10 Minute School
Log in

কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল (Centripetal and Centrifugal Force)

বৃত্তপথে আবর্তনরত বস্তুর গতির অভিমুখ প্রতি মুহূর্তে পালটে যায়; সুতরাং ঐ বস্তুর উপর নিশ্চই বাইরে থেকে সবসময় একটি বল ক্রিয়া করে। কেন্দ্রমুখী (Centripetal Force) ও কেন্দ্রবিমুখী বল (centrifugal force) এর প্রভাবে এটি হয়ে থাকে।

𝑚 ভরের কোনো বস্তু যখন 𝑟 ব্যাসার্ধের বৃত্তপথে 𝑣 দ্রুতি নিয়ে ঘুরতে থাকে তখন ঐ বস্তুর উপর সবসময় কেন্দ্রাভিমুখী ত্বরণ \frac{v^2}{r} ক্রিয়া করে। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী একটি বল ক্রিয়া করায় এই ত্বরণ সৃষ্টি হচ্ছে।

স্পষ্টত এই বলও কেন্দ্রাভিমুখী হবে অর্থাৎ ব্যাসার্ধ বরাবর বৃত্তের কেন্দ্রের দিকে ক্রিয়া করবে এবং এর মান বস্তুর ভর ও অভিকেন্দ্র ত্বরণের গুণফলের সমান অর্থাৎ \frac{mv^2}{r} এর সমান হবে। কোনো কারণে এই বলের ক্রিয়া বন্ধ হলে বস্তুটিকে বৃত্তপথে ঘোরাবার জন্য কোনো বল থাকবে না। তখন বস্তুটি বৃত্তের স্পর্শক বরাবর ছুটে যাবে এবং সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকবে।

যে বলের ক্রিয়ায় কোনো বস্তু সমদ্রুতিতে বৃত্তপথে চলতে থাকে এবং যে বল সবসময় বস্তুর গতিপথের সঙ্গে লম্বভাবে ভেতরের দিকে অর্থাৎ বৃত্তের কেন্দ্রাভিমুখে ক্রিয়া করে সেটিই হচ্ছে  কেন্দ্রমুখী বা অভিকেন্দ্র বল (Centripetal force)

𝑚 ভরের বস্তু 𝑟 ব্যাসার্ধের বৃত্তপথে সমদ্রুতি 𝑣 নিয়ে চলতে থাকলে অভিকেন্দ্র বলের মান \frac{mv^2}{r} হয়। কৌণিক বেগে প্রকাশ করলে অভিকেন্দ্র বলের মান হয় m\omega^2 r

কেন্দ্রমুখী বল একটি কার্যহীন বল (Centripetal force is a no-work force) :

অভিকেন্দ্র বা Centripetal force সবসময় গতিপথের লম্বদিকে ক্রিয়া করায় ঐ বলের অভিমুখে বস্তুর কোনো সরণ হয় না। সুতরাং অভিকেন্দ্র বল কোনো কাজ করে না। এই কারণে একে কার্যহীন বা No-work force বলা হয়।

কেন্দ্রমুখী প্রতিক্রিয়া (Centrifugal reaction) :

বৃত্তপথে আবর্তনরত বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল অভিকেন্দ্র বল বাইরে থেকে প্রযুক্ত হয়। বাইরে থেকে যে বস্তু ঐ বল প্রয়োগ করে তার উপর প্রথম বস্তুটি নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করে। স্পষ্টত এই প্রতিক্রিয়া বল বৃত্তের কেন্দ্র থেকে ব্যাসার্ধ বরাবর বাইরের দিকে ক্রিয়া করে। একে কেন্দ্রবিমুখী প্রতিক্রিয়া (Centrifugal reaction) বলে।

মনে কর, একটি পাথরের টুকরাকে সুতোয় বেঁধে বৃত্তাকার পথে ঘোরানো হচ্ছে। পাথরটির উপর সবসময় সুতোর মাধ্যমে অভিকেন্দ্র বল F_C ক্রিয়া করছে। এখানে সুতোর টানই হলো প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বল।

সুতোটি হঠাৎ ছিড়ে গেলে অভিকেন্দ্র বল F_C এর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়; সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি বৃত্তের স্পর্শক বরাবর সরলরেখায় সমবেগে ছুটে যায়। বৃত্তাকার পথে ঘুরবার সময় পাথরটি হাতের উপর সমান ও বিপরীতমুখী অপকেন্দ্র প্রতিক্রিয়া F_R প্রয়োগ করে; ফলে হাতের উপর কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে একটি টান অনুভূত হয়। অন্যান্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মত এখানেও F_C এবং F_R একই বস্তুর উপর ক্রিয়া করে না; দুটি পৃথক বস্তু যেমন, যথাক্রমে পাথর খণ্ড ও হাতের উপর ক্রিয়া করে। সুতো ছিঁড়ে গেলে দুটি বলই একসঙ্গে লোপ পায়।

কেন্দ্রবিমুখী বা অপকেন্দ্র বল (Centrifugal force):

বৃত্তপথে আবর্তনরত প্রতিটি বস্তুর উপর সবসময় বৃত্তের কেন্দ্রাভিমুখী বা অভিকেন্দ্র বল ক্রিয়া করে। পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এখানে পৃথিবীর উপর সূর্যের মহাকর্ষীয় আকর্ষণই হলো অভিকেন্দ্র বা Centrifugal force। অভিকেন্দ্র বা অপকেন্দ্র বল একটি অলীক বল।

বৃত্তপথে আবর্তনরত সব বস্তুরই বৃত্তের স্পর্শক বরাবর ছুটে যাওয়ার প্রবণতা থাকে; যেমন, ঘুরন্ত পাথরের উদাহরণে সুতো ছিঁড়ে গেলে পাথরটি স্পর্শক বরাবর ছুটে যায়।

সমদ্রুতিতে বৃত্তপথে আবর্তনরত বস্তুর উপর অভিকেন্দ্র বলের সমান ও বিপরীতমুখী অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে একটি অলীক বল ক্রিয়া করে। এর নামই কেন্দ্রবিমুখী বা অপকেন্দ্র বল

(ক) ঘর্ষণ স্থিতি: 

ঘর্ষণ স্বনিয়ন্ত্রক। বাঁক নেয়ার সময় গাড়ির চাকাগুলি বাইরের দিকে ছিটকে যেতে চায়। ঘর্ষণ বল রাস্তার বাঁকের কেন্দ্রমুখী ক্রিয়া করে এই হড়কে যাওয়ার প্রবণতাকে বাধা দেয়। গাড়িটি খুব দ্রুত বেগে চলতে চলতে বাঁক নিলে প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বলের মানও খুব বেশি হয়। কিন্তু ঘর্ষণ বলের মান একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি হতে পারে না। তাই গাড়ি খুব দ্রুতগতিতে বাঁক নিলে ঘর্ষণ বল প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বল সরবরাহ করতে পারে না। ফলে গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিটকে যায়।

মনেকরি, 𝑚 ভরের একটি গাড়ি 𝑣 দ্রুতি নিয়ে 𝑟 ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তাকার পথে বাঁক নিচ্ছে। গাড়ির চাকা এবং রাস্তার ক্রিয়াশীল মোট ঘর্ষণ বল 𝐹 হলে গাড়িটি নিরাপদে বাঁক নেয়ার শর্ত হবে 

F=\frac{mv^2}{r}

 

গাণিতিক বিশ্লেষণ
F=\frac{mv^2}{r}

F = কেন্দ্রবিমুখী বল
r = বৃত্তাকার পথের ব্যাসার্ধ
ω = কৌণিক বেগ
m = বস্তুর ভর

 

𝐹 এর মান যত বেশি হবে গাড়িটি তত বেশি বেগে বাঁক নিতে পারবে। কিন্তু 𝐹-এর সর্বোচ্চ মান হলো 𝜇𝑚𝑔; মানে 𝜇 হলো গাড়ির চাকা এবং রাস্তার মধ্যে স্থিতি ঘর্ষণ গুণাঙ্ক। অর্থাৎ, 𝐹≤ 𝜇𝑚𝑔

সুতরাং, গাড়িটি নিরাপদে বাঁক নেয়ার শর্ত হলো \frac{mv^2}{r}\leq \mu m g

v^2\leq \mu r g v\leq (\mu r g)^{\frac{1}{2}}

গাড়ির দ্রুতি এই মান থেকে অর্থাৎ (\mu r g)^{\frac{1}{2}} থেকে বেশি হলে গাড়ি রাস্তা থেকে ছিটকে যাবে।2

(খ) ব্যাঙ্কিং যুক্ত রাস্তায় গাড়ির বাঁক নেয়া : 

অনুভূমিক রাস্তায় গাড়ি জোরে বাঁক নিলে গাড়ির চাকা এবং রাস্তার মধ্যে ক্রিয়াশীল ঘর্ষণ বল চাকার ক্ষতি করে। এই শক্তি কমাবার জন্য এবং গাড়ি ছিটকে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রোধ করার জন্য প্রতিটি বাঁকে রাস্তার বাইরের দিক ভেতরের দিকের চেয়ে কিছুটা উঁচু করা হয় অর্থাৎ রাস্তাটি বাঁকের কেন্দ্রের দিকে একটু ঢালু করা থাকে। একে রাস্তার ‘ব্যাঙ্কিং’ বলা হয়ে থাকে। এর ফলে গাড়ি বাঁক নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বলের একাংশ গাড়ির উপর রাস্তা দ্বারা প্রযুক্ত প্রতিক্রিয়া বলের অনুভূমিক উপাংশ যোগান দেয়; বাকি অংশ ঘর্ষণ থেকে আসে। ব্যাঙ্কিং কোণের মান সঠিক হলে প্রতিক্রিয়ার অনুভূমিক উপাংশ থেকেই প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বল পাওয়া যায়; তখন ঘর্ষণ বলের কোন ভূমিকা থাকে না। 

বল

চিত্র: ব্যাঙ্কিং যুক্ত রাস্তায় গাড়ির বাঁক নেয়া।

এখানে গাড়ির উপর দুটি বল ক্রিয়া করছে- (i) গাড়ির ওজন W খাড়া নিচের দিকে ক্রিয়া করে এবং রাস্তা দ্বারা প্রযুক্ত প্রতিক্রিয়া R রাস্তার তলের সঙ্গে লম্বভাবে উপরের দিকে ক্রিয়া করে। [চিত্র]। মনে করি রাস্তার তল অনুভূমিক তলের সঙ্গে θ কোণে আনত; θ-টি হচ্ছে ব্যাঙ্কিং কোণ (angle of banking)। প্রতিক্রিয়া R -এর উল্লম্ব উপাংশ Rcosθ গাড়ির ওজন W-কে প্রতিমিত করে এবং অনুভূমিক উপাংশ Rsinθ প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বলের যোগান দেয়। গাড়ির ভর m, দ্রুতি v এবং রাস্তার বাঁকের ব্যাসার্ধ r হলে

R Sin(\theta) =\frac{mv^2}{r} R Cos(\theta) = W = mg

ভাগ করে পাই, tan(\theta) = \frac{v^2}{rg}…    …   …   (4.46)

বর্তমানে আধুনিক হাইওয়ের (Highway) প্রতিটি বাঁকে দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য ব্যাঙ্কিং করা হয়। রেললাইনের বাঁকেও ব্যাঙ্কিং করা হয়; বাইরের লাইনটিকে ভেতরের লাইন থেকে উচু করে বসানো হয়। প্রতিটি বাঁকের মুখে সর্বোচ্চ দ্রুতিসীমা লেখা বোর্ড টাঙানো থাকে; ফলে চালকরা এই সীমার বেশি বেগে গাড়ি চালাবার সম্পর্কে সজাগ থাকেন। তাই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমে যায়। 

(গ) সাইকেল আরোহীর বাঁক নেওয়া :

 কোনো সাইকেল আরোহীর বাঁক নেওয়ার ঘটনাও আমরা অনুরূপভাবে আলোচনা করতে পারি। বাঁক নেওয়ার সময় সাইকেলসহ আরোহী আপনা আপনিই ভেতরের দিকে অর্থাৎ রাস্তার বাঁকের কেন্দ্র যেদিকে সেদিকে ঝুঁকে পড়ে:

সাইকেল আরোহীর বাঁক নেওয়া

চিত্র: সাইকেল আরোহীর বাঁক নেওয়া।

ফলে সাইকেলসহ আরোহী আনতভাবে রাস্তার উপর চাপ দেয়; অতএব রাস্তার প্রতিক্রিয়া R আনুভূমিক তলের সঙ্গে θ কোণ করে সাইকেলের উপর প্রযুক্ত হয়। এই প্রতিক্রিয়ার অনুভূমিক উপাংশই প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বলের যোগান দেয়। যদি বাঁকের মুখে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সাইকেলসহ আরোহী উল্লম্ব রেখার সঙ্গে θ কোণ করে ভেতরের দিকে ঝুঁকে তাহলে প্রতিক্রিয়া বল R এর উল্লম্ব এবং অনুভূমিক উপাংশ হবে Rcosθ এবং Rsinθ। প্রতিক্রিয়ার এই উল্লম্ব উপাংশ আরোহীসমেত সাইকেলের ওজন mg-কে প্রশমিত করে আর অনুভূমিক উপাংশই প্রয়োজনীয় কেন্দ্রমুখী বল \frac{mv^2}{r} সরবরাহ করে।

\therefore R cos{\theta} = mg

এবং R sin{\theta} = \frac{mv^2}{r}

tan(\theta) = \frac{v^2}{rg} \therefore \theta = tan^{-1} (\frac{v^2}{rg})

সাইকেলসহ আরোহীকে এই θ কোণে বাঁক নিতে হবে। আরোহীর বেগ যত বেশি হবে বাঁকের ব্যাসার্ধ তত কম হবে এবং তাকে তত বেশি হেলতে হবে। উপরিউক্ত সমীকরণ থেকে সাইলেকসহ আরোহীর বেগ v = \sqrt{rg\tan{\theta}} নির্ণয় করা যায়।

(ঘ) গ্রহগুলোর গতি (Motion of the planets) :

গ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে আবর্তন করছে। এখানে প্রতিটি গ্রহের উপর ক্রিয়ারত সূর্যের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলই হলো প্রয়োজনীয় অভিকেন্দ্র বল।

অনুরূপভাবে গ্রহের চারদিকে আবর্তনরত উপগ্রহের ক্ষেত্রে অভিকেন্দ্র হলো গ্রহের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল।

(ঙ) পানি ভর্তি বালতির উল্লম্বতলে আবর্তন:

পানি ভর্তি একটি বালতিকে উল্লম্বতলে জোরে ঘুরালে দেখা যাবে যে, বালতিটি যখন সর্বোচ্চ বিন্দুতে উপুড় হয়ে অবস্থান করে তখনও বালতি থেকে পানি পড়ে যায় না। এর কারণ ঘূর্ণন গতির ফলে পানির উপর যে কেন্দ্রবিমুখ বল ক্রিয়া করে সর্বোচ্চ বিন্দুতে বালতি যখন উপুড় হয়ে যায় তখন সেটি উর্ধ্বমুখে ক্রিয়া করে পানির ওজনকে নাকচ করে, ফলে পানি পড়ে যায় না।

পানি ভর্তি বালতির উল্লম্বতলে আবর্তন

চিত্র: পানি ভর্তি বালতির উল্লম্বতলে আবর্তন


এইচএসসি পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে আজই জয়েন করো ১০ মিনিট স্কুলের এই কোর্সগুলোতেঃ


১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com