাত্মক আঘাত পেয়েছে” আহত ব্যক্তি যেন এমনটি মনে না করে সে জন্য তাকে চাঙ্গা রাখতে হবে এবং মাথা, ঘাড় ও শরীরের বিভিন্ন অংশ সাবধানে নড়াচড়া করতে হবে।
  • অস্থিভঙ্গের জায়গায় বরফ দেওয়া যেতে পারে তবে দেখতে হবে জায়গাটি যেন ঠান্ডায় অসাড় না হয়ে যায়।
  • মানসিক আঘাতে কাহিল না হলে রোগীকে ব্যথানাশক ওষুধ দিতে হবে। দ্রুত আঘাতপ্রাপ্তির স্থল থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

পরবর্তী ধাপ হচ্ছে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসক প্লাস্টার লাগিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা ও চিকিৎসাপত্র দেবেন। দেখা গেছে, সাধারণ অস্থিভঙ্গ ৮ সপ্তহের মধ্যে সেরে যায়।

যৌগিক হাড়ভাঙ্গা (Compound Fracture)

যৌগিক হাড়ভাঙ্গা উন্মুক্ত হাড়ভাঙ্গা নামেও পরিচিত। সাধারণত খেলাধুলার সময় কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় এ ধরনের হাড়ভাঙ্গা ঘটে, তখন হাড়ের টুকরা চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসে। এটি বেশ জটিল হাড়ভাঙা কারণ এতে প্রচুর পরিমাণ রক্তপাত হয় এবং দ্রুত সংক্রমন ঘটে। যৌগিক হাড়ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও সাধারণ হাড়ভাঙ্গার মতো প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে, তবে তা ক্ষণকালীন। কারণ যৌগিক এত গুরুতর যা অস্ত্রোপচার ছাড়া বিকল্প চিকিৎসা নেই।

 

চিত্র-১৯ : বিভিন্ন ধরনের হাড়ভাঙ্গা

 

  • যৌগিক হাড়ভাঙ্গার প্রকারভেদ (Types of compound bone fractures):

    প্রকৃতির ভিত্তিতে যৌগিক হাড়ভাঙ্গাকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। 

ধরণ ১ : ক্ষতের পরিমাণ কম, চামড়ায় ১ সে.মি.-এর বেশি ক্ষত দেখা যায় না এবং রক্তপাত কম হয়।

ধরণ ২ :  ক্ষতের পরিমাণ বেশি, চামড়ায় ১ সে.মি.-এর বেশি ক্ষত, টিস্যুর ক্ষতি দেখা যায় না এবং চামড়ার তেমন ক্ষতি হয় না।

ধরণ ৩ : এক্ষেত্রে চামড়া, টিস্যু ও হাড়ের মারাত্মক ক্ষতি হয়। রক্তপাত, সংক্রমণ এড়াতে দ্রুত চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়।

  • যৌগিক হাড়ভাঙ্গার লক্ষণ (Symptoms of compound fractures:): হাড় ভেঙ্গে টিস্যু ও চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসা, প্রচুর রক্তপাত ও যন্ত্রণাময় ক্ষত সৃষ্টি হওয়া যৌগিক হাড়ভাঙ্গার লক্ষণ।

 

জটিল হাড়ভাঙ্গা (Complex Fracture)

জটিল হাড়ভাঙ্গার ফলে বেশ কয়েকটি হাড়, অস্থিসন্ধি, টেন্ডন ও লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যৌগিক হাড়ভাঙ্গার মতো এক্ষেত্রে হাড়ের টুকরা চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে থাকে। জটিল হাড়ভাঙ্গাকে নানা ধরনে ভাগ করা যায়, এর মধ্যে প্রধান দুটি হল:

১. বহু টুকরাবিশিষ্ট (Multi fragmentary fracture) : এক্ষেত্রে হাড় অনেকগুলো ছোট টুকরায় পরিণত হয়।

২. কয়েক টুকরাবিশিষ্ট (Comminuted fracture) : এ ধরনের জটিল হাড়ভাঙ্গায় হাড়ের টুকরাগুলো আগের

ধরনের চেয়ে সামান্য বড় এবং সংখ্যায় কম থাকে।

জটিল হাড়ভাঙ্গার লক্ষণাদি দেখে চিকিৎসক দ্রুত অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা নেবেন, তবে তার আগে এক্স-রে রিপোর্ট দেখে নিতে হয়। এ ধরনের হাড়ভাঙ্গা থেকে রক্ষা পেতে হলে সড়ক পথে সাবধানে চলাচল, উঁচু স্থান থেকে সাবধানে লাফ দেয়া, বয়স্কদের হাড় ভঙ্গুর হওয়ায় তাঁদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।  জটিল হাড়ভাঙ্গার ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে কিছু নেই। দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ছাড়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও পরিচর্যা অব্যাহত রাখা ছাড়া, প্রয়োজনে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে রাখা ও খোঁজ-খবর নেয়া ছাড়া কিছু করার নেই।

  • সন্ধির  আঘাত ও  প্রাথমিক  চিকিৎসা (Injuries of Joints  of  Bones  and First  Aid) :  দুই  বা ততোধিক অস্থির সংযোগ স্থলকে অস্থিসন্ধি (joints of bones) বলে। অস্থিসন্ধি ৩ প্রকার। যথা- 
  1. তন্তুময় বা অনড় অস্থিসন্ধি : এ ধরনের অস্থিসন্ধির মিলিত অস্থি দুটির প্রান্তদেশ শ্বেততন্ত্রময় টিস্যু (white fibrous tissue) দিয়ে পরস্পরের সাথে সংলগ্ন থাকে। ফলে অস্থিগুলো অনড় প্রকৃতির হয়। করোটিতে এ রকম সন্ধি দেখা যায়।
  2. তরুণাস্থিময় অস্থিসন্ধি বা আংশিক সচল অস্থিসন্ধি : এ রকম অস্থিসন্ধিতে মিলিত অস্থি দুটির প্রান্তদেশ পরস্পরের সঙ্গে তরুণাস্থি নিয়ে সংলগ্ন থাকে। পিউবিস সিমফাইসিস (শ্রোণিচক্রের দুটি পিউবিক অস্থির সংযোগ স্থল) এ ধরনের অস্থিসদ্ধি।
  3.  সাইনুভিয়াল বা সচল অস্থিসন্ধি : এ রকম অস্থিসন্ধির মিলিত অস্থি দুটি একটি তরল পূর্ণ গহ্বর দিয়ে পৃথক থাকে। এ তরল সংযুক্ত অস্থিদুটিকে সংঘর্ষণের আঘাত থেকে রক্ষা করে। অস্থির প্রাপ্ত আর্টিকুলার তরুণাস্থি দিয়ে বেষ্টিত থাকে। লিগামেন্ট অস্থি দুটিকে সংযুক্ত রাখে এবং টেনডন অস্থি দুটিকে পেশির  সঙ্গে

সংলগ্ন রাখে। এ ধরনের সন্ধি সচল প্রকৃতির। মানুষে অধিকাংশ অস্থি সন্ধি এ ধরনের সদ্ধি ইত্যাদি। যেমন-কাধের সন্ধি, কনুই সন্ধি, হাঁটু সন্ধি, গোড়ালি সন্ধি, আঙ্গুলের সন্ধি ইত্যাদি। 

দেহের সকল অস্থিসন্ধি অনন্য গড়ন ও সঞ্চালন ক্ষমতা নিয়ে মানবদেহকে সুস্থতা ও কর্মক্ষম। হাত-পায়ের লম্বা অস্থিগুলো বেশি ব্যবহৃত হয় বলে ক্ষতির ঝুঁকির মুখেও থাকে বেশি। আঘাতের লক্ষণের প্রকাশ ঘটে হালকা ব্যাথা প্রকাশের মাধ্যমে। অস্থিসন্ধি আঘাতপ্রাপ্ত হলে অস্থি, লিগামেন্ট ও অস্থিসদ্ধির অন্যান্য টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ক্ষতি তাৎক্ষণিক বা ক্ষণস্থায়ী হতে পারে দীর্ঘস্থায়ীও। এ বিষয়ে ধারণা অর্জনের জন্য নিচে স্থানচ্যুতি ও সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

স্থানচ্যুতি (Dislocation)

একটি অস্থিসন্ধিতে অবস্থিত দুটি অস্থির মধ্যে একটি সরে গেলে স্থানচ্যুতি ঘটে। সাধারণত প্রচন্ড আঘাতে স্থানচ্যুতি ঘটে। এর ফলে যে প্রচন্ড ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয় তাতে মনে হতে পারে হাড় হয়তো ভেঙ্গে গেছে। যে হাড়টি আঘাতে অস্থিসন্ধি বা সকেট থেকে সরে যায় জরুরী চিকিৎসা না করালে তার লিগামেন্ট ও স্নায়ুর ক্ষতি হয়ে পারে। অস্থিসন্ধিতে অবস্থান করে এমন যে কোনো হাড়ই স্থানচ্যুত হতে পারে, তবে সাধারণত কাঁধ, নিতম্ব ও আঙ্গুলের হাড়ে স্থানচ্যুতি বেশি ঘটে।

  • লক্ষণ (Symptoms):
    • স্থানচ্যুতির প্রাথমিক লক্ষণ হলো- ঐ অস্থি তার কাজে অক্ষম হয় অর্থাৎ ঐ অস্থি নড়াচড়া করা যায় না।
    • স্থানচ্যুতি ঘটলে ঐ স্থানটিতে প্রচণ্ড ব্যথা এবং রক্ত জমাট বেঁধে বিভিন্ন মাত্রার কাল শিরার সৃষ্টি হয়।
    • স্থানচ্যুতির কারণে অস্থি, অস্থিসন্ধি থেকে সরে যাওয়ার ফলে ঐ স্থানটি উঁচু হয়ে ফুলে থাকে।
    • কাঁধ ও নিতম্বের স্থানচ্যুতি ঘটলে হাত ও পা নড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
    • আঙ্গুলে স্থানচ্যুতি ঘটলে গোটা হাতই অকেজো হয়ে পড়ে।
    • স্নায়ু অথবা রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে অস্থি সন্ধি সাময়িকভাবে অবশ হয়ে যায়।
  • প্রাথমিক চিকিৎসা (First aid)
    • স্থানচ্যুত অস্থির নড়াচড়া বন্ধ করতে হবে।
    • কোনো অবস্থাতেই নিজেরাই চাপাচাপি করে বিচ্যুত অস্থিকে পূর্বের স্থানে বসানোর চেষ্টা করা যাবে না। এতে অস্থি সন্ধির চারিদিকের লিগামেন্ট, টেন্ডন পেশি ছিঁড়ে গিয়ে পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে। 
    • কাঁধ, কনুই সন্ধি বা গোড়ালিতে স্থানচ্যুতি ঘটলে বিচ্যুত অস্থিকে যথাস্থানে বসানোর পর ঐ স্থানে চটি বা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে হবে যাতে অস্থিটি আরও সরে না যায়।
    • ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হলে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে জীবাণুর সংক্রমণ রোধ করতে হবে।
    • স্থান ফুলে গেলে ফোলা কমানোর জন্য আইস প্যাক বা বরফ লাগাতে হবে।
    • ব্যথা উপশমের জন্য ভরা পেটে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করানো যেতে পারে।
    • দূর্ঘটনা যদি মারাত্মক হয় তবে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
  • প্রতিরোধ (Prevention)

দুর্ঘটনায় স্থানচ্যুতি হলে আঘাতের ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। তবে সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে স্থানচ্যুতির মতো যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। অতএব, খেলাধূলা, চলাফেরা বা যানবাহনে চলার সময় আগে থেকেই সতর্ক থাকলে এনেক গুরুতর ক্ষতি থেকে বাঁচা সম্ভব হয়।

মচকানো (Sprains)

অস্থিসন্ধিতে আঘাতের ফলে সন্ধিকে অবলম্বন দানকারী লিগামেন্টে সৃষ্টি হয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা টান কিংবা লিগামেন্ট ছিড়েও যেতে পারে। এমন অবস্থাকে সাধারণভাবে মচকানো নামে অভিহিত করা হয়। লিগামেন্ট হচ্ছে টিস্যু-নির্মিত স্থূল ব্যান্ড যা সন্ধিকে নির্দিষ্ট দিকে সঞ্চালনে অনুমতি দেয়। কিছু সন্ধি বিভিন্ন দিকে সঞ্চালিত হতে পারে। এ কারণে লিগামেন্টের একাধিক গুচ্ছ অস্থিসন্ধিকে সঠিক বিন্যাসে ধরে যেই অস্থিসন্ধির একটি লিগামেন্টে অতিরিক্ত টান পড়ে বা ছিঁড়ে যায় তখনই মচকানো ঘটে। বলা যেতে পারে, মচকানোর প্রাথমিক ধাপে লিগামেন্ট তন্তু সটান হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় ধাপে লিগামেন্টের কোনো অংশে চিড় ধরে। এবং শেষ ধাপে লিগামেন্ট সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যায়।

  • মচকানোর স্থান

মচকানোর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে গোড়ালিতে । দ্রুত ঘোরাতে বা মোচড়াতে গেলে গোড়ালির বাইরের ও পাশের অংশের লিগামেন্ট ছিঁড়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মচকায় গোড়ালি। সামান্য মচকানো সারিয়ে তোলা গেলেও গুরুতর মচকানোর কারণে অনেকের খেলোয়াড়ি জীবন অকালে শেষ হয়ে যায়। হাঁটুর ৪টি লিগামেন্ট কব্জাসন্ধির মতো কাজ করে। এগুলো সামনে-পিছনে-দুপাশে বিন্যস্ত হয়ে হাঁটুকে সচল ও সক্রিয় রাখে। হাঁটুর সামনের দিকে অবস্থিত লিগামেন্ট (anterior cruciate ligament, ACL) সম্পূর্ণ ছিঁড়ে গেলে সবচেয়ে ক্ষতিকর মচকানো ঘটে। গাড়ি দুর্ঘটনায় ঘাড় মচকানো রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। গাড়ি হঠাৎ থমকে যাওয়াতে মাথার প্রচন্ড ঝাঁকুনির ফলে এ মচকানোর সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে গ্রীবা কশেরুকাগুলোর ক্ষতি হয় না বরং যে সব লিগামেন্ট কশেরুকাগুলো যথাস্থানে রাখতে সাহায্য করে সেগুলোর ক্ষতি হয়। এর ফলে সাধারণত প্রচন্ড ব্যথা ও ঘাড় ফুলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, কিছু কখনও কখনও ঘাড় বেশি বেঁকে গেলে সুষুন্মা কান্ড (স্পাইনাল কর্ড) মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। কব্জি মচকে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। বেস বল, ফুটবল, বোলিং স্কেইটবোডিং, টেনিস প্রভৃতি খেলায় কব্জি মচকানো সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ বিপরীতমুখি উল্টে গেলে বৃদ্ধাঙ্গুলসহ যে কোনো আঙ্গুল মচকে যেতে পারে।

  • মচকানোর লক্ষণ (Symptoms of sprains)

মচকানোর প্রথম লক্ষণ হচ্ছে ব্যথা। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথা অনুভবের বিষয়টি দেরিতেও হতে পারে। যেমন- কোনো ব্যক্তি যদি ঘরের ভিতর রংয়ের কাজ করে এবং দিনের পর দিন হাতের উঠা-নামা চলে তাহলে অনেকদিন পর সে মচকানোর বিষয় টের পাবে। এর কারণ হচ্ছে প্রদাহ, ফুলে যাওয়া ও পেশি আক্ষেপ দেখা দিতে সময় লাগতে পারে। শরীরে ব্যথা হলেই ধরে নিতে হবে কোথাও গন্ডগোল হয়েছে। অর্থাৎ মস্তিষ্কে খবর পৌছে যায় কোন অস্থিসন্ধিতে ব্যাঘাত ঘটেছে এবং তার নিরাময় দরকার কাজ, ব্যায়াম, খেলাধুলা শেষে ব্যথা সৃষ্টির বিষয়টি নজরে আসে। সন্ধিতে আঘাত পাওয়ার কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে জায়গাটি ফুলে যায়। লিগামেন্ট তন্তু ছিঁড়ে গেলে রক্তপাত হয়। কিছু সময় পর চামড়ার উপরে কালশিরা পড়ে। মচকানোর জায়গায় ব্যথা ও ফুলে উঠার সঙ্গে সঙ্গে জায়গা ঘিরে পেশি-আক্ষেপের সৃষ্টি হয়, ফলে পেশি শক্ত হয়ে যায়। ব্যথা, ফোলা ও পেশি-আক্ষেপ মিলে হাঁটা-চলাই দায় হয়ে পড়ে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয় ।

  • প্রাথমিক চিকিৎসা (First Aid)

চিকিৎসা নির্ভর করে মচকানোর ধরণ ও ব্যাপকতার উপর। চিকিৎসকের পরামর্শে নন-স্টেরয়ডাল (non-steroidal) ওষুধ খাওয়া যেতে পারে ব্যথা কমানোর জন্যে । ভারী কিছু বহন করার ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। তবে প্রথমেই যা করতে হবে তা হচ্ছে মচকানো গুরুতর হলে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিশ্রাম হবে। গুরুতর মচকানোর ক্ষেত্রে বিশ্রাম নিতেই হবে এবং চারটি কাজ গুরুত্ব সহকারে করতে হবে। এ ৪টি কাজের ইংরেজী শব্দের প্রথম অক্ষর দিয়ে RICE নাম দিয়ে প্রচলিত আছে। বিশ্রাম (Rest) + বরফ (Ice) + দ্রুত পরিষ্কার (Compression) + উচ্চতায় রাখা (Elevation) = RICE 

  1. বিশ্রাম : মচকানো রোগীকে বিশ্রামে রাখতে হবে। কোনো অতিরিক্ত চাপ দেয়া যাবে না। গোড়ালি মচকালে খুব সাবধানে হাঁটতে হবে।
  2. বরফ : মচকানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা ও ফোলা সীমিত রাখতে আক্রান্ত স্থানে বরফ দিতে হবে। এক নাগাড়ে ৩-৪ বার ১০-১৫ মিনিট করে বরফ লাগাতে হবে। এর বেশি সময় দিলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। ক্ষত পরিষ্কার ক্ষত পরিষ্কার করে নতুন ব্যান্ডেজ এমনভাবে লাগিয়ে নিতে হবে যেন সন্ধিটি অনড় ও সঠিক অবলম্বনে থাকে। এ কাজটি অভিজ্ঞ নার্স দিয়ে করানো ভাল।
  3. উচ্চতায় রাখা : মচকানো সন্ধিটি দেহের বাকি অংশের চেয়ে সামান্য উঁচুতে তুলে রাখতে হবে। এতে ফোলা কমে যাবে।