বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা
রাজনৈতিক দল এর ধারণা ও বৈশিষ্ট্য (Concepts and Characteristics of Political Parties)
রাজনৈতিক দল এমন এক ধরনের জনসংগঠন, যার সদস্যগণ রাষ্ট্রের সমস্যা সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি।
- বিশ্বে এমন দেশ আছে যেখানে রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্ব নেই; যেমন- সৌদি আরব।
- আবার কোথাও কোথাও আইন করে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। যেমন- ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল।
রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য
- সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি
- ক্ষমতা লাভ
- সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও কর্মসূচি
- প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নেতৃত্ব
- নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ
রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
- নেতৃত্ব তৈরি
- সরকার গঠন
- জনমত গঠন
- রাজনৈতিক শিক্ষাদান
- গঠনমূলক বিরোধীতা
- সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকারভেদ
দলের সংখ্যার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়-
১. একদলীয় ব্যবস্থা: এই পদ্ধতিতে সাংবিধানিকভাবে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি দল, ইতালির মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দল, ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় একদলীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি একদলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ।
- একদলীয় ব্যবস্থায় ঘন ঘন সরকার বদল হয় না। এর ফলে সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এবং রাষ্ট্রের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। কোনো প্রকার বিরোধী দল না থাকায় দলীয় শৃঙ্খলা অটুট থাকে।
- কোনো প্রকার মতভেদ না থাকায় এবং একই আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হয়।
- অকারণে হরতাল, অবরোধ, আইনসভা বর্জন ইত্যাদি করা হয় না বিধায় দক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- একদলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিপূজা এবং উগ্র ধনতান্ত্রিক শোষণ-নির্যাতন দেখা যায়।
- এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা হরণ ঘটে।
২. দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা: যখন কোনো দেশে নির্বাচনকালে প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল দেখতে পাওয়া যায় তখন তাকে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বলে। উদাহরণ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টি, যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবার পার্টি।
৩. বহুদলীয় ব্যবস্থা: এই ব্যবস্থায় দুইয়ের অধিক রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখলের লড়াইতে অবতীর্ণ হয়। বহুদলীয় ব্যবস্থায় সাধারণত কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। ফলে, নির্বাচনে জয়লাভের আশায় অনেক সময় সমমনা দলগুলো “সম্মিলিত সরকার” গঠন করে। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪১টি।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলসমূহ ও তাদের প্রতীক
ক্রমিক নং | দলের নাম | প্রতীক |
১. | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | নৌকা |
২. | বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) | ধানের শীষ |
৩. | জাতীয় পার্টি (জাপা) | লাঙল |
৪. | জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) | মশাল |
৫. | বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) | গরুর গাড়ি |
৬. | বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি | হাতুড়ি |
৭. | বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি | কাস্তে |
৮. | জাতীয় পার্টি (জেপি) | সাইকেল |
৯. | জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) | তারা |
১০. | বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) | মই |
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
- প্রতিষ্ঠাকাল- ২৩ জুন, ১৯৪৩। (কে এম দাস লেনের “রোজ গার্ডেন”-এ অনুষ্ঠিত এক রাজনৈতিক সভায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।)
- প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি- মওলানা ভাসানী; সাধারণ সম্পাদক- শামসুল হক; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
- প্রতিষ্ঠাকালীন নাম- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ; পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে দলটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ” বা সংক্ষেপে “আওয়ামী লীগ” ।
- বর্তমান সভাপতি- শেখ হাসিনা ।
- বর্তমান সাধারণ সম্পাদক- ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল।
- আওয়ামী লীগের মূলনীতি- ৪টি (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণ মুক্ত সমাজ বিনির্মান।)
- দলীয় প্রতীক- নৌকা।
- সদর দপ্তর- ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা।
- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
- প্রতিষ্ঠাকাল- ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮।
- প্রতিষ্ঠাতা- লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান।
- প্রতিষ্ঠাকালীন নাম- জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)।
- বর্তমান চেয়ারপার্সন- বেগম খালেদা জিয়া।
- বর্তমান মহাসচিব- মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ।
- দলীয় প্রতীক- ধানের শীষ।
- সদর দপ্তর- নয়াপল্টন, ঢাকা।
জাতীয় পার্টি (জাপা)
- প্রতিষ্ঠাকাল- ১লা জানুয়ারি, ১৯৮৬।
- প্রতিষ্ঠাতা- হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
- বর্তমান চেয়ারম্যান- জি এম কাদের।
- সদর দপ্তর- ২৪/৮এ, তোপখানা রোড, ঢাকা- ১০০০।
- দলীয় প্রতীক- লাঙল।
এক নজরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ-
- ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে। ন্যাপ- এর প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠিত হয় ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২ সালে।
- বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর প্রতিষ্ঠাকাল- ১৯৮০ সাল। বর্তমানে বাসদের সাধারণ সম্পাদক- খালেকুজ্জামান।
- বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রতিষ্ঠাতা- কমরেড মণি সিংহ।
- মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালে।
- শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ছিলেন কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা।
- বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে। চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের কয়েকটি অংশ মিলিত হয়ে এই দল গঠন করে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অমল সেন।
- বর্তমানে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি- রাশেদ খান মেনন।
সুশীল সমাজ ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
নাগরিক বা সুশীল সমাজের ইংরেজি প্রতিশব্দ “Civil Society”. বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রুশো তাঁর “Social Contract” গ্রন্থে সর্বপ্রথম “Civil Society” এর ধারণা দেন। সুশীল সমাজ বলতে জনগণের সেই অংশকে বোঝায়, যাঁরা সরাসরি রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় কিংবা এসব থেকে সরাসরি সুবিধা লাভ করেন না।
অন্যদিকে সরকারি কাঠামোর বাইরে ও রাজনীতিতে অনিচ্ছুক, কিন্তু সরকারি নীতি গ্রহণ, পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টাকারী গোষ্ঠীসমূহকে বলা হয়- চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী। উদাহরণ- বিভিন্ন এনজিও, বিভিন্ন দাতা সংস্থা ইত্যাদি। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অপর নাম- Attitude Group, Interest Group, Non-Political and Organized Group। উন্নয়নমূলক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ উন্নয়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
অবস্থানগত দিক থেকে সুশীল সমাজকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়।
- প্রাথমিক ক্যাটাগরি: রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও ভূ-স্বামী।
- মাধ্যমিক ক্যাটাগরি: আইনজীবী, ডাক্তার, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষক, ছাত্র।
- প্রান্তিক ক্যাটাগরি: কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ।
নাগরিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো:
- ব্যক্তিগত ক্ষেত্র
- স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন (NGO হতে পারে)
- সমাজকল্যাণমুখী সংগঠন
- পেশাজীবী সংগঠন
- ট্রেড ইউনিয়ন
- সমাজ, সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন
- বিশেষ স্বার্থদল
- বিবিধ সাংস্কৃতিক সংগঠন
- মিডিয়া বা গণমাধ্যম
- অন্যান্য
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা
- সরকারি নীতি প্রণয়নকে প্রভাবিত করা
- আইনসভার ওপর প্রভাব বিস্তার
- ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ
- আমলাদের ওপর চাপ প্রয়োগ
- জনমত গঠন
- জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ