উদ্ভিদ টিস্যু (Plant tissue)
একই বা বিভিন্ন প্রকারের একগুচ্ছ কোষ একত্রিত হয়ে যদি একই কাজ করে এবং তাদের উৎপত্তিও যদি অভিন্ন হয়, তখন তাদের টিস্যু বা কলা বলে।
টিস্যু দুই ধরনের,
- 1. ভাজক টিস্যু এবং
- 2. স্থায়ী টিস্যু
ভাজক টিস্যুর কোষগুলো বিভাজনে সক্ষম কিন্তু স্থায়ী টিস্যুর কোষগুলো বিভাজিত হতে পারে না। স্থায়ী টিস্যু তিন ধরনের, যথা-
- 1.সরল টিস্যু
- 2. জটিল টিস্যু এবং
- 3. নিঃস্রাবী (ক্ষরণকারী) টিস্যু।
(a) সরল টিস্যু (Simple tissue):
যে স্থায়ী টিস্যুর প্রতিটি কোষ আকার, আকৃতি ও গঠনের দিক থেকে অভিন্ন, তাকে সরল টিস্যু বলে। কোষের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে সরল টিস্যুকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
- 1.প্যারেনকাইমা।
- 2.কোলেনকাইমা এবং
- 3. স্ক্লেরেনকাইমা।
প্যারেনকাইমা (Parenchyma):
উদ্ভিদদেহের সব অংশে এদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ টিস্যুর কোষগুলো জীবিত, সমব্যাসীয়, পাতলা প্রাচীরযুক্ত এবং প্রোটোপ্লাজম দিয়ে পূর্ণ। এই টিস্যুতে আন্তঃকোষীয় ফাঁক দেখা যায়। কোষপ্রাচীর পাতলা এবং সেলুলোজ দিয়ে তৈরি হয়। এসব কোষে যখন ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে, তখন তাকে ক্লোরেনকাইমা (Chlorenchyma) বলে। জলজ উদ্ভিদের বড় বড় বায়ুকুঠুরিযুক্ত প্যারেনকাইমাকে অ্যারেনকাইমা (Aerenchyma) বলে। প্যারেনকাইমা টিস্যুর প্রধান কাজ দেহ গঠন করা, খাদ্য প্রস্তুত করা, খাদ্য সঞ্চয় করা এবং খাদ্যদ্রব্য পরিবহন করা।
কোলেনকাইমা (Collenchyma):
এগুলো বিশেষ ধরনের প্যারেনকাইমা কোষ দিয়ে তৈরি হয়। কোষপ্রাচীরে সেলুলোজ এবং পেকটিন জমা হয়ে পুরু হয়। তবে এদের কোষপ্রাচীর অসমভাবে পুরু এবং কোণাগুলো অধিক পুরু হয়। এ টিস্যুর কোষগুলো লম্বাটে ও সজীব। এরা প্রোটোপ্লাজমপূর্ণ কোষ দিয়ে তৈরি হয়। এতে আন্তঃকোষীয় ফাঁক থাকতে পারে। কোষপ্রান্ত চৌকোনাকার, সরু বা তির্যক হতে পারে। খাদ্য প্রস্তুত এবং উদ্ভিদদেহকে দৃঢ়তা প্রদান করা এদের প্রধান কাজ।
- পাতার শিরা এবং পত্রবৃন্তে এদের দেখা যায়।
- কচি ও নমনীয় কাণ্ড, যেমন কুমড়া ও দণ্ডকলসের কাণ্ডে এ টিস্যু দৃঢ়তা প্রদান করে।
- এ কোষে যখন ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে, তখন এরা খাদ্য প্রস্তুত করে।
স্কেরেনকাইমা (Sclerenchyma):
এ টিস্যুর কোষগুলো শক্ত, অনেক লম্বা এবং পুরু প্রাচীরবিশিষ্ট হয়। প্রোটোপ্লাজমবিহীন, লিগনিনযুক্ত এবং যান্ত্রিক কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোষ দিয়ে গঠিত টিস্যুকে স্ক্লেরেনকাইমা টিস্যু বলে। প্রাথমিক অবস্থায় কোষগুলোতে প্রোটোপ্লাজম উপস্থিত থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি তা নষ্ট হয়ে মৃত কোষে পরিণত হয়। কোষগুলো প্রধানত দুই ধরনের, ফাইবার এবং স্ক্লেরাইড। উদ্ভিদদেহে দৃঢ়তা প্রদান এবং পানি ও খনিজ লবণ পরিবহন করা এর মূল কাজ।
(i) ফাইবার বা তন্তু (Fibre):
এরা অত্যন্ত দীর্ঘ, পুরু প্রাচীরযুক্ত শক্ত এবং দুই প্রান্ত সরু। তবে কখনো কখনো ভোঁতা হতে পারে। প্রাচীরের গায়ে ছিদ্র থাকে, এ ছিদ্রকে কূপ বলে। অবস্থান এবং গঠনের ভিত্তিতে এদের বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন বাস্ট ফাইবার, সার্ফেস ফাইবার, জাইলেম তন্তু বা কাষ্ঠতন্তু।
(ii) স্ক্লেৱাইড (Sclereids):
এদেরকে স্টোন সেলও বলা হয়। এরা খাটো সমব্যাসীয়, কখনও লম্বাটে আবার কখনো তারকাকার হতে পারে। এদের গৌণগ্রাচীর খুবই শক্ত, অত্যন্ত পুরু এবং লিগনিনযুক্ত। পরিণত স্ক্লেরাইড কোষ সাধারণত মৃত থাকে এবং এদের কোষপ্রাচীর কূপযুক্ত হয়।
নগ্নবীজী ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিসের কর্টেক্স, ফল ও বীজত্বকে স্ক্লেরাইড টিস্যু দেখা যায়। বহিঃত্বক জাইলেম এবং ফ্লোয়েমের সাথে একত্রে পত্রবৃন্তে কোষগুচ্ছরূপে থাকতে পারে।
(b) জটিল টিস্যু (Complex tissues):
বিভিন্ন ধরনের কোষের সমন্বয়ে যে স্থায়ী টিস্যু তৈরি হয়, তাকে জটিল টিস্যু বলে। এঁরা উদ্ভিদে পরিবহনের কাজ করে, তাই এদের পরিবহন টিস্যুও বলা হয়। এ টিস্যু দুই ধরনের, জাইলেম এবং ফ্লোয়েম। জাইলেম এবং ফ্লোয়েম একত্রে উদ্ভিদের পরিবহন টিস্যুগুচ্ছ (vascular bundle) গঠন করে।
জাইলেম (Xylem):
জাইলেম দুই ধরনের প্রাথমিক ও গৌণ জাইলেম। প্রোক্যাম্বিয়াম থেকে সৃষ্ট জাইলেমকে প্রাথমিক জাইলেম বলে। প্রাথমিক বৃদ্ধি শেষে যেসব ক্ষেত্রে গৌণবৃদ্ধি ঘটে, সেখানে গৌণ-জাইলেম সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক জাইলেম দুই ধরনের।
প্রাথমিক অবস্থায় একে প্রোটোজাইলেম এবং পরিণত অবস্থায় মেটাজাইলেম বলে। মেটাজাইলেমের অভ্যন্তরীণ ফাঁকা গহ্বরটি বড় থাকে। জাইলেমে কয়েক ধরনের কোষ থাকে, যেমন:
- ট্রাকিড
- ভেসেল
- জাইলেম প্যারেনকাইমা ও
- জাইলেম ফাইবার।
(i) ট্রাকিড (Tracheids):
ট্রাকিড কোষ লম্বা। এর প্রান্তদ্বয় সরু এবং সুচালো। প্রাচীরে লিগনিন জমা হয়ে পুরু হয় এবং অভ্যন্তরীণ গহ্বর বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পানির চলাচল পাশাপাশি জোড়া কূপের (paired pits) মাধ্যমে হয়ে থাকে। প্রাচীরের পুরুত্ব কয়েক ধরনের হয়, যেমন বলয়াকার, সর্পিলাকার, সোপানাকার, জালিকাকার কিংবা কূপাঙ্কিত। ফার্নবর্ণ, নগ্নবীজী, আবৃতবীজী উদ্ভিদের প্রাথমিক ও গৌণ জাইলেম কলায় ট্রাকিড দেখা যায়।
- কোষরসের পরিবহন এবং অঙ্গকে দৃঢ়তা প্রদান করা এদের প্রধান কাজ।
- তবে কখনো খাদ্য সঞ্চয়ের কাজও এই টিস্যু করে থাকে।
(ii) ভেসেল (Vessels):
ভেসেল কোষগুলো খাটো চোঙের মতো। কোষগুলো একটির মাথায় আরেকটি সজ্জিত হয় এবং প্রান্তীয় প্রাচীরটি গলেগিয়ে একটি দীর্ঘ নলের মতো অঙ্গের সৃষ্টি করে। এর ফলে কোষরসের উপরে ওঠার জন্য একটি সরু পথ সৃষ্টি হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় এ কোষগুলো প্রোটোপ্লাজমপূর্ণ থাকলেও পরিণত বয়সে এরা মৃত এবং প্রোটোপ্লাজমবিহীন হয়। ভেসেলের প্রাচীর ট্রাকিডের মতো বিভিন্নৰূপে শুরু হয়, যেমন- সোপানাকার, সর্পিলাকার, বলয়াকার, কৃপাঙ্কিত ইত্যাদি। ভেসেলের প্রাচীর ট্রাকিডের মতো বিভিন্নরুপে পুরু হয়, যেমন- সোপানাকার, সর্পিলাকার, বলয়াকার, কূপাঙ্কিত ইত্যাদি। ভেসেল সাধারণত কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা হয়। তবে বৃক্ষ বা আরোহী উদ্ভিদে আরও অনেক লম্বা হতে পারে। এদের প্রধানত আবৃতবীজী উদ্ভিদের সব অঙ্গে দেখা যায়। নগ্নবীজী উদ্ভিদের মধ্যে উন্নত উদ্ভিদ যেমন নিটামে (Gnetum) প্রাথমিক পর্যায়ের ভেসেল থাকে। পানি এবং খনিজ লবণ পরিবহনে এবং অঙ্গকে দৃঢ়তা প্রদান করা এর প্রধান কাজ।
(iii) জাইলেম প্যারেনকাইমা (Xylem parenchyma):
জাইলেমে অবস্থিত প্যারেনকাইমা কোষকে জাইলেম প্যারেনকাইমা বা উড প্যারেনকাইমা (wood parenchyma) বলে। এদের প্রাচীর পুরু বা পাতলা হতে পারে। প্রাইমারি জাইলেমে অবস্থিত পারেনকাইমার কোষ পাতলা প্রাচীরযুক্ত। তবে গৌণ জাইলেমে এরা পুরু প্রাচীরযুক্ত হয়ে থাকে। খাদ্য সঞ্চয় এবং পানি পরিবহন করা এদের প্রধান কাজ।
(iv) জাইলেম ফাইবার (Xylem fibre):
জাইলেমে অবস্থিত স্ক্লেরেনকাইমা কোষই হল জাইলেম ফাইবার। এদের উড ফাইবারও বলে এই বলে। এ কোষগুলো লম্বা, এদের দুপ্রান্ত সরু। পরিণত কোষে প্রোটোপ্লাজম থাকে না বলে এরা মৃত। উদ্ভিদে এরা যান্ত্রিক শক্তি যোগায়। দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের সব জইলেমে এরা অবস্থান করে। পানি ও খনিজ পদার্থ পরিবহন, খাদ্য সঞ্চয় আর দৃঢ়তা প্রদান করা জাইলেম টিস্যুর প্রধান কাজ।
ফ্লোয়েম (phloem):
উদ্ভিদ কান্ডে এরা জাইলেমের সাথে একত্রে পরিবহন টিস্যুগুচ্ছ তৈরি করে।
- সিভনল।
- সঙ্গীকোষ।
- ফ্লোয়েম প্যারেনকাইমা এবং
- ফ্লোয়েম তন্তু নিয়ে ফ্লোয়েম টিস্যু গঠিত হয়। জাইলেম যেমন খাদ্যের কাঁচামাল পানি সরবরাহ করে, তেমনি ফ্লোয়েম পাতায় প্রস্তুত খাদ্য উদ্ভিদ দেহের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করে।
(i) সিভকোষ (Sieve cell):
এগুলো বিশেষ ধরনের কোষ। দীর্ঘ পাতলা কোষপ্রাচীরযুক্ত এবং জীবিত এই কোষগুলো লম্বালম্বিভাবে একটির উপর একটি সজ্জিত হয়ে সিভনল (Sieve tube) গঠন করে। এ কোষগুলো চালুনির মতো ছিদ্রযুক্ত সিভপ্লেট দিয়ে পরস্পর থেকে আলাদা থাকে। সিভকোষে প্রোটোপ্লাজম প্রাচীর ঘেঁষে থাকে বলে একটি কেন্দ্রীয় ভাঁপা জায়গার সৃষ্টি হয়, যেটা খাদ্য পরিবহনের নল হিসেবে কাজ করে। এদের প্রাচীর লিগনিনযুক্ত। পরিণত সিভকোষে কোনো নিউক্লিয়াস থাকে না। সকল ধরনের গুপ্তবীজী উদ্ভিদের ফ্লোয়েমে সঙ্গীকোষ এবং সিভনল থাকে। পাতায় প্রস্তুত খাদ্য পরিবহন এদের প্রধান কাজ।
(ii) সঙ্গীকোষ (Companion cell):
প্রতিটি সিভকোষের সাথে একটি করে প্যারেনকাইমা জাতীয় কোষ অবস্থান করে। এদের কেন্দ্রিকা বা নিউক্লিয়াস বেশ বড়। ধারণা করা হয় এ নিউক্লিয়াস সিভকোষের কার্যাবলি কিছু পরিমাণে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে। এই কোষ প্রোটোপ্লাজম দিয়ে পূর্ণ এবং পাতলা প্রাচীরযুক্ত। ফার্ণ এবং ব্যক্তবীজী উদ্ভিদে এদের উপস্থিতি নেই।
(iii) ফ্লোয়েম প্যারেনকাইমা (Phloem parenchayma):
ফ্লোয়েমে উপস্থিত প্যারেনকাইমা কোষগুলোই ফ্লোয়েম প্যারেনকাইমা। এদের কোষ সাধারণ প্যারেনকাইমার মতো পাতলা কোষপ্রাচীরযুক্ত এবং প্রোটোপ্লাজমযুক্ত। এরা খাদ্য সঞ্চয় করে এবং খাদ্য পরিবহনে সহায়তা করে। ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ (Pteridophyta), নগ্নবীজী উদ্ভিদ এবং দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের ফ্লোয়েম টিস্যুতে ফ্লোয়েম প্যারেনকাইমা থাকে। একবীজপত্রী উদ্ভিদে ফ্লোয়েম প্যারেনকাইমা থাকে না।
(iv) ফ্লোয়েম ফাইবার বা তন্তু (Phloem fibre):
স্ক্লেরেনকাইমা কোষ সমন্বয়ে ফ্লোয়েম ফাইবার তৈরি হয়। এগুলো একধরনের দীর্ঘ কোষ, যাদের প্রদেশ পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। এদের রাস্ট ফাইবারও বলে। পাটের আঁশ এক ধরনের বাস্ট ফাইবার। উদ্ভিদ অঙ্গের গৌণবৃদ্ধির সময় এ ফাইবার উৎপন্ন হয়। এসব কোষের প্রাচীরে রূপ দেখা যায়। ফ্লোরেম টিস্যুর মাধ্যমে পাতায় উৎপাদিত শর্করা এবং মূলে সঞ্চিত খাদ্য একই সাথে উপরে নিচে পরিবাহিত হয়।