10 Minute School
Log in

নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন | Moral Education: Ethics, Values ​​& Good Governance

শিক্ষা

  • Education শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ Educare (প্রতিপালন বা পরিচর্যা করা) বা Educere (নিষ্কাশন করা) অথবা Educatum (শিক্ষাদানের কাজ) থেকে।
  • শিক্ষার আরেকটি প্রতিশব্দ হলো বিদ্যা যার অর্থ জ্ঞান আহরণ।
  • শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে অব্যাহত অনুশীলন।
  • শিক্ষাকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
    • আনুষ্ঠানিক শিক্ষা: স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা।
    • অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা: জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা।
    • উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা: কর্মজীবন বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা অর্জনে যে শিক্ষা।

মূল্যবোধ শিক্ষা

  • শিক্ষার সাথে মূল্যবোধ বা জীবনাদর্শ সমন্বয়ে যে শিক্ষার ধারণা উদ্ভব তাই মূল্যবোধ শিক্ষা।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহানুভূতি, সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের ধারণা জাগ্রত করে এবং এটি মানুষের নৈতিকতাবোধের উন্নয়ন ঘটায়।
  • ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যবস্থাকে নানামুখী সংকট ও অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই মূল্যবোধ শিক্ষার ধারণার উদ্ভব।

মূল্যবোধ শিক্ষার গুরুত্ব

  • মূল্যবোধ শিক্ষা যে সকল মৌলিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করে-আত্মমর্যাদা, সত্যবাদিতা, অহিংসা, কঠোর শ্রম, সাম্য, ন্যায়, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিকবোধ, সৌহার্দ্য, মমত্ববোধ, দেশপ্রেম, সহযোগিতা, দায়িত্বশীলতা, সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন করা যায়।
  • মূল্যবোধের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় যা সুশাসনের জন্য অপরিহার্য।

মূল্যবোধ শিক্ষার উদ্দেশ্য

  • মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে এক জন ব্যক্তির মধ্যে- নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, দেশের প্রতি, সকল ধর্মের প্রতি সঠিক ও যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
  • মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি এবং একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে মূল্যবোধ শিক্ষা।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা।

মূল্যবোধ শিক্ষা ও সুশাসনের সম্পর্ক ও প্রভাব

  • মূল্যবোধ শিক্ষা ব্যক্তিকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে সুশাসনের ভিত্তিকে মজবুত করে।
  • মূল্যবোধ ও সুশাসন জাতীয় ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, জাতীয় সংহতি, সমাজের উন্নতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে।
  • মূল্যবোধ ও সুশাসনের প্রভাব জাতীয় জীবনে সহনশীলতা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
  • বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন মূল্যবোধ শিক্ষা।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধ

নীতিবিদ্যা বা নীতিশাস্ত্র (Ethics):

  • Ethics শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Ethos থেকে।
  • জীবনের পরম আদর্শকে লাভ করার জন্য মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করাই নীতিবিদ্যার কাজ।

নৈতিকতা (Morality):

  • Morality শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Moralitas থেকে।
  • দৈনন্দিন কাজকর্ম ও সামাজিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মানুষ যে সকল নীতি, আদর্শ এবং সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত অনুশাসন মেনে চলে তার সমষ্টিকে নৈতিকতা বলে।
  • নৈতিক অনুশাসনের প্রভাবে মানুষ আইন মানে, শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করে না এবং রাষ্ট্রের অনুশাসনকে শ্রদ্ধা করে।
  • বিবেক, চিন্তা, বুদ্ধি ও ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে নৈতিকতার উৎস।
  • নৈতিকতা বিকাশের লালন ক্ষেত্র সমাজ।
  • নৈতিকতার মানকে আদর্শ করে উপযুক্ত শিক্ষা।
  • নৈতিক শক্তির প্রধান উপাদান হলো সততা ও  নিষ্ঠা।

মূল্যবোধ (Values):

  • মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ পালনকারী নীতি ও মানদণ্ড।
  • মূল্যবোধ হলো অকৃত্রিম অর্জিত আপোষহীন নীতি যা দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়।
  • আইনের শাসন, নীতি ও ঐতিহ্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, শ্রমের মর্যাদা, শৃঙ্খলাবোধ, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সরকার ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখীতা, নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রভৃতি হলো মূল্যবোধের ভিত্তি বা উপাদানসমূহ।
  • মূল্যবোধের প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র হলো পরিবার এবং প্রাতিষ্ঠানিক উৎস হলো শিক্ষালয়।
  • সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ ছাড়া মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।

মূল্যবোধের শ্রেণীবিভাগ (Classification of Values):

  • ব্যক্তিগত মূল্যবোধ
  • নৈতিক মূল্যবোধ
  • সামাজিক মূল্যবোধ
  • রাজনৈতিক মূল্যবোধ
  • সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ

মূল্যবোধ ও সুশাসনের সম্পর্ক (Relation between Values and Good Governance):

সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলাবোধের উন্মেষ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, নৈতিক মূল্যবোধ ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে মূল্যবোধ সরকার ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখিতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।

মূল্যবোধের অবক্ষয় ও উত্তরণের উপায়

  • মূল্যবোধের অভাব ও অনুপস্থিতিকে বলা হয় মূল্যবোধের অবক্ষয়।
  • মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
  • দারিদ্র, জনসংখ্যার আধিক্য, রাজনৈতিক কারণ, অসম বণ্টন ব্যবস্থা, পারিবারিক কারণ, প্রেমে ব্যর্থতা, সঙ্গ দোষ, অনুকরণ, স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ  বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে জনগণের মূল্যবোধের অভাব ঘটছে।
  • ফলে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন ইভটিজিং, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে।
  • দারিদ্র বিমোচন, গ্রাম উন্নয়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস, বেকারত্ব হ্রাস, রাজনৈতিক অঙ্গীকার, শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ঘটাতে পারলে আমাদের সমাজে মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত হবে।

সুশাসন (Good Governance)

  • ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম সুশাসন (Good Governance) প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়।
  • Good Governance শব্দটি Good এবং Governance এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত যার অর্থ- নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসক।
  • জনগণ রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্ঠ প্রত্যয় হলো প্রশাসন সুশাসন।
  • সুশাসনের পূর্ব শর্ত হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা।

সুশাসনের সংজ্ঞা (Definition of Good Governance):

  • বিশ্ব ব্যাংক: “সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন।”
  • জাতিসংঘ: “সুশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, মৌলিক স্বাধীনতার উন্নয়ন।”

সুশাসনের উপাদান (Elements of Good Governance):

জাতিসংঘের মতে সুশাসনের উপাদান আটটি-

  • অংশগ্রহণ (Participation)
  • আইনের শাসন (Rule of Law)
  • স্বচ্ছতা (Transparency)
  • সহানুভূতিশীলতা (Responsiveness)
  • ঐক্যমত্য ভিত্তিক (Consensus Oriented)
  • ন্যায় বিচার ও অন্তর্ভুক্তিকরণ (Equity and Inclusiveness)
  • কার্যকারিতা ও দক্ষতা (Effectiveness and Efficiency)
  • জবাবদিহিতা (Accountability)

সুশাসনের উপাদান সমাজে প্রতিষ্ঠা (Establishing the Elements of Good Governance in Society):

  • নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া চালু করা।
  • প্রশাসনের স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
  • সার্বভৌম ও কার্যকর আইনসভা, দক্ষ সরকার ব্যবস্থা, স্বাধীন বিচার বিভাগ কার্যকর করা।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকা (Roles of Government to Establish Good Governance):

জনগণকে মত প্রদানের স্বাধীনতা প্রদান, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, দক্ষ জনশক্তি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতীয় উন্নয়নে সুশাসনের প্রভাব (Impact of Good Governance in National Development):

  • আইনের শাসন নিশ্চিত করে ও দুর্নীতির গ্ৰাস থেকে নাগরিকদের রক্ষা করে।
  • কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়।

সুশাসনের উপকারিতা:

  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
  • বিশৃঙ্খলা দূর করে এবং সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলে।
  • জাতীয় উন্নতিকে বাধা মুক্ত রাখে।

সুশাসনের অভাবজনিত ফলাফল

  • সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না।
  • মেধার অপচয় ঘটে ও জাতীয় উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
  • জনগণ ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।