কোষের অভ্যন্তরীণ রোধ ও তড়িচ্চালক বল (Internal resistance and electromotive force)
কোষের অভ্যন্তরীণ রোধ ও তড়িচ্চালক বল (Internal resistance of a cell and electromotive force)
বিদ্যুৎ শক্তির বিভিন্ন উৎস রয়েছে, যেমন বিদ্যুৎ কোষ বা ব্যাটারি, জেনারেটর ইত্যাদি। এখন কোষ বা ব্যাটারির মধ্যে রাসায়নিক ক্রিয়া সংঘটনের মাধ্যমে সৃষ্ট আধান এর অভ্যন্তরে এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে প্রবাহিত হয়। এর ফলে কোষের এক প্রান্ত, ধনাত্মক এবং অপর প্রান্ত ঋণাত্মক আধান সমৃদ্ধ হয় [চিত্র]।
কোষের ভেতর তড়িৎ প্রবাহের দিক কোষের ঋণাত্মক পাত থেকে ধনাত্মক পাতের দিকে। এই পাতদ্বয়ের মধ্যকার বিভিন্ন উপাদান তড়িৎ প্রবাহকে বাধা প্রদান করে। এই বাধাকেই কোষের অভ্যন্তরীণ রোধ (internal resistance) বলে। একে ‘r‘ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
কোষের দুই প্রান্তে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের উপস্থিতির জন্য এদের মধ্যে বিভব পার্থক্য সৃষ্টি হয়। বহিঃবর্তনীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোষের দুই প্রান্তের সর্বোচ্চ বিভব পার্থক্যকে তড়িচ্চালক বল (electromotive force) বলা হয়।
কোষটি বহিঃবর্তনীর রোধ R_{1}-এর সঙ্গে সংযুক্ত করলে [চিত্র] R_{1}-এর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ চলবে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করলে বা কোষ নষ্ট না হলে বর্তনীতে এই প্রবাহ চলতে থাকবে অর্থাৎ কোষ হচ্ছে চালিকা শক্তি যা বিদ্যুৎ প্রবাহ বজায় রাখে।
সুতরাং তড়িচ্চালক বলের (electromotive force) সংজ্ঞা এভাবেও দেওয়া যায় যে চালিকা শক্তি বর্তনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ বজায় রাখে তাকে তড়িচ্চালক বল বলে। অন্যভাবে বলা যায় একক চার্জকে কোষ সমেত কোনো বর্তনীর এক বিন্দু থেকে সম্পূর্ণ বর্তনী ঘুরিয়ে আবার ওই বিন্দুতে নিতে যে কাজ সম্পন্ন করতে হয় তাকে ওই কোষের তড়িচ্চালক বল বা শক্তি (electromotive force) বলে। একে \varepsilon বা E দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
তড়িচ্চালক বলের একক (unit of electromotive force or emf) :
তড়িচ্চালক বলের একক হলো জুল/কুলম্ব (JC^{-1}), বা ভোল্ট (volt, V)। তবে ভোল্টই সর্বাধিক ব্যবহৃত একক। সুতরাং তড়িচ্চালক বল ও বিভব পার্থক্যের একক একই।
তড়িৎ বর্তনীর কোনো এক বিন্দু হতে 1 কুলম্ব চার্জকে তড়িৎ কোষসহ সম্পূর্ণ বর্তনী একবার ঘুরিয়ে পুনরায় ওই বিন্দুতে আনতে যত জুল কাজ সম্পন্ন করা হয় কোষের তড়িচ্চালক বল (electromotive force) হবে তত ভোল্ট (volt)।
সাধারণত টর্চে ব্যবহৃত প্রতিটি কোষের \mathrm{E}=1.5 \mathrm{~V}, অর্থাৎ কোষের অভ্যন্তরে রাসায়নিক ক্রিয়া কোষের ধনাত্মক প্রান্তের বিভব ঋণাত্মক প্রান্তের তুলনায় 1.5 \mathrm{~V} (বা 1.5 \mathrm{JC}^{-1}) বেশি রাখে। অন্যভাবে বলা যায়, 1 কুলম্ব চার্জকে ওই কোষ সমেত কোনো বর্তনীর এক বিন্দু হতে সম্পূর্ণ বর্তনী একবার ঘুরিয়ে ওই বিন্দুতে আনতে 1.5 \mathrm{~J} কাজ সম্পন্ন হয়।
বাস্তবে কোষের দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্য তড়িচ্চালক শক্তি E-এর চেয়ে কম হয়।
1 \mathrm{~mm}^{2} সুষম প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট একটি পরিবাহীর মধ্য দিয়ে 10 \mathrm{~A} তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে। পরিবাহীর প্রতি ঘন মিটারে মুক্ত ইলেকট্রন সংখ্যা 10^{28} হলে ইলেকট্রনের তাড়ন বেগ কত ?
আমরা জানি, \mathrm{I}=n \mathrm{Ave} \begin{aligned} v &=\frac{1}{n \mathrm{Ae}} \\ &=\frac{1}{10^{28} \times 10^{-6} \times 1.6 \times 10^{-19}} \\ &=6.25 \times 10^{-3} \mathrm{~ms}^{-1} \end{aligned} |
এখানে, \begin{array}{l} \mathrm{A}=1 \mathrm{~mm}^{2}=10^{-6} \mathrm{~m}^{2} \\ \mathrm{I}=10 \mathrm{~A} \\ e=1.6 \times 10^{-19} \\ n=10^{28} \mathrm{~m}^{3} \\ v=? \end{array} |
কোষের অভ্যন্তরীণ রোধ এবং তড়িচ্চালক বলের মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক (Relation between internal resistance and electromotive force)
কোষের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবাহ যে পরিমাণ বাধা পায় তাই কোষের অভ্যন্তরীণ রোধ (internal resistance)। যে সমস্ত পদার্থ দিয়ে উৎস তৈরি তা থেকে এ রোধ সৃষ্টি হয়। যেমন কোষের ক্ষেত্রে এর মধ্যে ব্যবহৃত সক্রিয় রাসায়নিক বস্তুর প্রকৃতি, কোষের পাতদ্বয়ের মাঝে দূরত্ব, এবং পাতদ্বয়ের আকার, কোষের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা ইত্যাদির ওপর অভ্যন্তরীণ রোধ r-এর মান নির্ভর করে। আবার জেনারেটরের ভেতরে ব্যবহৃত তার, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ইত্যাদির রোধ এর অভ্যন্তরীণ রোধ। বহিঃবর্তনীর রোধের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রোধ শ্রেণি সমবায়ে সংযুক্ত হয় (চিত্র) সুতরাং বর্তনীর মোট রোধ হবে R=R_{1}+r এখানে R_{1} হলো বহিঃবর্তনীর রোধ।
সাধারণত r-এর মান খুবই কম হয়। বর্তনীর প্রবাহমাত্রা I হলে, আমরা পাই,
\begin{aligned} \mathrm{I} &=\frac{\mathrm{E}}{\mathrm{R}_{1}+\mathrm{r}} \quad \text { এখানে } \mathrm{E} \text { কোষের তড়িচ্চালক বল। } \\ \text { বা, } \mathrm{E} &=\mathrm{IR}_{1}+\mathrm{I} r \\ &=\mathrm{V}+\mathrm{I} r \end{aligned}V এবং Ir যথাক্রমে বহিঃবর্তনীর রোধের দুই প্রান্তে বিভব পার্থক্য এবং কোষের অভ্যন্তরে r-এর জন্য বিভব পতন। V-কে বলা হয় প্রান্তীয় বিভব পার্থক্য (Terminal potential difference) বা ভোল্টেজ (voltage)।
অর্থাৎ বর্তনীতে প্রবাহ চলাকালীন কোষের প্রান্তদ্বয়ের মধ্যে বিভব পার্থক্যই V
সমীকরণ (3.13) হতে এটা স্পষ্ট যে, \mathrm{V}<\mathrm{E}
প্রান্তীয় ভোল্টেজ তড়িচ্চালক শক্তির (electromotive force) চেয়ে কম হওয়ার কারণ হলো যে কোষের অভ্যন্তরীণ রোধের (internal resistance) ভেতর দিয়ে প্রবাহ চালনা করার জন্য কিছু পরিমাণ তড়িচ্চালক বল প্রয়োজন হয়। এর ফলে কোষের ভেতর বিভব পতন ঘটে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কোষের দুই প্রান্তের মধ্যে Ir পরিমাণ বিভব পার্থক্য কমে যায়; অর্থাৎ Ir পরিমাণ ভোল্ট বহিঃবর্তনীতে কোনো কাজে আসে না, বরং নষ্ট হয়। এজন্য Ir-কে নষ্ট ভোল্ট (Lost volt) বলা হয়। নষ্ট ভোল্ট, \mathrm{Ir}=\mathrm{E}-\mathrm{V}.
সমীকরণ (3.13) অনুসারে বহিঃবর্তনী রোধ \mathrm{R}_{1} ক্ষুদ্র মানের হলে প্রান্তীয় বিভব তড়িচ্চালক শক্তির তুলনায় অনেক ছোট হয়। আবার R1 যখন খুব বড় মানের হয় তখন প্রান্তীয় বিভব তড়িচ্চালক শক্তির প্রায় সমান হয়। সমীকরণ (3.13)-এ I = 0 হলে,
\mathrm{E}=\mathrm{V} হবে।
অর্থাৎ, যখন বহিঃবর্তনীতে কোনো প্রবাহ থাকে না, অর্থাৎ বর্তনী খোলা অবস্থায় থাকে, তখন কোষের দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্য ওই কোষের তড়িচ্চালক শক্তির সমান হয়।
বর্তনীতে অভ্যন্তরীণ রোধের কাজ কী ? বিদ্যুৎ প্রবাহ চলার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রোধের ভূমিকা কী ?
অভ্যন্তরীণ রোধের কাজ হলো কোষের ঋণাত্মক প্রান্ত হতে ধনাত্মক প্রান্তে ইলেকট্রনের প্রবাহে বাধা প্রদান করা। বিদ্যুৎ প্রবাহ (i) এবং তড়িচ্চালক বলের মধ্যে সম্পর্ক হলো i=\frac{E}{R+r} । এই সমীকরণ থেকে বোঝা যায় যে, বহিঃবর্তনীর রোধ R নির্দিষ্ট হলে তড়িৎ প্রবাহ i কেবলমাত্র কোষের তড়িচ্চালক বল E-এর ওপর নির্ভর করে না। এর অভ্যন্তরীণ রোধ r এর ওপরও নির্ভরশীল হয়। কাজেই কোনো কোষ হতে উচ্চ মাত্রায় তড়িৎ প্রবাহ পেতে হলে এর অভ্যন্তরীণ রোধ স্বল্প হওয়া প্রয়োজন। কোনো কোষের দুই প্রান্ত নগণ্য রোধবিশিষ্ট (R=0) তামার মোটা পাত দ্বারা যুক্ত করলে উহা সর্বাধিক তড়িৎ প্রবাহ প্রদান করে।
কোনো তড়িৎ কোষের প্রান্তীয় বিভব তার তড়িচ্চালক বলের সমান হয় কী?
কোষের তড়িচ্চালক বল, \mathrm{E}=\mathrm{V}+ ir এখানে V= প্রান্তীয় বিভব এবং r= অভ্যন্তরীণ রোধ। প্রান্তীয় বিভব, V=E-i r। সুতরাং দুটি শর্তে V=E হতে পারে।
(i) r=0 অর্থাৎ কোষটির অভ্যন্তরীণ রোধ শূন্য হলে—যা বাস্তবে সম্ভব নয়।
(ii) i=0 অর্থাৎ কোষটির মধ্য দিয়ে কোনো তড়িৎ প্রবাহ না গেলে। মুক্ত বা খোলা বর্তনীতে এ ঘটনা ঘটে।