ব্যাকটেরিয়া
ব্যাকটেরিয়া (Bacteria)
ব্যাকটেরিয়া (Bacteria, একবচনে Bacterium)
গ্রিক শব্দ Bakterion = little rod থেকে ব্যাকটেরিয়া শব্দটির উৎপত্তি। ব্যাকটেরিয়া (একবচনে ব্যাকটেরিয়াম) এক ধরনের ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীব। ওলন্দাজ বিজ্ঞানী (হল্যান্ড) অ্যান্টনি ভ্যান লীউয়েনহুক (Antony Van Leeuwenhoek 1632-1723) ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নিজের আবিষ্কৃত সরল অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি এগুলোর নাম দেন animalcule বা ক্ষুদ্র প্রাণী । ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর লন্ডন রয়্যাল সোসাইটিতে প্রদত্ত তার অঙ্কিত ছবিতে তিন আকৃতির ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখা যায়। সর্ব প্রথম আণুবীক্ষণিক সমীক্ষায় আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্র জীবের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য তাকে ব্যাকটেরিওলজি ও প্রোটোজুওলজির জনক বলা হয়ে থাকে। জার্মান বিজ্ঞানী এরেনবার্গ (Christian Gottfried Ehrenberg) ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এসব ক্ষুদ্রজীবদের ব্যাকটেরিয়া নামকরণ করেন। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাকটেরিয়ার ওপর ব্যাপক গবেষণা এবং ব্যাকটেরিয়া তত্ত্বকে (germ theory of disease) প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যাকটেরিয়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার কারণে লুই পাস্তুরকে অনেকেই আধুনিক ব্যাকটেরিওলজির জনক বলতে চান। জার্মান ডাক্তার রবার্ট কক (Robert Koch) অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন যে, প্রাণীর বহু রোগের কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া। তিনি যক্ষ্মা রোগের জন্য দায়ী Mycobacterium tuberculosis ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন এবং এজন্য তাঁকে ১৯০৫ সালে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
মানুষের দেহে যতগুলো কোষ আছে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া আছে। মানুষের অন্ত্র ও ত্বকে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যাক্টেরিয়া থাকে। এদের বেশিরভাগই কোনো ক্ষতি করে না। মানুষের দেহে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ বেশি ভয়ানক এবং এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে AIDS সংক্রমণে যত মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বেশি মারা যায় Methicillin-resistant Staphylococcus aureus (MRSA) নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে।
বিজ্ঞানের যে শাখায় ব্যাকটেরিয়ার গঠন, আবাস, রোগতত্ত্ব, বংশবিস্তার ইত্যাদি নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করা হয় তাকে ব্যাকটেরিওলজি বলে। ব্যাকটেরিয়া আদিকোষী (Prokaryotic) জীব। আদিকোষী জীবের বৈশিষ্ট্য হলো এদের কোষে কোনো ঝিল্লিবদ্ধ অঙ্গাণু থাকে না, যেমন নিউক্লিয়াস, মাইটোকন্ড্রিয়া, ক্লোরোপ্লাস্ট, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, গলগি কমপ্লেক্স, লাইসোজোম, সাইটোস্কেলেটন নেই। কেবলমাত্র রাইবোসোম থাকে। কোষে একটি দ্বিসূত্ৰক অখণ্ড, কার্যত বৃত্তাকার DNA অণু থাকে, যা ক্রোমোসোম হিসেবে পরিচিত। এতে হিস্টোন-প্রোটিন থাকে না। ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকায়, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এদের দেখা যায় না। এদের কোষে জড় কোষ প্রাচীর থাকে। তাই এরা উদ্ভিদের সাথে মিল সম্পন্ন।
ব্যাকটেরিয়ার সাধারণ বৈশিষ্ট্য (General characteristics of bacteria) :
১। ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত ছোট আকারের জীব, সাধারণত ০.২-৫.০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে, অর্থাৎ এরা আণুবীক্ষণিক (microscopic)।
২। এরা এককোষী জীব, তবে একসাথে অনেকগুলো কলোনি করে বা দল বেঁধে থাকতে পারে।
৩। ব্যাকটেরিয়া আদিকেন্দ্রিক (প্রাককেন্দ্রিক = Prokaryotic)। কোষে 70S রাইবোসোম থাকে; অন্য কোনো ঝিল্লিবদ্ধ অঙ্গাণু থাকে না।
৪। ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের প্রধান উপাদান পেপটিডোগ্লাইকান বা মিউকোপ্রোটিন, সাথে মুরামিক অ্যাসিড (Muramic acid) এবং টিকোয়িক অ্যাসিড (Teichoic acid) থাকে।
৫। এদের বংশগতীয় উপাদান (genetic material) হলো একটি দ্বিসূত্রক, কার্যত বৃত্তাকার DNA অণু, যা ব্যাকটেরিয়্যাল ক্রোমোসোম হিসেবে পরিচিত। এটি সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত, এতে ক্রোমোসোমাল হিস্টোন-প্রোটিন থাকে না। ব্যাকটেরিয়া কোষে DNA অবস্থানের অঞ্চলকে নিউক্লিয়য়েড বলা হয়।
৬। এদের বংশবৃদ্ধির প্রধান প্রক্রিয়া দ্বি-ভাজন (Binary fission)। ব্যাক্টেরিয়ার দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় সাধারণত ৩০ মিনিট সময় লাগে।
৭। এদের কতক পরজীবী ও রোগ উৎপাদনকারী, অধিকাংশই মৃতজীবী এবং কিছু স্বনির্ভর (autophytic)।
৮। এরা সাধারণত বেসিক রং ধারণ করতে পারে (গ্রাম পজিটিভ বা গ্রাম নেগেটিভ)।
৯। ফায ভাইরাসের প্রতি এরা খুবই সংবেদনশীল।
১০। এদের অধিকাংশই অজৈব লবণ জারিত করে শক্তি সংগ্রহ করে।
১১। ব্যাক্টেরিয়া প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এন্ডোস্পোর বা অন্তরেণু গঠন করে। এ অবস্থায় এরা ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।
১২। এরা -১৭ ডিগ্রি থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বাঁচে।
১৩। ক্রোমোসোম না থাকায় মাইটোসিস ও মায়োসিস ঘটে না।
১৪। এদের কতক বাধ্যতামূলক অবায়বীয় (obligate anaerobes) অর্থাৎ অক্সিজেন থাকলে বাঁচতে পারে না। উদা- Clostridium। কতক সুবিধাবাদী অবায়বীয় (facultative anaerobes) অর্থাৎ অক্সিজেনের উপস্থিতিতেও বাঁচতে পারে। কতক বাধ্যতামূলক বায়বীয় (obligate aerobes) অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না। উদা- Azotobacter beijerinckia।
ব্যাকটেরিয়ার গঠন (Bacterial structure)
ব্যাকটেরিয়ার বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও প্রকৃতিতে যেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে, এদের কোষীয় গঠন বৈশিষ্ট্যেও তেমনই উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান আছে। সবগুলো বৈশিষ্ট্যকে একত্র করে একটি আদর্শ ব্যাকটেরিয়ামের গঠন হিসেবে এখানে উপস্থাপন করা হলো।
১। কোষ প্রাচীর (Cell wall) :
প্রতিটি ব্যাকটেরিয়াম কোষকে ঘিরে একটি জড় কোষ প্রাচীর থাকে। কোষ প্রাচীরের প্রধান উপাদান মিউকোপ্রোটিন জাতীয় যাকে মিউরিন বা পেপটিডোগ্লাইকান বলে। পেপটিডোগ্লাইকান একটি কার্বোহাইড্রেট পলিমার। পেপটিডোগ্লাইকানের সাথে কিছু পরিমাণ মুরামিক অ্যাসিড এবং টিকোয়িক অ্যাসিডও থাকে। গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়াতে পেপটিডোগ্লাইকান স্তরটি বেশ পুরু থাকে যা ক্রিস্টাল ভায়োলেট রং ধরে রাখতে পারে। গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াতে পেপটিডোগ্লাইকান স্তরটি পাতলা থাকে এবং এর উপর ফসফোলিপিড বা লিপোপলিসেকারাইড-এর এক একটি পাতলা স্তর থাকে। এজন্য এরা ভায়োলেট রং ধরে রাখতে পারে না। মাইকোপ্লাজমাতে জড় প্রাচীর নেই বললেই চলে। এরা ক্ষুদ্রতম ব্যাকটেরিয়া। লাইসোজাইম এনজাইম দ্বারা এর কোষ প্রাচীর বিগলিত হয়।
২। ক্যাপসিউল (Capsules) :
বহু ব্যাকটেরিয়াতে কোষ প্রাচীরকে ঘিরে জটিল কার্বোহাইড্রেট বা পলিপেপটাইড দিয়ে গঠিত একটি পুরু স্তর থাকে, যাকে ক্যাপসিউল বলে। একে স্লাইম স্তরও বলা হয়। প্রতিকূল অবস্থা থেকে ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করাই এর প্রধান কাজ।
৩। (Flagella) :
অনেক ব্যাকটেরিয়াতে একটি ফ্ল্যাজেলাম বা একাধিক ফ্ল্যাজেলা থাকে। ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলা নলাকার রডবিশেষ । ফ্ল্যাজেলিন নামক প্রোটিন দিয়ে ফ্ল্যাজেলা গঠিত। প্রতিটি ফ্ল্যাজেলামের তিনটি অংশ থাকে। যথা- (i) সূত্র (ii) সংক্ষিপ্ত হুক এবং (iii) ব্যাসাল বডি। ব্যাসাল বডি ফ্ল্যাজেলামকে কোষের প্লাজমামেমব্রেনের সাথে সংযুক্ত রাখে। ফ্ল্যাজেলা ব্যাকটেরিয়ার চলনে অংশগ্রহণ করে।
৪। পিলি (Pili) :
কতগুলো গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ায় অপেক্ষাকৃত ক্ষদ্র, দৃঢ়, সংখ্যায় অধিক লোম সদৃশ অঙ্গ থাকে যাকে পিলি বলে। পিলি, পিলিন (Pilin) নামক এক প্রকার প্রোটিন দিয়ে তৈরি। পোষক কোষের সাথে সংযুক্তির কাজ করে থাকে পিলি। গনোরিয়া ব্যাকটেরিয়া পিলি দ্বারা পোষক কোষের সাথে সংযুক্ত হয়।
৫। প্লাজমামেমব্রেন (Plasma Membrane) :
সাইটোপ্লাজমকে বেষ্টন করে সজীব প্লাজমামেমব্রেন অবস্থিত। এটি সরল শৃঙ্খলের ফসফোলিপিড বাইলেয়ার হিসেবে অবস্থিত, এর সাথে মাঝে মাঝে প্রোটিন থাকে। এতে কোলেস্টেরল থাকে না। ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমামেমব্রেন অনেক মেটাবলিক কাজ করে থাকে। বায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমামেমব্রেন বহু শ্বসনিক ও ফসফোরাইলেটিক এনজাইম ধারণ করে (মাইটোকন্ড্রিয়ার অনুরূপ)। ফটোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়াতে প্লাজমামেমব্রেন ভেতরের দিকে ভাঁজ হয়ে থাইলাকয়েড সদৃশ গঠন সৃষ্টি করে। ব্যাকটেরিয়াতে মাইটোকন্ড্রিয়া নেই, তবুও কিছু ATP তৈরি হয় সাবস্ট্রেট লেভেল ফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায়, কারণ ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমামেমব্রেনে ফসফোরাইলেটিক এনজাইম থাকে।
৬। মেসোসোম (Mesosome) :
ব্যাকটেরিয়া কোষের প্লাজমামেমব্রেন কখনো কখনো ভেতরের দিকে ভাঁজ হয়ে থলির মতো গঠন সৃষ্টি করে যাকে মেসোসোম বলে। অনেকের মতে মেসোসোম কোষ বিভাজনে সাহায্য করে থাকে।
৭। সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) :
সাইটোপ্লাজমিক মেমব্রেন দিয়ে পরিবেষ্টিত অবস্থায় সাইটোপ্লাজম অবস্থিত। সাইটোপ্লাজম বর্ণহীন, স্বচ্ছ। এতে বিদ্যমান থাকে ছোট ছোট কোষ গহ্বর, চর্বি, শর্করা জাতীয় খাদ্য, প্রোটিন, খনিজ পদার্থ (লৌহ, ফসফরাস, সালফার ইত্যাদি)। গহ্বরগুলো কোষরস দিয়ে পূর্ণ থাকে। সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য অঙ্গাণু হলো মুক্ত রাইবোসোম এবং পলিরাইবোসোম। সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে ক্রোম্যাটোফোর থাকে। তরুণ ব্যাক্টেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানার আকারে ভলিউটিন থাকে। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে এসব দানা কোষ গহ্বরে স্থানান্তরিত হয়।
৮। ক্রোমোসোম (Chromosome) :
কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াসের পরিবর্তে কেবল মাত্র একটি ক্রোমোসোম থাকে, যা সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দ্বিসূত্ৰক DNA অণু। এটি কার্যত বৃত্তাকার এবং নগ্ন অর্থাৎ এতে ক্রোমোসোমাল হিস্টোন প্রোটিন থাকে না। ক্রোমোসোমকে ঘিরে কোনো নিউক্লিয়ার আবরণ থাকে না। সাইটোপ্লাজমস্থ DNA সমৃদ্ধ অঞ্চলকে নিউক্লিয়য়েড (Nucleoid) বলে।
৯। প্লাসমিড (Plasmid) :
বহু ব্যাকটেরিয়াতে বৃহৎ ক্রোমোসোম ছাড়াও একটি ক্ষুদ্রাকায় ও প্রকৃত বৃত্তাকার DNA অণু থাকে, যাকে বলা হয় প্লাসমিড। প্লাসমিড স্ববিভাজন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং এতে স্বল্প সংখ্যক জিন থাকে। ভেক্টর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ব্যাকটেরিয়ার জনন
বর্ণনা :
ব্যাকটেরিয়ার জনন (Reproduction of Bacteria)
ব্যাকটেরিয়ার প্রধান জনন পদ্ধতি হলো দ্বি-ভাজন পদ্ধতি। এটি একটি অযৌন পদ্ধতি। কুঁড়ি তথা মুকুলোদগম প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়াতে সংখ্যাবৃদ্ধি হতে পারে। কুঁড়ি সৃষ্টি পদ্ধতিকে অঙ্গজ জনন পদ্ধতি বলা যেতে পারে।
দ্বি-ভাজন (Binary fission) :
একটি কোষ সমান দুই ভাগে ভাগ হওয়ার নাম দ্বি-ভাজন। অন্যভাবে বলা যায় দ্বি-ভাজন হলো আদি কোষের অযৌন জনন প্রক্রিয়া যেখানে নিউক্লিয়ার বস্তু (DNA) সমান দুই ভাগে বিভক্ত হয়। দ্বি-ভাজন পদ্ধতিই ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাবৃদ্ধি তথা প্রজননের প্রধান উপায়। এ প্রক্রিয়ায় একটি ব্যাকটেরিয়াম কোষ বিভক্ত হয়ে সমআকারের দুটিতে পরিণত হয় এবং এভাবেই দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত উপায়ে সম্পন্ন হয়।
১। ব্যাকটেরিয়াল ক্রোমোসোম তথা DNA ব্যাকটেরিয়া কোষের দুই প্রান্তের মাঝামাঝি অবস্থান নেয় এবং প্লাজমামেমব্রেনের সাথে সংযুক্ত হয়।
২। প্লাজমামেমব্রেনের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় DNA-অণুর প্রতিলিপন হয়।
৩। এ অবস্থায় কোষটি লম্বায় বৃদ্ধি পায়। কোষপ্রাচীর এবং প্লাজমামেমব্রেনের বৃদ্ধি কোষের দুই প্রান্তের মাঝখানে ঘটে থাকে।
৪। কোষপ্রাচীর ও প্লাজমামেমব্রেন লম্বায় বৃদ্ধির কারণে DNA রেপ্লিকা দুটি দুই দিকে পৃথক হয়ে যায়।
৫। লম্বায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কোষের মাঝখানে প্লাজমামেমব্রেন ক্রমশ ভেতরের দিকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং একই সাথে ঐ অংশে কোষপ্রাচীর সংশ্লেষিত হতে থাকে। এক সময় একটি কোষ দুটি কোষে পরিণত হয়।
৬। শেষ পর্যায়ে টার্গার প্রেসারের কারণে নতুন সৃষ্ট অপত্য কোষ দুটি পরস্পর হতে পৃথক হয়ে যায়।
৭। পৃথক অপত্য কোষ দুটি বৃদ্ধি পেয়ে মাতৃকোষের সমান আকারের হয় এবং পুনরায় দ্বি-ভাজন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
পরিবেশ উপযুক্ত হলে আমাদের অন্ত্রের E. coli ব্যাকটেরিয়া প্রতি বিশ মিনিটে সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পারে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এক দিনে E. coli-এর ৭২টি জেনারেশন সৃষ্টি হতে পারে । কিন্তু বাস্তবে তা হয় না, কারণ কয়েক জেনারেশন বৃদ্ধির পরই এদের খাবার ঘাটতি দেখা দেয় এবং এদের বর্জ্য পরিবেশকে বিষাক্ত করে ফেলে, তাই দ্বিভাজন প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়। সংক্রামক ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে পোষক দেহের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা ব্যাকটেরিয়ার অব্যাহত দ্বি-ভাজন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রয়োগকৃত ওষুধও দ্বি-ভাজন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারে, ফলে রোগ আরোগ্য হয়। কিছু প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া অনুকূল পরিবেশে মুকুলোদগম প্রক্রিয়ায় অঙ্গজ জনন সম্পন্ন করে।
মুকুলোদগম (Budding) :
(i) কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়াতে মুকুলোদগম তথা কুঁড়ি সৃষ্টির মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। প্রথমে এক পাশে একটি ছোট কুঁড়ি বের হয়।
(ii) পরে একদিকে কুড়িটি ধীরে ধীরে বড় হয় এবং অপর দিকে মূল ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিয়য়েড বস্তুটি দুই খণ্ডে বিভক্ত হয়।
(iii) নিউক্লিয়য়েড বম্ভর একটি খণ্ড মুকুলে প্রবেশ করে।
(iv) মুকুলটি মাতৃকোষের প্রায় সমান হলে পৃথক হয়ে যায়।
অযৌন জনন (Asexual reproduction) :
প্রতিকূল পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া গনিডিয়া বা এন্ডোস্পোর সৃষ্টির মাধ্যমে প্রজনন সম্পন্ন করে। এই পদ্ধতিকে অযৌন জনন পদ্ধতি বলা হয়।
(i) গনিডিয়া (Gonidia) :
Leucothris জাতীয় সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়ার অগ্রভাগ হতে গনিডিয়া নামক অযৌন একক সৃষ্টি হয় যা একসময় পৃথক হয়ে যায় এবং অনুকূল পরিবেশে পূর্ণাঙ্গ ব্যাকটেরিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
(ii) এন্ডোস্পোর বা অন্তরেণু উৎপাদন (Endospore or other molecular production) :
সাধারণত Bacillaceae গোত্রের ব্যাকটেরিয়া অন্তরেণু উৎপন্ন করে থাকে। একটি ব্যাক্টেরিয়াম হতে একটি অন্তরেণু উৎপন্ন হয় তাই এর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটে না, প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে মাত্র। অন্তরেণু গোলাকার বা ডিম্বাকার এবং অত্যন্ত পুরু প্রাচীরে আবৃত থাকে। অনুকূল পরিবেশে অন্তরেণু অঙ্কুরিত হয়ে একটি মাত্র ব্যাক্টেরিয়া কোষ সৃষ্টি করে। এটি প্রকৃতপক্ষে জনন প্রক্রিয়া নয়।
যৌন জনন (Sexual reproduction) :
প্রকৃতপক্ষে ব্যাকটেরিয়াতে কোনো যৌন জনন ঘটে না। এখানে কোনো গ্যামিট সৃষ্টি হয় না, কোনো মায়োসিস বিভাজন হয় না, কোনো ডিপ্লয়েড কোষ তৈরি হয় না, কোনো জাইগোটও তৈরি হয় না। তবে বংশগতীয় বস্তু (genetic material) স্থানান্তর হয়। বংশগতীয় বস্তু (ব্যাকটেরিয়াল ক্রোমোসোম বা DNA) তিনভাগে স্থানান্তরিত হতে পারে।
(i) কনজুগেশন নালিপথে (Conjugation duct) :
একটি দাতা কোষ ও একটি গ্রহীতা কোষের মধ্যে একটি ফাঁপা নলের মতো কনজুগেশন নালি সৃষ্টি হয়। এই নালিপথে দাতা কোষ থেকে সাধারণত প্লাসমিড গ্রহীতা কোষে স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে প্লাসমিড অনুলিপিত হয়, একটি দাতা কোষ থেকে যায়, অপরটি নালিপথে গ্রহীতা কোষে স্থানান্তরিত হয়। বহু ব্যাকটেরিয়া এভাবে প্রচলিত ওষুধের প্রতি প্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। অতি বিরল ক্ষেত্রে দাতা কোষের আংশিক ক্রোমোসোমও এই নালিপথে গ্রহীতা কোষে স্থানান্তরিত হতে পারে। সাধারণত ক্রোমোসোমের কিয়দংশ গ্রহীতা কোষে প্রবেশের পর নালির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গ্রহীতা কোষের ক্রোমোসোমের সাথে দাতা কোষের আংশিক ক্রোমোসোমের রিকম্বিনেশন ঘটে। অতিরিক্ত অংশ বিগলিত হয়ে যায়। গবেষণাগারে এটা ঘটানো সম্ভব হলেও প্রকৃতিতে খুবই কম ঘটে থাকে।
(ii) পরিবেশ থেকে অন্য ব্যাকটেরিয়ার (সাধারণত মৃত ব্যাকটেরিয়ার) DNA গ্রহীতা কোষে প্রবেশ করে রিকম্বিনেশন ঘটতে পারে। একে বলে ট্রান্সফরমেশন (Transformation)।
(iii) ফায ভাইরাসের মাধ্যমে এক ব্যাকটেরিয়ার জিনোম, কখনও ফায জিনোম, অন্য ব্যাকটেরিয়াতে প্রবেশ করে রিকম্বিনেশন ঘটাতে পারে। একে বলে ট্রান্সডাকশন (Transduction)।