10 Minute School
Log in

ভাইরাস ঘটিত কিছু রোগ, লক্ষণ ও প্রতিকার

কয়েকটি প্রাণী ভাইরাস রোগের নাম, পোষকদেহ এবং ভাইরাসের নাম

(Names of some virus diseases, hosts body and names of viruses) 

সৃষ্ট রোগের নাম  পোষকদেহ ভাইরাসের নাম
তামাকের মোজাইক রোগ তামাক Tobacco Mosaic virus 
সিমের মোজাইক রোগ সিম Bean Mosaic virus
ধানের টুংরো রোগ ধান Tungro virus 
AIDS মানুষ HIV ভাইরাস
ডেঙ্গু/ ডেঙ্গী জ্বর  মানুষ ফ্ল্যাভি ভাইরাস (Flavi virus)
বার্ড ফ্লু হাঁস-মুরগি, পাখি  ইনফ্লুয়েঞ্জা (HN) ভাইরাস
চিকুনগুনিয়া মানুষ চিকুনগুনিয়া ভাইরাস
Swine flue   মানুষ, শূকর  ইনফ্লুয়েঞ্জা (HN) ভাইরাস
SARS   মানুষ  Nipah virus 
জলাতঙ্ক   মানুষ র‍্যাবিস ভাইরাস (Rabis virus)
গুটি বসন্ত (small pox)   মানুষ ভেরিওলা ভাইরাস (Variola virus)
জলবসন্ত (chicken pox)   মানুষ, পশুপাখি Varicella-Zoster virus 
ভাইরাল নিউমোনিয়া   মানুষ Adeno virus 
কোষের লাইসিস (lysis)   মানুষ Ebola virus 
সাধারণ সর্দি  মানুষ Rhino virus 
হাম  মানুষ রুবিওলা ভাইরাস (Rubeola virus)
পোলিওমাইলাইটিস   মানুষ  পোলিও ভাইরাস (Polio virus)
ইনফ্লুয়েঞ্জা   মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (Influenza virus)
হার্পিস  মানুষ হার্পিস ভাইরাস (Herpes virus)
জন্ডিস/লিভার ক্যান্সার   মানুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস (Hepatitis B) 
গো-বসন্ত   গরু  ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস (Vaccinia virus)
পা ও মুখের ক্ষত  গরু/ভেড়া/মহিষ  ‘ফুট অ্যান্ড মাউথ’ ভাইরাস
ইঁদুরের টিউমার   ইঁদুর  পলিওমা ভাইরাস (Polioma virus)

ভাইরাস ঘটিত কিছু রোগ, লক্ষন ও প্রতিকার 

(Some diseases, symptoms and remedies caused by virus)

ভাইরাস ঘটিত রোগসমূহ (Viral diseases):

ভাইরাস বলতেই রোগ সৃষ্টিকারী বস্তু বোঝায়। মানুষ, গাছপালা, পশুপাখির বহু রোগ ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি ভাইরাসঘটিত রোগের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হলো। 

(ক) ভাইরাল হেপাটাইটিস (Viral Hepatitis)

সাধারণত লিভার প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলা হয়। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে লিভার প্রদাহ হলে তাকে ভাইরাল হেপাটাইটিস বা সংক্ষেপে হেপাটাইটিস বলা হয়। এটি জন্ডিসের অন্যতম প্রধান কারণ। পৃথিবার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩% এবং বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লক্ষ লোক এ রোগে আক্রান্ত। ৮৫% ক্ষেত্রে এ ভাইরাস লিভারে স্থায়ী আক্রমণ গড়ে তোলে, যা ১০-১৫ বছরের মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়। 

রোগের কারণ (Causes of the disease):

হেপাটাইটিস রোগের কারণ হেপাটাইটিস-B ভাইরাস (HBV)। এছাড়া হেপাটাইটিস-A ভাইরাস (HAV); হেপাটাইটিস-C ভাইরাস (HCV) যাকে বলা হয় ‘তুষের আগুন’ / নিরব ঘাতক এবং আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসার অভাবে অধিকাংশ সময় মারা যায়; হেপাটাইটিস-D ভাইরাস (HDV) ও হেপাটাইটিস-E ভাইরাস (HEV) দিয়েও লিভার প্রদাহ হয়ে থাকে। অধিকাংশ হেপাটাইটিসই হেপাটাইটিস-B ভাইরাসের আক্রমণে ঘটে থাকে। হেপাটাইটিস-C অবশ্য হেপাটাইটিস-B অপেক্ষা অধিক মারাত্মক।  

হেপাটাইটিস-B ভাইরাস একটি DNA ভাইরাস। এর DNA দ্বিসূত্রক এবং বৃত্তাকার। এই ভাইরাসে প্রোটিন আবরণের ওপর আর একটি আবরণ থাকে। এ ভাইরাস বিভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। যেমন- 

  • আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধপানের মাধ্যমে শিশু আক্রান্ত হতে পারে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির দেহে এ ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। 
  • অনিরাপদে যৌন মিলনের মাধ্যমেও এ ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।  

এছাড়াও মাইটোমেগালো ভাইরাস, এপিস্টেইন বার ভাইরাস, হার্পিস সিমপ্লেক্স, হার্পিস জোস্টার ভাইরাস কোনো সময় শিশুর  হেপাটাইটিস সৃষ্টি করে। নিম্নে হেপাটাইটিস ভাইরাসের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো।  

বৈশিষ্ট্য HAV HBV HCV HDV HEV
ভাইরাস গ্রুপ এন্টারো ভাইরাস হেপাডিএনএ ভাইরাস ফ্ল্যাভি ভাইরাস অসম্পূর্ণ ভাইরাস ক্যালিসি ভাইরাস
নিউক্লিক এসিড RNA DNA RNA RNA RNA
আয়তন ২৭ nm ৪২ nm ৩০-৩৮ nm ৩৫ nm ২৭ nm
সুপ্তিকাল ১৪-২৮ দিন ৪৫-১৮০ দিন ১৪-১৮০ দিন ২১-৪৯ দিন ২১-৫৬ দিন

 

রোগের লক্ষণ (Symptoms of the disease): 

রক্তের মাধ্যমে এই রোগ দেহে প্রবেশ করে এবং লিভারে নীত হয় ও লিভারকে আক্রমণ করে। এই ভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিকে কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না। এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড (সুপ্তিকাল) ৪৫-১৮০ দিন। ক্রমশ জ্বর, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব, দুর্বল বোধ, পাতলা পায়খানা, হাড়ের গিটে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে প্রস্রাব হলুদ হয়, চোখের সাদা অংশ এবং সমস্ত শরীর হলুদ বর্ণ দেখায়, পেটে ও পায়ে পানি জমা হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় অস্বস্তি অনুভব করে। শেষ পর্যন্ত লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার হেপাটাইটিস B ও C ভাইরাসের সংক্রমণে হয়ে থাকে। রক্তে বিলিরুবিনের এবং SGPT এর মাত্রা বদ্ধি। এ দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। হেপাটাইটিস B নির্ণয়ের জন্য রক্তের এইচবি সারফেস অ্যান্টিজেন (HBsAg) পরীক্ষা করতে হয়।  

নিয়ন্ত্রণ/প্রতিকার (Control/Remedy): 

রোগলক্ষণ প্রকাশ পেলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার। সাধারণত এর কোনো কার্যকরী চিকিৎসা নেই। নিয়মিত চিকিৎসায় সুস্থ থাকা যায় কিন্তু সম্পূর্ণ আরোগ্য হওয়া যায় না। এর মূল চিকিৎসা হলো রোগীকে ১০-১২ দিন পূর্ণ বিশ্রামে রাখা। গ্লুকোজের সরবত খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। অড়হড় পাতা, ভুঁই আমলার পাতা ইত্যাদির রস খাওয়ায়ে উপকার পেয়েছেন বলেও অনেকে দাবি করেছেন। Amoxicillin, Metronidazole, ভিটামিন-সি প্রভৃতি ওষুধ খাওয়াতে হবে।   

প্রতিরোধ (Resistance): 

প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো প্যান্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন গ্রহণ করা। হেপাটাইটিস-B-এর ভ্যাকসিন ডোজ ৪টি। প্রথম ৩টি একমাস পরপর এবং ৪র্থ টি প্রথম ডোজ থেকে এক বছর পর। পাঁচ বছর পর বুস্টার ডোজ নিতে হয়। এর মাধ্যমে শরীরে হেপাটাইটিস-B ভাইরাসের বিপক্ষে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। রক্ত পরীক্ষা করে এইচবি – সারফেস অ্যান্টিজেন (HBsAg) পজিটিভ হলে B-ভাইরাস আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া হয় এবং তাকে ভ্যাকসিন দেয়া যায় না। মা থেকে শিশুতে এই রোগ ছড়াতে পারে, তাই সাবধান হতে হবে। রক্ত দেওয়া-নেওয়ায় সাবধান হতে হবে।

আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যৌন মিলন করা যাবে না। সর্বক্ষেত্রে ডিসপোজিবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা। সেলুনে সেভ করা পরিহার করতে হবে। প্রতিজনের জন্য আলাদা আলাদা ব্লেড ব্যবহার করা উচিত। ব্যক্তিগত টয়লেট্রিজ দ্রব্য যেমন টুথব্রাশ, রেজার, নেইল কাটার ও রক্ত গ্রহণের যন্ত্রপাতি অন্য কেউ ব্যবহার না করা। 

 

(খ) ডেঙ্গু জ্বর (Dengue Fever)

রোগের কারণ (Causes of the disease):  

ডেঙ্গু (প্রকৃত উচ্চারণ ডেঙ্গী) একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। এই ভাইরাসের জীবাণুর নাম ফ্ল্যাভিভাইরাস বা ডেঙ্গী ভাইরাস। এটি একটি RNA ভাইরাস। এই ভাইরাসের বাহক হলো Aedes aegypti L. ও Aedes albopictus মশকী (স্ত্রী মশা) আর এর পোষক দেহ হলো মানুষ। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গ জ্বরে আক্রান্ত হয়। 

রোগের লক্ষণ (Symptoms of the disease): 

(i) সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর (Common dengue fever):

প্রথমে শীত শীত ভাব হয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বর দেখা দেয়। জ্বর ১০৩-১০৫ (ডিগ্রি) ফারেনহাইট হয়ে থাকে। সাধারণত স্ত্রী ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর ২-৭ দিন পর জ্বর দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরে  রোগীর তীব্র মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেট ব্যথা, কপাল ব্যথা ও গলা ব্যথা হয়। রোগীর সমস্ত শরীরে (মাংসপেশি, পিঠ, কোমর, ঘাড়, হাড়ের জোড়ায় জোড়ায়) ব্যথা হয়। মেরুদণ্ডের ব্যথাসহ কোমরে ব্যথা এই রোগের বিশেষ লক্ষণ। একে হাড়ভাঙ্গা জ্বর বলে। শরীরে লালচে রঙের র‍্যাশ (ফুসকুড়ি) দেখা দিতে পারে। বমি বমি ভাব ও খাবারে অরুচি হতে পারে। মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছালে রক্তক্ষরণ (bleeding) হয়। 

(ii) হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর (Hemorrhagic dengue fever):

সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে জটিলতা থেকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। এতে কয়েকদিন পর রোগীর নাক, মুখ, দাঁতের মাড়ি ও ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়। পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে, রক্ত বমি হতে পারে, চোখের কোণে রক্ত জমাট হতে পারে। রক্তে প্লেটিলেট (অণুচক্রিকা) ভীষণ হ্রাস পায় এবং রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। সঠিক চিকিৎসা না হলে মৃত্যু ঘটতে পারে। 

(iii) ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (Dengue shock syndrome): 

হেমোকনসেনট্রেশন ঘটতে দেখা যায়। তিন ধরনের ডেঙ্গু জ্বরের মধ্যে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর ও ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম অত্যন্ত মারাত্মক।

রোগ নির্ণয় (Diagnosis): 

সেরোলজি (Serology): রক্ত পরীক্ষায় IgM অ্যান্টিবডি উপস্থিত থাকতে পারে অথবা তীব্র সংক্রামিত রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ চার গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। 

প্লেটিলেট পরীক্ষা (Platelet test): রক্তের অনুচক্রিকার সংখ্যা ১৫০০০০/mm এর অনেক নিচে নেমে আসে। 

সেল কালচার (Cell culture): রক্ত কণিকা কালচার করেও ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। 

প্রতিকার/চিকিৎসা (Control/Remedy): 

ডেঙ্গু জ্বরে রোগীকে এসপিরিন জাতীয় ওষুধ দিলে মারাত্মক পরিণতি দেখা দিতে পারে, তাই এসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবেনা। ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিতে হবে। রক্তের সাম্যতা রক্ষার জন্য প্লেটিলেট ট্রান্সফিউশন এর প্রয়োজন পড়ে। রোগীকে প্রচুর পানি, ফলের রস ও তরল খাবার দিতে হবে। মাথায় পানি ঢালা, গায়ের ঘাম মুছে দেয়া, ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করে দেয়া রোগীর জন্য ফলদায়ক হয়। দুগ্ধ পোষ্য শিশুদের অবশ্যই মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের ডেঙ্গু হলে অন্যান্য রোগীর মতোই যত্ন নিতে হবে। রোগীর অবস্থা জটিল হলে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে। 

প্রতিরোধ (Resistance): 

ডেঙ্গু মশা নিধন করাই প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এই মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, কাজেই দিনের বেলায় মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। রোগ প্রতিরোধে দিনের বেলায় মশারী টানিয়ে ঘুমানো, মশার কয়েল অথবা ইলেকট্রিক ভ্যাপার ম্যাট ব্যবহার করতে হবে, যাতে মশা কামড়াতে না পারে।

এই মশা ময়লা পানিতে জন্মায় না, বাড়ির আশপাশে বিভিন্ন কনটেইনারে (ফুলের টব, ভাঙ্গা হাড়ি পাতিল, ডাবের খোসা, ড্রাম ইত্যাদি) রক্ষিত বা সঞ্চিত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়, তাই পানির এসব উৎস ধ্বংস করতে হবে অর্থাৎ পানি জমতে না দেয়া। পূর্ণাঙ্গ মশা নিধনের জন্য নিয়মিত পতঙ্গনাশক স্প্রে করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়। সম্প্রতি আমেরিকার ফ্লোরিডাতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিতে পতঙ্গনাশক ছাড়াই ডেঙ্গু মশা নিধনের ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। 

 

(গ) পেঁপের রিংস্পট বা মোজাইক রোগ (Ringspot or mosaic disease of Papaya) 

পৃথিবীর অনেক দেশেই একটি উল্লেখযোগ্য অর্থকরী ফসল হিসেবে পেঁপের চাষ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশেও একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে পেঁপের চাষ শুরু হয়েছে। পেঁপের রোগ-বালাই অপেক্ষাকৃত কম হলেও কখনো কখনো ক্ষেতের পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পেঁপের সবচেয়ে ক্ষতিকারক রোগ হলো ভাইরাসঘটিত রিংস্পট রোগ। বাংলাদেশসহ ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, হাওয়াই ও টেক্সাসসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে পেঁপে গাছে এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ জেনসন ১৯৪৯ সালে এ রোগের নামকরণ করেন রিংস্পট (Ringspot)। 

রোগের কারণ (Causes of the disease): 

একটি ভাইরাস দ্বারা পেঁপের রিংস্পট রোগ হয়। ভাইরাসটি সাধারণভাবে Papaya ringspot virus বা PRSV নামে পরিচিত। এর গণ Potyvirus, গোত্র Potyviridae. PRSV কতকটা দণ্ডাকৃতির, এটি ৭৬০-৮০০ nm লম্বা এবং এর ব্যাস ১২ nm। পেঁপে ছাড়াও এ ভাইরাস কুমড়া জাতীয় উদ্ভিদে মোজাইক রোগের সৃষ্টি করে। ক্যাপসিডের বাইরে এর কোনো আবরণ নেই। এটি একটি RNA ভাইরাস। PRSV এর দুটি প্রকরণের (PRSV-p এবং PRSV-w) মধ্যে PRSV-p দিয়ে পেঁপের রিংস্পট রোগ হয়।  

সংক্রমণ (Infection):

জাব পোকা ও সাদা মাছি (Melon Aphid- Aplus gossypii and Peach Aphid- Myzus persicae) দ্বারা পেঁপে গাছে রিংস্পট রোগের ভাইরাস সংক্রমিত হয়। কোনো আক্রান্ত উদ্ভিদ থেকে জাব পোকা খাদ্যগ্রহণ করলে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ভাইরাস পোকার দেহে চলে আসে এবং সাথে সাথে কোনো সুস্থ উদ্ভিদে বসলে উহা ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হয়।

পোকার দেহে এ ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধি করে না। যদি পেঁপে বাগানের গাছগুলো পোকার খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এবং বাগানে জাব পোকার সংখ্যা খুব বেশি থাকে তাহলে এ রোগ খুব দ্রুত ছড়ায় এবং ৪ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ বাগান এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। গাছ ছাঁটার সময় যান্ত্রিকভাবে এ রোগ বিস্তার ঘটতে পারে।  

রোগের লক্ষণ (Symptoms of the disease): 

রোগের নাম থেকেই লক্ষণ অনুমান করা যায়। Ring = বৃত্ত, Spot = দাগ অর্থাৎ বৃত্তাকার দাগ প্রকাশ পায়। বৃত্তাকার দাগের প্রকৃতি হলো কেন্দ্রাভিমুখী (Concentric)। রোগাক্রান্ত গাছে নিম্নলিখিত লক্ষণ প্রকাশ পায়। 

(i) উদ্ভিদ জন্মের সাথে সাথে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। সংক্রমণের ৩০-৪০ দিনের মধ্যে প্রথম রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়।  

(ii) ক্লোরোপ্লাস্ট নষ্ট হয়ে পাতায় হলদে-সবুজ মোজাইকের মতো দাগ পড়ে।  

(iii) কাণ্ড, পাতার বোঁটা ও ফলে তৈলাক্ত বা পানি-সিক্ত গাঢ় সবুজ দাগ, স্পট বা রিং সৃষ্টি হয়। 

(iv) অপেক্ষাকৃত কম বয়সের পাতায়ই রোগ লক্ষণ প্রথম প্রকাশ পায়।

(v) আক্রমণ প্রকট হলে পাতায় বহুল পরিমাণে মোজাইক সৃষ্টি হয়, পাতা আকৃতিতে ছোট ও কুঁকড়ে যায়, গাছের মাথায় বিকৃত আকৃতির ক্ষুদ্রাকার কিছু পাতা লক্ষ্য করা যায়। অন্যান্য পাতা ঝরে পড়ে। কখনো কখনো পাতার কেবল শিরাগুলো থাকে।

(vi) আক্রান্ত ফলের উপর পানি ভেজা গোলাকার দাগ পড়ে এবং দাগের মধ্যবর্তী স্থান শক্ত হয়ে যায় ।  

(vii) পেঁপে হলুদ হয়ে যায়, রিংস্পট লক্ষণ প্রকাশিত হয়, আকার ছোট হয়ে যায়। অনেক সময় পুষ্ট হবার আগেই ঝরে যায়।  

(viii) পেঁপের মিষ্টতা ও পেপেইন হ্রাস পায়।  

(ix) ফলন শতকরা ৯০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।

প্রতিকার/নিয়ন্ত্রণ (Control/Remedy):   

১। জমিতে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেলে সাথে সাথেই রোগাক্রান্ত গাছ উঠিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। 

২। জাল (net) দিয়ে পুরো জমি (পেঁপের গাছসহ) ঢেকে দিতে হবে যেন এফিড নামক পতঙ্গ দ্বারা নতুন গাছ আক্রান্ত না হতে পারে।  

৩। এফিড নামক পতঙ্গ নিধনের জন্য পেস্টিসাইড স্প্রে (রগর বা রক্সিয়ন বা পারফেকথিয়ন 40 ইসি অথবা মেটাসিসটক্স 25 ইসি কীটনাশক 2 মিলিলিটার/ 1 লিটার পানিতে মিশিয়ে) করা যেতে পারে।  

৪। চারা লাগানোর প্রথম থেকেই নিয়মিত পেস্টিসাইড স্প্রে করলে এফিড পতঙ্গ দ্বারা রোগ ছড়ায় না।  

৫। রোগাক্রান্ত জমিতে পেঁপে গাছের প্রুনিং (পাতা কাটা, ছাঁটা ইত্যাদি) বন্ধ রাখতে হবে, কারণ কাটা-ছেড়া স্থান দিয়ে রোগাক্রম ঘটে থাকে। 

৬। বাংলাদেশি বিজ্ঞানি ড. মাকসুদুল আলম কর্তৃক জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে আবিষ্কৃত নতুন জাতের ক্রস প্রোটেকশন করে আবাদ করলে রোগমুক্ত ফল উৎপাদন করা সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য যে, ড, মাকসুদুল আলম আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পেঁপের জিনরহস্য উন্মোচন করেছেন। (এখন তিনি প্রয়াত ।) 

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (Preventive measures): 

১। যে এলাকাতে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে সে এলাকায় পেঁপের চাষ বন্ধ করে দিতে হবে এবং দূরে নতুন এলাকায় রোগমুক্ত চারা দিয়ে চাষ শুরু করতে হবে।  

২। ক্রস-প্রোটেকশন পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত চারাগাছ থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। মৃদু প্রকৃতির PRSV জীবাণুকে প্রাণিদেহে ভাইরাল টিকাদানের মতো পোষক উদ্ভিদে প্রবেশ করিয়ে গাছকে ভাইরাস প্রতিরোধী করা।  

৩। PRSV সাধারণত বীজের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় না, তবে প্রকটভাবে আক্রান্ত পেঁপের বীজ ব্যবহার করলে তা ইনোকুলামের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে। কাজেই ঐ ধরনের বীজ ব্যবহার না করা।  

৪। ট্রান্সজেনিক জাত ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। জিনগান পদ্ধতি ব্যবহার করে PRSV’S Coat protein জিনকে ভ্রূণ টিস্যুতে সংযুক্ত করে নতুন ট্রান্সজেনিক জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ১৯৯৮ সালে। ট্রান্সজেনিক জাত দুটি হলো PRSV মুক্ত রেইনবো (Rainbow) ও সানআপ (Sunup)। এই ট্রান্সজেনিক জাত (GMO) PRSV দ্বারা আক্রান্ত হয় না।