10 Minute School
Log in

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভ্যাক্সিনের ভূমিকা (Role of Vaccine in Immune System)

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা জীবাণুর নির্যাস বা জীবাণু সৃষ্ট পদার্থ (টক্সিন) কিংবা সংশ্লেষিত বিকল্প পদার্থ থেকে উৎপন্ন যে বস্তু অ্যান্টিজেনের মতো আচরণ করে দেহে অ্যান্টিবডি উৎপন্নে উদ্দীপনা জোগায় এবং এক বা একাধিক রোগের বিরুদ্ধে দেহকে অনাক্রম্য করে তোলে তাকে ভ্যাক্সিন (vaccine) বলে। ভ্যাক্সিন প্রয়োগ টিকা দেয়া নামে পরিচিত।

ভ্যাক্সিনের আবিষ্কার:

এডোয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্য করেন গোয়ালিনীরা (cow-maid) গুটি বসন্তের (small pox) মড়ককালে আক্রান্ত হয় না। তিনি প্রমাণ করেন, যে গোয়ালিনীরা পূর্বেই গো বসন্তে সংক্রমিত হয়েছিল গুটি বসন্ত তাদের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না। এই নীতির উপর ভিত্তি করেই এডোয়ার্ড জেনার তৈরি করেন গুটি বসন্তের ভ্যাক্সিন ‌।তিনি তার টিকা সর্বপ্রথম জেমস ফেলসপ নামে ৮ বছরের একটি সুস্থ ছেলেকে দেন। একটু মৃদু বসন্ত উপসর্গের পর সে আবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সে গুটি বসন্তের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। এভাবেই ভ্যাক্সিনের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভ্যাক্সিন এর ভূমিকা

ভ্যাক্সিন (Vaccine)

ভ্যাক্সিনের প্রভারভেদ (Types of Vaccine)

উৎপাদনের ধরনের উপর ভিত্তি করে ভ্যাক্সিন নিচে বর্ণিত ৫ প্রকার:

১. নিষ্ক্রিয় (Inactivated): রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে রাসায়নিক, তাপ, বিকিরণ বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় জীবাণু থেকে উৎপন্ন। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, পোলিও, হেপাটাইটিস A, র‍্যাবিস প্রভৃতি ভ্যাক্সিন।

২. শক্তি হ্রাস (Attenuated): কালচার করা, ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল করে দেয়া জীবিত জীবাণু দিয়ে উৎপন্ন। যেমন—মিজলজ (হাম), মাম্পস, পানিবসস্ত (চিকেন পক্স), টাইফয়েড প্রভৃতি রোগের ভ্যাক্সিন।

৩. টক্সোয়ড (Toxoid): জীবাণুর নিষ্ক্রিয় বিষাক্ত পদার্থ থেকে উৎপন্ন। যেমন টিটেনাস (ধনুষ্টংকার), ডিপথেরিয়া প্রভৃতির ভ্যাক্সিন।

৪. সাবইউনিট (Subunit): জীবাণুগাত্রের সামান্য অংশ (নির্দিষ্ট প্রোটিনের অংশে) যেমন—হেপাটাইটিস B ভ্যাক্সিন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাক্সিন প্রভৃতি।

৫. কনজুগেট (Conjugate): দুটি ভিন্ন উপাদানে গঠিত ভ্যাক্সিন [ব্যাকটেরিয়ার দেহ আবরণের অংশ + বাহক প্রোটিন]। যেমন-হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ B (Haemophilus influenzae type-b, Hib) ভ্যাক্সিন৷

ভ্যাক্সিনেশন (Vaccination)

ভ্যাক্সিন (Vaccine) প্রয়োগের মাধ্যমে অণুজীবের, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস-এর সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায়কে ভ্যাক্সিনেশন বলে। রোগের চিকিৎসায় ভ্যাক্সিনের ব্যবহারপদ্ধতিকে ভ্যাক্সিনোথেরাপি (vaccinotherapy) বলে।

ড. এডওয়ার্ড জেনার (Dr. Edward Jenner) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম গুটিবসন্তের (small pox) ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যুগান্তকারী ‘ভ্যাক্সিন বিপ্লব’ ঘটিয়ে মানুষের রোগমুক্ত দীর্ঘ সুন্দর জীবনের যে প্রত্যাশা জাগিয়েছেন তার ধারাবাহিকতায় আজ দ্বিতীয় জেনারেশন (Second Generation) ভ্যাক্সিন হিসেবে হেপাটাইটিস B ভ্যাক্সিন উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু AIDS ভ্যাক্সিন আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

আমাদের ইমিউনতন্ত্রকে বাড়তি শক্তি যোগাতে ভ্যাক্সিন নিম্নোক্তভাবে সক্রিয় থাকে।

১. অধিকাংশ ভ্যাক্সিনে রোগসৃষ্টিকারী মৃত বা দুর্বল জীবাণুর সামান্য অংশ থাকে। দেহে রোগসৃষ্টি করতে পারে এমন সক্রিয় জীবাণু থাকে না। কোন কোন ভ্যাক্সিনে জীবাণু একেবারেই থাকে না।

২. জীবাণুর অংশবিশেষসহ ভ্যাক্সিন যে দেহে প্রবেশ করে অ্যান্টিবডি সৃষ্টির মাধ্যমে ওই নির্দিষ্ট জীবাণুর প্রতি দেহকে অনাক্রম্য করে তোলে। এসব অ্যান্টিবডি নির্দিষ্ট রোগসৃষ্টিকারী জীবাপুকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করে।

৩. মানবদেহে দুভাবে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হতে পারে (ক) অসুস্থ হলে এবং (খ) ভ্যাক্সিন নিলে। জীবাণুর আক্রমণে অসুস্থ হয়ে রোগে ভুগে কষ্ট শেষে অ্যান্টিবডি উৎপাদনের চেয়ে আগেভাগেই সম্ভাব্য রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা বেশি নিরাপদ। কারণ জীবাণুর আক্রমণে দেহ অসুস্থ হলে সম্পূর্ণ নিরোগ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ দেহ বিকলাঙ্গ হতে পারে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কুৎসিত দাগ হতে পারে, কিংবা জীবনহানিও ঘটতে পারে।

৪. ভ্যাক্সিন গ্রহণের ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি দেহে দীর্ঘদিন বা আজীবন উপস্থিত থাকে।

৫. অনেক ভ্যাক্সিন আছে যা একবার নিলে আজীবন দেহে কর্মক্ষম থাকে। মাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত ডোজ (booster shot) নিতে হয়।

৬. কিছু ভ্যাক্সিন রয়েছে যা মিশ্র ভ্যাক্সিন নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে কয়েকটি রোগের ভ্যাক্সিন যুক্ত করে দেহে প্রবেশ করানো হয়, যেমন- MMR (Measles, Mumps and Rubella) ভ্যাক্সিন।

৭. প্রতিটি মানবদেহ (শিশু বা বয়স্ক) নির্দিষ্ট রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পূর্ণ থাকে।

 

ভ্যাক্সিনের গুরুত্ব / প্রয়োজনীয়তা (Importance of Vaccines)

ভ্যাক্সিনে প্রতিরোধযোগ্য হাম, হুপিংকাশি, পোলিও, টাইফয়েড প্রভৃতি যে সম্ভাব্য জটিলতা (হাসপাতালে ভর্তি, অঙ্গচ্ছেদ, মস্তিষ্কের ক্ষতি, পঙ্গুত্ব, মেনিনজাইটিস, বধিরতা, এমনকি মৃত্যু) সৃষ্টি করে তা থেকে মুক্তি পায়। শিশু যদি ভ্যাক্সিন না নিয়ে থাকে তাহলে রোগ ব্যাধি অন্য শিশুতে ছড়াতে পারে। এমন শিশু রোগাক্রান্ত হতে পারে যার দেহে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ সম্ভব নয় (যেমন-লিউকেমিয়া বা অন্য কোনো ক্যান্সার আক্রান্ত, কিংবা অনাক্রম্যতন্ত্রে সমস্যা আছে এমন)। শিশুকে ভ্যাক্সিন না দিলে রোগ-ব্যাধি প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আবার সমাজে ফিরে আসবে। ভ্যাক্সিনেশনের ফলে শিশু থাকবে সুস্থ-সবল, হাসি-খুশি। অসুখে ভুগে মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকবে না। প্রত্যেক পিতা-মাতাই সন্তানের সুস্বাস্থ্য কামনা করেন। এ আশা পূরণে ভ্যাক্সিনেশন হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা।