বাংলার ইতিহাস (প্রাচীন- মুসলিম শাসন) | History of Bengal (Ancient-Muslim rule)
প্রাচীন- মুসলিম শাসন (Ancient Muslim Rule)
বাঙালি জাতির উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
অস্ট্রিক- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে যে জাতি প্রবাহ গড়ে উঠেছিল এর পাশাপাশি আর্য জাতি এসে সংযুক্ত হয়ে গড়ে তুলেছে বাঙালি জাতি। বঙ্গ নামের উল্লেখ প্রথমে করা হয় “ঐতরেয় আরণ্যক” নামক গ্রন্থে। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আবুল ফজল দেশবাচক বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন।
বাংলার প্রাচীন জনপদ
প্রাচীন বাংলার প্রায় ১৬টি জনপদের কথা জানা যায়।
পুণ্ড্র | এর অবস্থান ছিল বৃহত্তর বগুড়া (মহাস্থানগড়), রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে। জনপদগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম হলো পুণ্ড্র। |
বঙ্গ | বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। মূলত গঙ্গার দুই স্রোতধারা ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতির ভূখণ্ডটিই বঙ্গ। বঙ্গ থেকেই বাঙালি জাতির উৎপত্তি ঘটেছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণের সময় এই অঞ্চলে ‘গঙ্গারিডাই’ নামক একটি রাজ্য ছিল বলে জানা যায়। |
সমতট | বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড় কামতা এর রাজধানী ছিল। কুমিল্লার ময়নামতিতে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। |
গৌড় | মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন গৌড় অঞ্চল। পাণিনির গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। |
চন্দ্রদ্বীপ | মূলত বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল এই জনপদ। বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী সহ মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চল নিয়েও গঠিত ছিল চন্দ্রদ্বীপ। |
হরিকেল | সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। |
রাঢ় | পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ (বর্ধমান জেলা) |
তাম্রলিপ্ত/ তাম্রলিপ্তিস্থান | গ্রিক ভৌগোলিক টলেমীর মানচিত্রে ‘তমলিটিস’ রূপে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং তাম্রলিপ্তি শহরকে ‘তান-মো-লি-তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটি বাংলা অঞ্চলে সর্ব প্রাচীন বন্দর। |
বরেন্দ্র | বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী বিভাগের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। |
কামরূপ | আসামের বৃহত্তম গোয়ালপারা জেলা, বৃহত্তর কামরূপ জেলা, জলপাইগুড়ি এই অঞ্চলগুলো নিয়ে গঠিত ছিল। |
প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন শাসনামল
মৌর্য সাম্রাজ্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দ- খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দ)
- ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্য
- মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তার রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চাণক্য।
- মৌর্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয় সম্রাট অশোককে। সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে অনুশোচনা করেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্য (আনুমানিক ৩২০ খ্রিস্টাব্দ- ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধ)
- গুপ্ত সাম্রাজ্য ভারতীয় প্রাচীন যুগের ইতিহাসে অন্যতম ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে খ্যাত। এই যুগে ভারতে আবিষ্কার,স্থাপত্য, কলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য, দর্শনে অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করে।
- প্রথম চন্দ্রগুপ্ত হলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
- সমুদ্রগুপ্তকে বলা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা। পাটলিপুত্র ছিল তার রাজধানী।
- সমুদ্রগুপ্তের পর সিংহাসনে আরোহণ করেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। তার উপাধি ছিল ‘বিক্রমাদিত্য’।
- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভায় ছিলেন কালিদাস, অমরসিংহ, বরাহমিহির প্রমুখ। মহাকবি কালিদাস ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।
- ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে হুন জাতির আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়।
- গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালেই নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
পাল বংশ (৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ- ১১৬২ খ্রিস্টাব্দ)
- বাংলার অরাজক অবস্থার অবসান ঘটে পাল বংশের রাজ শাসন উত্থানের মাধ্যমে। বাংলার প্রথম বংশানুক্রমিক রাজ শাসন শুরু করে পাল বংশ।
- পাল বংশের প্রথম রাজা হলেন গোপাল।
- পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবে খ্যাত হলেন ধর্মপাল। তার উপাধি ‘বিক্রমশীল’।
- মদনপাল পাল বংশের সর্বশেষ রাজা। তার শাসনামলেই সন্ধাকর নন্দী সংস্কৃত কাব্য ‘রামচরিত’ রচনা করেন।
- পাল বংশের সময় নালন্দা বিহার শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে ছিল।
সেন বংশ (আনুমানিক ১০৯৭-১২২৫ খ্রিস্টাব্দ)
- সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অভিহিত করা হয় হেমন্ত সেনকে।
- বিজয় সেন সেন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা।
- বল্লাল সেন রাজা হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত ও লেখক। ‘অদ্ভুতসাগর’ ও ‘দানসাগর’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
- লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৮জন সৈনিক নিয়ে নদীয়া দখল করে।
উপমহাদেশে আগমনকারী পরিব্রাজক
মেগাস্থিনিস (গ্রিস) | মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে গ্রিক রাজা সেলিউকাসের দূত হিসেবে ভারতবর্ষে এসেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ অব্দে। মৌর্য শাসন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ‘ইন্ডিকা’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। |
ফা হিয়েন (চীন) | তিনি ভারতবর্ষে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে এসেছিলেন। তিনি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে ‘ফো- কুয়ো-কিং’ উল্লেখযোগ্য। |
হিউয়েন সাং (চীন) | রাজা হর্ষবর্ধনের দরবারে তিনি আট বছর অবস্থান করেন। তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ করেছিলেন এবং শীলভদ্রের কাছে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তার রচিত গ্রন্থ ‘সিদ্ধি’। |
মা হুয়ান (চীন) | তিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ এর শাসনামলে বাংলায় ভ্রমণ করেছিলেন। বাংলা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ‘ ইং ইয়াই শেং লান’ নামক গ্রন্থে পাওয়া যায়। |
ইবনে বতুতা (মরক্কো) | তিনি ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে বাংলায় ভ্রমণ করেন। তার রচিত গ্রন্থ ‘কিতাবুল রেহালা’-তে বাংলা ভ্রমণের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি প্রথম বিদেশি পর্যটক হিসেবে ‘বাঙ্গালা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি বিধায় তিনি বাংলাদেশকে ‘দোযখ ই পুর নিয়ামত’ হিসেবে অভিহিত করেন। |
উপমহাদেশ ও বাংলায় মুসলিম শাসন
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (১২০৬- ১২১০ খ্রি.)
তিনি উপমহাদেশে মুসলিম স্থায়ী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন তুর্কিস্তানের অধিবাসী। তিনি দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন করেন। দানশীলতার জন্য তাকে ‘লাখবক্স’ বলা হতো।
সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ (১২১১- ১২৩৬ খ্রি.)
সুলতান ইলতুৎমিশকে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি মুসলমান শাসকদের মধ্যে সর্বপ্রথম মুদ্রার প্রচলন করেন। বাগদাদের খলিফা তাকে ‘সুলতান-ই- আজম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সুলতানা রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রি.)
সুলতান ইলতুৎমিশের কন্যা। দিল্লির সিংহাসনের প্রথম নারী শাসক।
আলাউদ্দীন খিলজী (১২৯৬-১৩১৬ খ্রি.)
প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে দাক্ষিণাত্য জয় করেন। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই এর মতো তিনিও বলেছিলেন “আমিই রাষ্ট্র”।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫- ১৩৫১ খ্রি.)
তিনি সোনা ও রুপার বদলে তামার মুদ্রার প্রচলন করেন। কৃষির উন্নয়নের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দিওয়ান-ই- কোহী’ নামক কৃষি বিভাগ।
ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রি.)
বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। তিনি স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন।
শামসুউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮ খ্রি.)
ইলিয়াস শাহ পুরো বাংলা অধিকার করেন। তার শাসনামলেই বাঙালি একটি জাতি হিসেবে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে।
আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩- ১৫১৯ খ্রি.)
বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুলতান হিসেবে অভিহিত করা হয়। তার শাসনামল বঙ্গে মুসলমান শাসনের স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। কবি বিজয়গুপ্ত আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে নৃপতি তিলক, জগত ভূষণ ও কৃষ্ণ অবতার বলে আখ্যায়িত করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার উদারতা দেখে।
দাউদ খান কররানী (১৫৭৩-১৫৭৬ খ্রি.)
বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান। তিনি নিজ নামে খুতবা পাঠ এবং মুদ্রা প্রচলন করেন। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানী পরাজিত এবং নিহত হন। এর মাধ্যমে বাংলায় সুলতানি শাসনের অবসান ঘটে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সুলতানি আমলে নির্মিত স্থাপত্য
- ছোট সোনা মসজিদ (গৌড়-লখনৌতি) প্রতিষ্ঠিত করেন- আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
- বড় সোনা মসজিদ (গৌড়) ও বাঘা মসজিদ ( রাজশাহী) প্রতিষ্ঠিত করেন- নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ
- কুতুব মিনার- শুরু করেন কুতুবউদ্দিন আইবেক। নির্মাণ কাজ শেষ করেন শামসুউদ্দিন ইলতুৎমিশ।