জাংশন ট্রানজিস্টর (পি-এন-পি ও এন-পি-এন) | Junction Transistor (p-n-p and n-p-n)
জাংশন ট্রানজিস্টর (পি-এন-পি ও এন-পি-এন) | Junction Transistor (p-n-p and n-p-n)
ট্রানজিস্টর হচ্ছে তিন প্রান্তবিশিষ্ট একটি অর্ধপরিবাহী ডিভাইস যার অন্তর্মুখী (Input) প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। বহির্মুখী (output) প্রবাহ, বিভব পার্থক্য এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দুটি অর্ধপরিবাহী ডায়োডকে পাশাপাশি যুক্ত করে একটি অর্ধপরিবাহী ট্রায়োডে বা ট্রানজিস্টর তৈরি করা হয়। 1948 সালে আমেরিকার বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরির তিনজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বার্ডিন (Bardeen), ব্র্যাটেন (Brattain) এবং শকলে (Shockley) ট্রানজিস্টর আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য 1966 সালে তাদেরকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
গঠন (Construction)
একখণ্ড বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহী থেকে উচ্চতাপে বিশেষ নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ট্রানজিস্টর তৈরি করা হয়। সাধারণত পয়েন্ট কন্টাক্ট (Point contact) ট্রানজিস্টর ও জাংশন (Junction) ট্রানজিস্টর এই দুই ধরনের ট্রানজিস্টর তৈরি হয়।
তবে বর্তমানে ব্যবহৃত সমস্ত ট্রানজিস্টরই জাংশন ট্রানজিস্টর। ট্রানজিস্টর দুই ধরনের (ক) n-p-n ট্রানজিস্টর ও (খ) p-n-p ট্রানজিস্টর। ট্রানজিস্টরের ৩টি অংশ বা এলিমেন্ট (element) থাকে; যথা-এমিটার (emitter) বা নিঃসারক (E), বেস (base) বা পীঠ (B) এবং কালেক্টর (collector) বা সংগ্রাহক (C)। চিত্রে n-p-n ও p-n-p ট্রানজিস্টরের ব্লক (block) চিত্র এবং প্রতীক চিত্র দেখানো হলো।
দুটি পৃথক n-টাইপ কেলাসের মাঝখানে একটি p-টাইপ কেলাস বিশেষ পদ্ধতিতে পাশাপাশি রেখে যুক্ত করলে n-p-n ট্রানজিস্টর গঠন করা হয়। আবার দুটি পৃথক p-টাইপ কেলাসের মাঝখানে একটি n-টাইপ কেলাস যুক্ত করলে p-n-p ট্রানজিস্টর গঠন করা হয়। এই জোড়া লাগানো আঠা বা সোল্ডার করে করা হয় না। দুটি p-টাইপ অর্ধপরিবাহী এবং দুটি n-টাইপ অর্ধপরিবাহীর মাঝে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে যথাক্রমে n-টাইপ এবং p-টাইপ অর্ধপরিবাহী ডোপিং করে বা মিশিয়ে n-p-n বা p-n-p ট্রানজিস্টর তৈরি করা হয়। ট্রানজিস্টরের মাঝের বেস অংশ খুবই পাতলা এবং সামান্য পরিমাণে অপদ্রব্য মিশ্রণ করা হয়, যাতে এমিটার থেকে বাহক আধান (charge carrier) প্রবাহের সময় কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় এবং বিপরীত আধানের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিরপেক্ষ না হয়। এমিটার অংশ বেশ পুরু (thick) এবং বেশি পরিমাণে ডোপড (doped) বা ডোপায়িত করা হয়। কালেক্টর সবচেয়ে বেশি পুরু করা হয় যাতে উৎপন্ন তাপ তাড়াতাড়ি বিকিরিত হয়। ট্রানজিস্টরে দুটি জাংশন থাকে। যথাঃ- এমিটার-বেস জাংশন এবং অপরটি বেস-কালেক্টর জাংশন। পূর্বে বলা হয়েছে যে, দুটি p-n জাংশনের সমন্বয়ে একটি ট্রানজিস্টর গঠিত হয়। একটিকে সম্মুখ ঝোঁক বা বায়াস যুক্ত এবং অপরটিকে বিপরীত ঝোঁক বা বায়াস যুক্ত করা হয়। সম্মুখ বায়াস যুক্ত জাংশনের রোধ বিপরীত বায়াস যুক্ত জাংশনের। তুলনায় খুবই নগণ্য। দুর্বল সিগন্যাল (signal) বা সঙ্কেতকে কম রোধসমৃদ্ধ জাংশন বর্তনীতে প্রয়োগ করা হয় এবং উচ্চ রোধযুক্ত জাংশন বর্তনী থেকে আউটপুট নেয়া হয়।
একটি ট্রানজিস্টর একটি সিগন্যালকে স্বল্প রোধ থেকে উচ্চ রোধে ট্রান্সফার (transfer) করে। এটি রেজিস্ট্যান্সের (resistance) বা রোধের মাধ্যমে কারেন্ট ট্রান্সফার করে বলে এর নামকরণ ট্রান্সফার রেজিস্টর। (transfer resistor) সংক্ষেপে ট্রানজিস্টর (transistor) করা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় তিন প্রান্তবিশিষ্ট যে ক্ষুদ্র অর্ধ-পরিবাহক পদার্থে বহির্মুখী প্রবাহ, ভোন্টেজ এবং ক্ষমতা অন্তর্মুখী প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে ট্রানজিস্টর বলে। ট্রানজিস্টর আকারে অত্যন্ত ছোট হয় এবং ধাতব বা প্লাস্টিক আবরণের মধ্যে এটিকে সিল (seal) করে রাখা হয় যাতে বায়ু বা জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে না আসে।
ট্রানজিস্টরের ঝোঁক ব্যবস্থা :
নিঃসারক (Emitter) : ট্রানজিস্টরের একপাশের অংশ যা চার্জ সরবরাহ করে তাই একে নিঃসারক বলে। বর্তনীতে পীঠ এবং নিঃসারক সর্বদা সম্মুখী ঝোঁক বা বায়াসে সংযোগ দেওয়া হয়। ফলে নিঃসারক বর্তনীর রোধ কম হয়।
সংগ্রাহক (Collector) : ট্রানজিস্টরের অন্যপাশের অংশ যা চার্জ সংগ্রহ করে তাই একে সংগ্রাহক বলে। বর্তনীতে সংগ্রাহক এবং পীঠ সর্বদা বিপরীত ঝেকে সংযোগ দেওয়া হয়। ফলে সংগ্রাহক বর্তনীতে রোধ বেশি হয়।
পীঠ বা ভূমি (Base) : ইহা নিঃসারক ও সংগ্রাহকের মাঝের অংশ বলে একে পীঠ বা ভূমি বলে। ট্রানজিস্টরের পীঠ নিঃসারকের তুলনায় খুবই পাতলা হয়।
ট্রানজিস্টরের উপযোগিতা কী ? এর কোনো অসুবিধা আছে কী ? কি কি কাজে ইহা ব্যবহার করা হয় ?
ট্রানজিস্টরের উপযোগিতা হলো : (১) আকার খুব ছোট; (২) এটি খুব সামান্য বিভবে কাজ করে; (৩) এর ক্রিয়া তাৎক্ষণিক; (৪) এটি দীর্ঘস্থায়ী; (৫) এটি যান্ত্রিক কম্পন সহ্য করতে পারে এবং (৬) এটি খুব সস্তা।
ট্রানজিস্টরের অসুবিধা : (১) এটি উষ্ণতায় খুব সুগ্রাহী এবং (২) এটি খুব কম উৎপাদন শক্তি দেয়।
ব্যবহার : তড়িৎ সংকেত বিবর্ধন করতে, উচ্চ গতি সুইচ হিসেবে ট্রানজিস্টর ব্যবহৃত হয়।
উচ্চ কম্পাঙ্কযুক্ত এবং কম্পিউটার বর্তনীতে n-p-n ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয় কেন ?
বাহক হিসেবে হোলের তুলনায় ইলেকট্রনের দ্রুতি বেশি। n-p-n ট্রানজিস্টরে সংখ্যাগুরু বাহক হলো ইলেকট্রন, তাই উচ্চ কম্পাঙ্কযুক্ত এবং কম্পিউটার বর্তনীতে n-p-n ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয়।
কার্যক্রম (Working process)
n-p-n ট্রানজিস্টর :
এখানে একটি n-p-n ট্রানজিস্টরের কার্যপ্রণালি ব্যাখ্যা করা হলো। চিত্রে n-p-n ট্রানজিস্টরের বৈদ্যুতিক বর্তনী দেখানো হয়েছে। চিত্রে বামদিকের এমিটার বেস জাংশনকে সম্মুখ ঝোঁকে রাখা হয়েছে। ফলে p-অঞ্চল n-অঞ্চলের তুলনায় বেশি ধনাত্মক হচ্ছে। এর ফলে n অঞ্চলের ইলেকট্রনগুলো সহজেই p অঞ্চলে চলে আসতে পারে। অর্থাৎ, এমিটার থেকে ইলেকট্রনগুলো বেসে চলে আসে। ফলে ইমিটার বা নিঃসারক প্রবাহ I_{E}সৃষ্টি হয়। ইলেকট্রনগুলো p-টাইপ বেসে বা পীঠে প্রবেশ করার ফলে সেখানকার হোল-এর সাথে মিলতে চায়। কিন্তু বেস খুব পাতলা হওয়ার কারণে সামান্য কিছু ইলেকট্রন (5% প্রায়) হোল-এর সাথে মিলিত হয়ে খুব ক্ষুদ্র বেস প্রবাহ I_{B}সৃষ্টি করে।
ডানদিকের বেস কালেকটর জাংশনকে বিপরীত ঝেকে রাখায় কালেকটর অঞ্চল বেশি ধনাত্মক হয় এবং এমিটার থেকে। বেসে প্রবাহিত ইলেকট্রনগুলোকে তীব্রভাবে n-অঞ্চলের দিকে আকর্ষণ করে। অর্থাৎ, স্তর বা কালেকটর (সংগ্রাহক) ইলেকট্রন সংগ্রহ করে। বেসের ভেতর দিয়ে আসার সময় কিছু সংখ্যক ইলেকট্রন বেস অঞ্চলের ‘হোল’ (hole) পূরণ করে; অবশিষ্ট ইলেকট্রন প্রায় 95% কালেক্টর অঞ্চলে ছুটে যায় এবং বেস থেকে কালেকটরে তড়িৎ প্রবাহ I_{C}সৃষ্ট হয়। বেস অঞ্চলে যাতে খুব সামান্য পরিমাণে ইলেকট্রন হোলের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিরপেক্ষ হয়, সে কারণে বেসকে হাল্কা ডোপিং করে হোলের সংখ্যা কম করা হয়। বেস বা পীঠ অঞ্চল পাতলা হওয়ার কারণে ইলেকট্রনের অবস্থান ও সংখ্যা সংরক্ষিত হয়।
এভাবে প্রায় সম্পূর্ণ এমিটার বা নিঃসারক প্রবাহ কালেকটর বা সংগ্রাহক বর্তনীতে প্রবাহিত হয়। সুতরাং দেখা যায় ইমিটার প্রবাহ হলো বেস প্রবাহ ও কালেকটর প্রবাহের সামষ্টি। অর্থাৎ, I_{E}=I_{B}+I C
p-n-p ট্রানজিস্টর:
(ক) ও (খ) চিত্রে p-n-p ট্রানজিস্টরের ক্ষেত্রে বায়াসিং কার্যক্রম দেখানো হয়েছে। p-অঞ্চল বা এমিটার থেকে ‘হোল’ বেসের মধ্যে প্রবেশ করে এবং কালেকটর বেশি ঋণাত্মক হওয়ায় হোলগুলো বেস থেকে তীব্রভাবে কালেকটরের দিকে ছুটে যায় এবং একটা প্রবল তড়িৎ প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে এমিটার-বেস জাংশন সম্মুখ ঝোঁকে এবং কালেকটর-বেস জাংশন বিপরীত ঝোঁকে রাখা হয়। সম্মুখ ঝোঁকের কারণে p-অঞ্চলের ইমিটারের হোলগুলি বেসের দিকে প্রবাহিত হয়ে ইমিটার প্রবাহ I_{E}সৃষ্টি করে। আবার হোলগুলো 95% p-অঞ্চলের বেসে প্রবেশ করে সেখানকার বিদ্যমান ইলেকট্রনগুলোর সাথে মিলতে চায়। বেস খুব পাতলা হওয়ায় প্রায় 5% হোল ইলেকট্রনের সাথে মিশে সামান্য বেস প্রবাহ I_{C} তৈরি করে। অবশিষ্ট হোল প্রায় 95% p-অঞ্চলের কালেকটরে প্রবেশ করে এবং বেস থেকে কালেকটর প্রবাহ I_{E}তৈরি করে। এভাবে প্রায় সম্পূর্ণ এমিটার বা নিঃসারক প্রবাহ কালেকটর বর্তনীতে প্রবাহিত হয়।
এমিটার অংশে চার্জের প্রবাহের জন্য সৃষ্ট কারেন্টকে এমিটার কারেন্ট বা নিঃসারক প্রবাহ \left(I_{E}\right), বেস অংশে ইলেকট্রন হোল মিলনের ফলে সৃষ্ট কারেন্টকে বেস কারেন্ট বা পীঠ বা ভূমি প্রবাহ \left(I_{B}\right) এবং কালেকটর অংশে চার্জের প্রবাহের জন্য কারেন্টকে কালেকটর কারেন্ট বা সংগ্রাহক প্রবাহ \left(I_{C}\right) বলা হয়। বেস কারেন্ট কালেকটর অংশে যায় না। এই কারেন্ট বেস প্রান্ত (Terminal) দিয়ে বেরিয়ে আসে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে এমিটার কারেন্টের সবটুকু কালেকটর অংশে যায় না; অর্থাৎ, কালেকটর কারেন্টের মান এমিটার কারেন্টের চেয়ে কম হয়। এক্ষেত্রে \left(I_{E}\right), \left(I_{B}\right) এবং \left(I_{C}\right)-এর নিম্নরূপ সম্পর্ক রয়েছে :
I_{E}=I_{B}+I_{C}আবার, \Delta I_{E}, \Delta I_{B} এবং \Delta l_{C-}-যথাক্রমে নিঃসারক প্রবাহ, পীঠ প্রবাহ এবং সংগ্রাহক প্রবাহের পরিবর্তন হলে,
\Delta I_{E}=\Delta I_{B}+\Delta I_{C}একটি \mathrm{p}-\mathrm{n}-\mathrm{p} ট্রানজিস্টরে 10^{-8} \mathrm{~s} সময়ে 10^{8} টি ইলেকট্রন এমিটারে প্রবেশ করে। যদি 1% ইলেকট্রন বেসে নষ্ট হয়, তবে কালেকটরে প্রবাহের অংশ ও কালেকটর গেইন কত হবে ?
এমিটার, কালেক্টর ও বেস প্রবাহের মধ্যে সম্পর্ক থেকে হিসাব কর। সমাধানকৃত মান হবে যথাক্রমে 0.99 এবং 99।
দুটি আলাদা p-n সংযোগ ডায়োডকে পিঠাপিঠি জোড়া লাগিয়ে \mathrm{p}-\mathrm{n}-\mathrm{p} ট্রানজিস্টর তৈরি করা যাবে কী ?
না। কেননা আমরা জানি ট্রানজিস্টরের ভূমি খুবই পাতলা এবং কম ডোপিং করা হয়। কিন্তু দুটি p-n সংযোকে পিঠাপিঠি যুক্ত করলে ভূমি অঞ্চলটি বেশ মোটা হবে এবং ডোপিং-এর পরিমাণও অনেক বেশি হবে। ফলে গ্রাহক প্রবাহ কমে যাবে এবং ভূমি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। তাই দুটি আলাদা p-n সংযোগ ডায়োডকে জোড়া লাগিয়ে p-n-p ট্রানজিস্টর তৈরি করা যাবে না।