আলোকের ব্যতিচার (Interference of light)
আলোকের ব্যতিআলোকের ব্যতিচার (Interference of light)চার এর ধারণা (Concept of Interference of light) :
আমরা জানি, যখন দুটি সমান বিস্তার ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দ চলতে চলতে একে অপরের ওপর আপতিত হয় তখন শব্দের প্রাবল্যের পর্যায়ক্রমিক হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে। এ অধ্যায়ে আমরা লক্ষ করব আলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। ইহাই আলোর ক্ষেত্রে ব্যতিচার। আলোকের ব্যতিচার আলোচনা করার পূর্বে (ক) তরঙ্গের উপরিপাতন এবং (খ) সুসঙ্গত আলোক উৎস কী—তাই আলোচনা করব।
(ক) তরঙ্গের উপরিপাতন (Superposition of waves) : দুটি তরঙ্গ কোনো মাধ্যমের কোনো একটি কণাকে একই সঙ্গে অতিক্রম করলে প্রতিটি তরঙ্গই কণাটিকে স্থানান্তরিত করবে। ফলে কণাটির একটি লব্ধি সরণ ঘটবে। এই লব্ধি সরণ তরঙ্গ দুটি কর্তৃক পৃথক পৃথক সরণের বীজগাণিতিক যোগফলের সমান হবে। একে তরঙ্গের উপরিপাতন বলে।
মনে করি দুটি তরঙ্গ কোনো মাধ্যমের কোনো একটি কণাকে একই সঙ্গে অতিক্রম করল। ধরি, তরঙ্গ দুটি কর্তৃক কণাটির পৃথক পৃথক সরণ যথাক্রমে \gamma_1 ও \gamma_2 ।
যদি তরঙ্গ দুটি একই দশায় আপতিত হয়, তবে কণাটির লব্ধি সরণ \gamma = \gamma_1 + \gamma_2
আর তরঙ্গ দুটি যদি বিপরীত দশায় আপতিত হয় তবে লব্ধি সরণ \gamma = \gamma_1 - \gamma_2
(খ) সুসঙ্গত উৎস (Coherent source) : দুটি উৎস হতে সমদশাসম্পন্ন বা কোনো নির্দিষ্ট দশা পার্থক্যের একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দুটি আলোক তরঙ্গ নিঃসৃত হলে তাদেরকে সুসঙ্গত উৎস বলে।
আলোক উৎস দুটি হতে নিঃসৃত তরঙ্গুলির দশা পার্থক্য সব সময় একই থাকে এবং একটি তরঙ্গের দশার কোনো পরিবর্তন হলে অপরটিরও সম পরিমাণ দশা পরিবর্তন হতে হবে।
ব্যতিচার (Interference) :
দুটি সুসঙ্গত উৎস হতে নিঃসৃত দুটি আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে কোনো বিন্দুর আলোক তীব্রতা বৃদ্ধি পায় আবার কোনো বিন্দুর আলোক তীব্রতা হ্রাস পায়। এর ফলে কোনো তলে পর্যায়ক্রমে আলোক উজ্জ্বলতা বা অন্ধকার অবস্থার সৃষ্টি হয়। আলোর এই ঘটনাকে ব্যতিচার (Interference) বলে।
কোনো বিন্দুতে ওই তরঙ্গ দুটি একই দশায় আপতিত হলে অর্থাৎ ওই বিন্দুতে উভয় তরঙ্গের তরঙ্গশীর্ষ বা তরঙ্গপাদ আপতিত হলে ওই বিন্দুতে লধি বিস্তার তরঙ্গ দুটির বিস্তারের সমষ্টির সমান হবে।
যেহেতু প্রাবল্য বিস্তারের` বর্গের সমানুপাতিক, সেহেতু বিন্দুটি উজ্জ্বল দেখাবে। আবার, কোনো বিন্দুতে তরঙ্গ দুটি বিপরীত দশায় আপতিত হলে অর্থাৎ ওই বিন্দুতে একটি তরঙ্গের তরঙ্গশীর্ষ অপরটির তরঙ্গপাদ বা প্রথমটির তরঙ্গপাদ দ্বিতীয়টির তরঙ্গশীর্ষের সাথে মিলিত হলে লদ্ধি বিস্তার শূন্য হবে। ফলে বিন্দুটি অন্ধকার দেখাবে। এটিই আলোকের ব্যতিচার। আলোকের ব্যতিচার আলোকের তরঙ্গ তত্ত্ব সমর্থন করে। 1801 খ্রিস্টাব্দে টমাস ইয়ং (Thomas Young) আলোকের ব্যতিচার আবিষ্কার করেন। ব্যতিচার দুই ধরনের—
(১) গঠনমূলক ব্যতিচার ও (২) ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার।
গঠনমূলক ব্যতিচার (Constructive interference) : দুটি উৎস হতে সমান কম্পাঙ্ক ও বিস্তারের দুটি আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে উজ্জ্বল বিন্দু পাওয়া গেলে তাকে গঠনমূলক ব্যতিচার বলে। গঠনমূলক ব্যতিচারে তরঙ্গ দুটির উপরিপাতন সমদশায় হয়ে থাকে।
ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার (Destructive interference) : দুটি উৎস হতে সমান কম্পাঙ্ক ও বিস্তারের দুটি আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে অন্ধকার বিন্দু পাওয়া গেলে তাকে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে। ধ্বংসাত্মক ব্যতিচারে তরঙ্গ দুটির উপরিপাতন বিপরীত দশায় হয়ে থাকে।
গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক ব্যতিচারের শর্ত কী ?
যেসব বিন্দুতে উপরিপাতিত তরঙ্গদ্বয়ের পথ পার্থক্য \frac{\lambda}{2} এর অযুগ্ম গুণিতক, অর্থাৎ পথ পার্থক্য =(2n+1) \frac{\lambda}{2}, যখন \mathrm{n}=0, \pm 1, \pm 2 \ldots ইত্যাদি সেসব বিন্দুতে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচারের সৃষ্টি হবে।
আবার যেসব বিন্দুতে উপরিপাতিত তরঙ্গদ্বয়ের পথ পার্থক্য \frac{\lambda}{2} এর যুগ্ম গুণিতক, অর্থাৎ পথ পার্থক্য =2n \frac{\lambda}{2} যখন \mathrm{n}=0, \pm 1, \pm 2 \ldots ইত্যাদি সেসব বিন্দুতে গঠনমূলক ব্যতিচারের সৃষ্টি হবে।
ব্যতিচার ঝালর (Interference fringe) :
কোনো তলে বা পর্দায় ব্যতিচার ঘটানো হলে সেখানে অনেকগুলো পরস্পর সমান্তরাল উজ্জ্বল ও অন্ধকার রেখা বা পট্টি পাওয়া যায়। এই উজ্জ্বল ও অন্ধকার রেখা বা ডোরাগুলোকে এক সঙ্গে আলাোকের ব্যতিচার ঝালর বলে।
চিড় বা স্লিট (Slit)
দৈর্ঘ্যের তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র প্রস্থবিশিষ্ট আয়তাকার সরু ছিদ্রকে চিড় বা স্লিট বলে। ব্যতিচারের জন্য চিড়ের প্রস্থ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্রমের হতে হয়।
জানার বিষয় : আলো একটি আড় তরঙ্গ। ইহা ব্যতিচারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।
ব্যতিচারের শর্তাবলি (Conditions for interference) :
ব্যতিচারের জন্য নিম্নলিখিত শর্তাবলির প্রয়োজন-
১। আলোক উৎস দুটি সুসঙ্গত হতে হবে।
২। উৎস দুটি ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম হতে হবে।
৩। উৎস দুটি পরস্পরের খুব নিকটে হতে হবে।
৪। তরঙ্গ দুটির বিস্তার সমান বা প্রায় সমান হতে হবে।
৫। পর্যায়ক্রমিক উজ্জ্বল ও অন্ধকার বিন্দুর জন্য পথ-পার্থক্য যথাক্রমে অর্ধতরঙ্গদৈর্ঘ্যের (9/2) যুগ্ম ও অযুগ্ম গুণিতক হতে হবে।
উপরোক্ত শর্তসমূহ পালিত হলে ব্যতিচার পাওয়া যাবে।
আলোকের ব্যতিচারের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of interference) :
১। দুটি সুসঙ্গত উৎস হতে একই মাধ্যমের কোনো বিন্দুতে আলোক তরঙ্গমালার উপরিপাতনের ফলে ব্যতিচার সৃষ্টি হয়।
২। ব্যতিচার ঝালরে সাধারণত পট্টিগুলোর বেধ সমান হয়।
৩। ব্যতিচারে উজ্জ্বল পট্টি ও অন্ধকার পট্টিগুলোর অন্তর্বর্তী দূরত্বগুলো সমান থাকে।
৪। ব্যতিচারে অন্ধকার পট্টিতে কোনো আলো থাকে না। এরা সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে।
৫। ব্যতিচারে সব উজ্জ্বল পট্টিগুলোর আলোক প্রাবল্য সমান থাকে।