10 Minute School
Log in

ব্যাকটেরিয়ার ধ্বংস( Destroying bacteria)

ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে ম্যাক্রোফেজ ও নিউট্রোফিল-এর ভূমিকা (দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর) (Role of Macrophages and Neutrophils in Destroying Bacteria)

দেহে প্রবিষ্ট ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) ধ্বংসে দুধরনের ফ্যাগোসাইটিক কোষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:

১. ম্যাক্রোফেজ ও

২. নিউট্রোফিল।

 

১. ম্যাক্রোফেজ (Macrophage: গ্রিক makros = lurge; phagein = eat, অর্থাৎ big eaters):

মনোসাইট হচ্ছে বৃক্কাকার ও দানাহীন সাইটোপ্লাজমবিশিষ্ট শ্বেত রক্তকণিকা দেহের মোট শ্বেত রক্তকণিকার ৪ শতাংশ মনোসাইট। অস্থিমজ্জার স্টেমকোষ থেকে উৎপন্ন হয়ে এসব কোষ ১০-২০ ঘন্টা রক্তে সংবহিত হওয়ার পর কৈশিকনালির প্রাচীরের ভিতর দিয়ে টিস্যুতে অভিযাত্রী হয়ে ফুলতে শুরু করে এবং প্রায় ৫ গুণ বড় হয়ে ৬০-৮০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়। পরিণত এ মনোসাইটকে ম্যাক্রোফেজ বলে। কিছু ম্যাক্রোফেজ সারা শরীরে পরিভ্রমণ করে, অন্যগুলো স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট টিস্যুতে (যেমন- ফুসফুস, যকৃত, বৃক্ক, যোজক টিস্যু, মস্তিষ্ক ও বিশেষ করে লসিকা গ্রন্থি ও প্লীহা) অবস্থান নেয়। প্রয়োজনে এখানে ম্যাক্রোফেজ ৪০ মাইক্রোমিটার/মিনিট গতিতে ক্ষণপদীয় চলনের সাহায্যে স্থানান্তরিত হয় এবং বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে।

ম্যাক্রোফেজ দেহে প্রবিষ্ট বিজাতীয় পদার্থের প্রতি ইমিউন সাড়াদানে মূল ভূমিকা পালন করে। তখন মনোসাইটগুলো টিস্যুতে অভিযাত্রী হয়ে ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়। ম্যাক্রোফেজের উপস্থিতি দেখেই ধারণা করা যায় যে দেহে বহিরাগতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ইমিউনতন্ত্রের মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ম্যাক্রোফেজ নিউট্রোফিলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ফ্যাগোসাইট হিসেবে কাজ করে। তখন একেকটি ম্যাক্রোফেজ প্রায় ১০০টির  মতো ব্যাকটেরিয়া গ্রাস করতে পারে, কখনওবা সম্পূর্ণ লাল রক্তকণিকা, ছত্রাক বা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর মতো বড় পদার্থও গ্রাস করে। ম্যাক্রোফেজ এসব পদার্থ গ্রহণ ও পরিপাক শেষে অপাচ্য অংশ বহিষ্করণের পরও অনেক সময় জীবিত থাকে এবং আরও কয়েক মাস সক্রিয় থাকে। সাইটোকাইন (cytokine) নামক রাসায়নিক বার্তাবাহক ক্ষরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কোষকে একত্রিত করে ক্ষত নিরাময়ে ভূমিকা পালন করে।

২. নিউট্রোফিল (Neutrophils):

নিউট্রোফিল হচ্ছে ১২-১৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসসম্পন্ন, ২–৫ খন্ডবিশিষ্ট। নিউক্লিয়াসযুক্ত (খন্ডগুলো পরস্পরের সাথে সূক্ষ্ম তত্তুর সাহায্যে যুক্ত) ও সূক্ষ্ম দানাময় সাইটোপ্লাজমবিশিষ্ট শ্বেত রক্তকণিকা দেহের মোট শ্বেত রক্তকণিকার ৬০-৭০ শতাংশই নিউট্রোফিল। এসব কণিকা ক্ষণপদীয় চলন প্রদর্শন করে (৪০ মাইক্রোমিটার/মিনিট) এবং অস্থিমজ্জার স্টেমকোষ থেকে উৎপন্ন হয়। একজন স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক মানুষে দৈনিক প্রায় ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) নিউট্রোফিল উৎপন্ন হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে পরিণত নিউট্রোফিলে রূপ নেয়। এগুলো ক্ষণস্থায়ী রক্তকণিকা, রক্ত প্রবাহে প্রবেশের পর ১২ ঘন্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকে, তবে টিস্যুতে প্রবেশ করলে কিছুদিন বেশি বাঁচে। কণিকাগুলো যেহেতু ক্ষণজীবী তাই দেহের সুরক্ষায় কখন এসব কণিকার প্রয়োজন পড়ে সে কারণে বিপুল সংখ্যক নিউট্রোফিল অস্থিমজ্জায় সব সময় মজুদ থাকে। অস্থিমজ্জার বাইরে সংবহিত ১০০ বিলিয়ন নিউট্রোফিলের মধ্যে অর্ধেক থাকে টিস্যুতে বাকি অর্ধেক রক্ত বাহিকায়। যেগুলো রক্তবাহিকায় থাকে তার অর্ধেক থাকে মূল ও দ্রুত রক্তস্রোতে, বাকি অর্ধেক চলে ধীরে সুস্থে রক্তবাহিকার অন্তপ্রাচীর ঘেঁষে (সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন টিস্যুতে প্রবেশ করতে পারে)।

Immunity

Immunity

নিউট্রোফিল হচ্ছে সক্রিয় ফ্যাগোসাইটিক শ্বেত রক্তকণিতা। এগুলো বহিরাগত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা যে কোনো আণুবীক্ষণিক প্রোটিন কণা গ্রাস করে নেয়। কণিকার অভ্যন্তরে লাইসোজোম যে সক্রিয় প্রোটিওলাইটিক এনজাইম ধারণ করে রাখে তার সাহায্যে গৃহীত বস্তু ধ্বংস করে। নিউট্রোফিলের পক্ষে ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে বড় পদার্থকে গ্রাস করা সম্ভব হয় না। একটি নিউট্রোফিল ৩-২০ টি ব্যাকটেরিয়া গ্রাস করতে পারে। এরপর সেটি নিজেই নিষ্ক্রিয় হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

ফ্যাগোসাইটোসিস

(Phagocytosis: গ্রিক phagein = to eat; kytos = cell;

olsis = process কোষভক্ষণ প্রক্রিয়া)

যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা দেহরক্ষার অংশ হিসেবে ক্ষণপদ সৃষ্টি করে দেহে অনুপ্রবেশকারী জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস প্রভৃতি) বা টিস্যুর মৃতকোষ ও অন্যান্য বহিরাগত কণাকে গ্রাস ও এনজাইমের সাহায্যে ধ্বংস করে দেহকে আজীবন সুস্থ রাখতে সচেষ্ট থাকে তাকে ফ্যাগোসাইটোসিস বলে।

ফ্যাগোসাইটোসিসের ধাপসমূহ (Steps of Phagocytosis)

১। ম্যাক্রোসাইটের সক্রিয় হওয়া (Activation of macrpcytes): জীবাণু সংক্রমণের ফলে প্রদাহস্থলে ক্ষতিগ্রস্ত রক্তকণিকা, টিস্যু বা রক্তজমাট থেকে উৎপন্ন কাইনিন, হিস্টামিন, প্রোস্টাগ্লান্ডিনস ইত্যাদি রাসায়নিকে উদ্দীপ্ত হয়ে ম্যাক্রোসাইটগুলো (ম্যাক্রোফেজ/নিউট্রোফিল) কৈশিকনালির প্রাচীর ভেদ করে ক্ষতস্থানে অভিযাত্রী হয়। ম্যাক্রোসাইটগুলো যখন সংক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন রাসায়নিক ক্ষরণে উদ্দীপ্ত হয়ে ক্ষতস্থানে জড়ো হতে থাকে সে প্রক্রিয়াকে বলে কেমোট্যাক্সিস (chemotaxis)।

২. অণুজীব ভক্ষণ (Ingestion): সক্রিয় হওয়ার পর ক্রমশঃ অণুজীবের দেহতলের সংস্পর্শে এলে ফ্যাগোসাইটে (ম্যাক্রোফেজ ও নিউট্রোফিল) দ্রুত যে ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে তার ফলে ফ্যাগোসাঁইট ক্ষণপদ সৃষ্টি করে অণুজীব ভক্ষণে উদ্যত হয় এবং মাত্র ০.০১ সেকেন্ডে একটি ব্যাকটেরিয়াম ভক্ষণ সম্পন্ন করতে পারে।

৩. ফ্যাগোজোম সৃষ্টি (Formation of phagosome): অণুজীব ভক্ষণের উদ্দেশে ফ্যাগোসাইট ক্ষণপদ বের করে ব্যাকটেরিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে এবং ক্ষণপদের মাঝে সৃষ্ট গহ্বরে আবদ্ধ করে। দুদিক থেকে আসা ক্ষণপদের অগ্রভাগ আরো এগিয়ে পরস্পর একীভূত হয়। এভাবে সৃষ্ট ঝিল্লিবেষ্টিত থলিকাটি ফ্যাগোজোম নামে পরিচিত। ফ্যাগোসাইটের সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত অ্যাকটিন ও অন্যান্য সংকোচনশীল তন্তু ফ্যাগোজোমের চতুর্দিক ঘিরে রাখে । এসব তন্তুর সংকোচনে ফ্যাগোসাইটের ঝিল্লি থেকে ফ্যাগোজোম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে ঝিল্লিবেষ্টিত থলিকার মতো চালিত হয়।

৪. ফ্যাগোলাইসোজোম সৃষ্টি (Formation of phagolysosome): আবদ্ধ ব্যাকটেরিয়াসহ ফ্যাগোজোম সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে পরিযায়ী হয়। এ সময় সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত গোল, ঝিল্লিবেষ্টিত ও হাইড্রোলাইটিক এনজাইমপূর্ণ দুএকটি লাইসোজোম নামক কোষ অঙ্গাণু ও অন্যান্য সাইটোপ্লাজমিক দানা ফ্যাগোজোমের ঝিল্লির সঙ্গে একীভূত হয়। একীভূত লাইসোজোম থেকে ব্যাকটেরিয়ানাশক (bactericidal agents) ও পরিপাক এনজাইম (digestive enzyme) ফ্যাগোজোমে ক্ষরিত হয়। ফ্যাগোজোমটি তখন ঝিল্পিবেষ্টিত একটি পরিপাক থলিকা (digestive vesicle)-য় পরিণত হয়। থলিকাটিকে ফ্যাগোলাইসোজোম বলে।

Immunity

Immunity

৫. ব্যাকটেরিয়ার অন্তঃকোষীয় মারণ ও গাচন (Intracellular killing and digestion of bacteria): ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস ও পরিপাকের জন্য লাইসোজোম ফ্যাগোজোমের সঙ্গে একীভূত হয়ে দুধরনের রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে। গ্রাসের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যাকটেরিয়ার চলন, রেচন জননসহ যাবতীয় কার্যকলাপ রূদ্ধ হয়ে যায়।

৬. অপাচ্য অংশসহ ব্যাকটেরিয়ার অবশেষ (Residual body containing indigestible materials): ফ্যাগোজোম ঝিল্লিবেষ্টিত পরিপাক গহ্বর হওয়ায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস বা হজমের কোনো পর্যায়ে ক্ষতিকর কোনো অংশ ফ্যাগোলাইসোজোমের সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করতে পারে না। তবে উপযুক্ত পুষ্টি পদার্থ উৎপন্ন হলে তা ফ্যাগোজোমের সাইটোপ্লাজমে শোষিত হয়।

৭. বর্জ্যপদার্থ নিষ্কাশন (Discharge of waste materials): বেশি সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া গ্রাস করায় এবং তা পরিপাকের পর বর্জিত বিষাক্ত পদার্থ সঞ্চয় বা লাইসোজোমের ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক পদার্থ সঠিকভাবে ফ্যাগোজোমে পতিত না হয়ে ফ্যাগোসাইটের সাইটোপ্লাজমে মুক্ত হওয়ায় প্রতিটি নিউট্রোফিলই মৃত্যুবরণ করে। অন্যদিকে, ম্যাক্রোফেজ উৎপন্ন বিষাক্ত ও অপাচ্য অংশ ত্যাগ করে নতুন ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে তৎপর হয়।

সহজাত ও অর্জিত অনাক্রম্যতা (তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর)

(The Innate & Acquired immunity)

মানবদেহকে রোগাক্রান্ত করতে সর্বশেষ যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় জীবাণুকে পরাস্ত করতে হয় সেটি হচ্ছে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর। এ স্তরটি দুধরনের, যেমন- সহজাত প্রতিরক্ষা (Innate or Inborn Immunity) এবং অর্জিত প্রতিরক্ষা (Acquired Immunity)।

 

সহজাত প্রতিরক্ষা (Innate Immunity)

মানবদেহে যে প্রতিরক্ষা বা অনাক্রম্যতা অমরার মাধ্যমে প্রাপ্ত ও জন্মের সময় থেকে আজীবন উপস্থিত থাকে এবং প্রতিরক্ষায় দ্রুত কার্যকর হয় তাকে সহজাত প্রতিরক্ষা বলে।

এটি নিচে বর্ণিত ধরনের হতে পারে, যেমন—

১. প্রজাতিগত প্রতিরক্ষা (Species immunity): অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরজীবীর আক্রমণ বিশেষ প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন, ম্যালেরিয়ার পরজীবী (Plasmodium vivax) মানুষ ও মশকীর উপর পরজীবী।

২. গোষ্ঠীগত প্রতিরক্ষা (Racial immunity): কোন বিশেষ পরজীবী দ্বারা মানুষের কোন কোন গোষ্ঠী আক্রান্ত হয়। অপর গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ পরজীবীটির আক্রমণ সহজেই প্রতিরোধ করে। যেমন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ শ্বেতাঙ্গ মানুষের চেয়ে বেশি যক্ষ্মার শিকার হতে দেখা যায়।

৩. ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা (Individual immunity): কোন কোন মানুষ নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য পরজীবীর সংক্রমণ প্রতিহত করতে পারে।

 

সহজাত প্রতিরক্ষা নিম্নোক্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে

১. প্রতিবন্ধক (Barriers): প্রতিবন্ধক টিস্যুগুলো হচ্ছে ত্বক, পৌষ্টিকনালি, শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে জনননালির প্রাচীর প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।

২. প্রদাহ (Inflammation): টিস্যুর কোনো ক্ষতি হলে মাস্টকোষের তৎপরতায় নানা ধরনের কণিকা বিশেষ করে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ জড়ো হয়ে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে ফলে যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার অবসান ঘটে।

৩. কমপ্লিমেন্ট (Complement): অন্ততঃ ২০ ধরনের প্লাজমা প্রোটিনে গঠিত এমন একটি  আন্তঃসম্পর্কিত গ্রুপ যা নিষ্ক্রিয়ভাবে রক্তে সংবহিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে সাহায্য করে তাকে কমপ্লিমেন্ট বলে। সক্রিয় হলে অণুজীবের কোষঝিল্লিতে আটকে থেকে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজকে কোষভক্ষণে সহযোগিতা করে, কিংবা কোষধ্বংসে অংশ গ্রহণ করে।

৪. ইন্টারফেরন (Interferon): ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং কোষের অভ্যন্তরে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটাতে আক্রান্ত কোষ থেকে ইন্টারফেরন নামক বিশেষ ধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন উৎপন্ন ও ক্ষরিত হয়ে দেহকোষকে রক্ষা করে।

৫. সহজাত মারণকোষ (Natural killer cells): এগুলো লিম্ফোসাইট জাতীয় বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা যা টিউমার কোষ ও ভাইরাসে আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করে।

৬. সহজীবী ব্যাকটেরিয়া (Symbiotic bacteria): পরিপাকতন্ত্র, ত্বক ও নারীদের জননতন্ত্রে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া স্থায়ীভাবে বাস করে। এগুলো ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী ব্যাকটেরিয়া (যেমন কোলনে বাসকারী ব্যাকটেরিয়া ভিটামিন B ও K সংশ্লেষ করে)। কিছু অণুজীব রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে অনুপ্রবিষ্ট জীবাণুর বৃদ্ধি রহিত করে দেয়।

অর্জিত প্রতিরক্ষা (Acquired Immunity)

মানবদেহে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জন্মসময় থেকে নয়, বরং জন্মের পর কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে সাড়া দেওয়ায় কিংবা ভ্যাক্সিন প্রয়োগের ফলে সৃষ্টি হয় তাকে অর্জিত প্রতিরক্ষা বলে। অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুরকম:

(ক) সক্রিয় প্রতিরক্ষা এবং

(খ) অক্রিয় প্রতিরক্ষা।

ক. সক্রিয় প্রতিরক্ষা (Active immunity): এটি এমন ধরনের অর্জিত প্রতিরক্ষা যাতে দেহের কোষ অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। এটি দুধরনের— প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম।

  1. প্রাকৃতিক সক্রিয় প্রতিরক্ষা (Natural Active Immunity): এ ধরনের প্রতিরক্ষায় অনিচ্ছাকৃত জীবাণুর সংস্পর্শে আসায় সংক্রমণ ঘটে এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরক্ষা গড়ে উঠে। যেমন: হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সংক্রমণ। এ ধরনের প্রতিরক্ষা দীর্ঘদিন থাকে, কখনওবা আজীবন থাকে।
  2. কৃত্রিম সক্রিয় প্রতিরক্ষা (Artificial Active Immunity): এ ধরনের প্রতিরক্ষায় ভ্যাক্সিনেশনের পর জীবাণুর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরক্ষা গড়ে উঠে। যেমন DPT ভ্যাক্সিন ডিপথেরিয়া, টিটেনাস (ধনুস্টংকার) ও পারটাসিস (হুপিংকাশি)-এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে।

খ. অক্রিয় প্রতিরক্ষা (Passive immunity): এটি এমন ধরনের অর্জিত প্রতিরক্ষা যাতে অ্যান্টিবডি এক ব্যক্তির দেহ থেকে অন্যের দেহে বা প্রাণিদেহ থেকে মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়। এটি নিচে বর্ণিত দুধরনের।

  1. প্রাকৃতিক অক্রিয় প্রতিরক্ষা (Natural Passive Immunity): এ ধরনের প্রতিরক্ষায় অমরা বা কলোস্ট্রাম (শাল দুধ) এর মাধ্যমে অ্যান্টিবডি মায়ের শরীর থেকে শিশুদেহে প্রবেশ করে। এভাবে স্থানান্তরিত অ্যান্টিবডি কয়েক সপ্তাহমাত্র টিকে থাকে। এ সময়ের মধ্যে শিশুদেহে নিজের অ্যান্টিবডি উৎপন্নের জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষাতন্ত্র গড়ে উঠে।
  2. কৃত্রিম অক্রিয় প্রতিরক্ষা (Artificial Passive Immunity): এ ধরনের প্রতিরক্ষায় ইনজেকশনের মাধ্যমে দেহে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করানো হয়। যেমন- রোগ ভোগের পর সেরে ওঠা ব্যক্তির সিরাম আক্রান্ত অন্য ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করিয়ে চিকিৎসা করানো। কোথাও একটি নতুন বা অত্যস্ত ক্ষতিকর রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে এবং সে মুহূর্তে সঠিক চিকিৎসার অভাবে এমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

অর্জিত প্রতিরক্ষার ধাপসমূহ (Steps of Acquired Immunity)

১. ভীতি (Threat): যখন MHC (Major Histocompatibility Complex) পরিচয়বিহীন একটি অণু বা অণুজীব (অ্যান্টিজেন) প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর অতিক্রম করে দেহে প্রবেশ করে তখন থেকেই অর্জিত প্রতিরক্ষার সূত্রপাত ঘটে।

২. সন্ধান (Detection): ম্যাক্রোফেজ জাতীয় ফ্যাগোসাইটিক কোষ সারাদেহে সংবহিত হয় এবং চলার পথে বহিরাগত পদার্থ বা অণুজীব পেলে গ্রাস করে। ম্যাক্রোফেজের অভ্যন্তরে ভক্ষিত পদার্থ পরিপাকের পর অতিক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়।

৩. সতর্ক (Alert): দেহে একটি অ্যান্টিজেন রয়েছে তা বোঝানোর জন্যে পরিপাককৃত বহিরাগত পদার্থের কিছু কণা ম্যাক্রোফেজের কোষঝিল্লিতে MHC স্বচিহ্নিতকারী অংশে বাহিত হয়। ফলে ইমিউনতন্ত্রের প্রধান কোষ হেলপার T-কোষ সতর্ক হয়ে যায়। এভাবে ম্যাক্রোফেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিজেন-উপস্থাপক কোষ (antigen-presenting cell, সংক্ষেপে APC) হিসেবে কাজ করে। লসিকা গ্রন্থির B-কোষ ও ডেড্রাইটিক কোষ নামক আরও দুধরনের কোষ APC হিসেবে কাজ করে। ম্যাক্রোফেজ সঠিক ধরণের রিসেপ্টরযুক্ত হেলপার T-কোষের কাছে অ্যান্টিজেনকে উপস্থাপন করে। T-কোষ সমগ্র অর্জিত প্রতিরক্ষা সাড়ার মেইন সুইচের মতো কাজ করে এবং সঠিক হেলপার T-কোষ না পাওয়া পর্যন্ত অ্যান্টিজেন নিয়ে পরিভ্রমণ করে। সঠিক T-কোষ পেলে ম্যাক্রোফেজ তার সাঙ্গে যুক্ত হয়ে রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে, ফলে T-কোষ উদ্দীপ্ত হয়।

৪. বিপদ সংকেত (Alarm): কয়েক ঘন্টার মধ্যে সক্রিয় হেলপার T-কোষ তার নিজস্ব রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে। সেই ক্ষরণে উদ্দীপ্ত সঠিক B-কোষ ও সাইটোটক্সিক T-কোষ নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনকে আটকাতে এগিয়ে আসে।

Immunity

Immunity

৫. নির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা নির্মাণ (Building Specific Defense): উদ্দীপ্ত সঠিক B-কোষ ও T–কোষগুলো সক্রিয় হয়ে দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে শুরু করে, ফলে জিনগত সদৃশ কোষগুচ্ছ গড়ে ওঠে। এর নাম ক্লোন (clone)। ক্লোনে দুধরনের কোষ সৃষ্টি হয়। এক ধরনের কোষ নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় হয়ে দেহরক্ষায় কাজ করে। এগুলোকে কার্যকর কোষ (effector cells) বলে। আরেক ধরনের কোষ নির্দিষ্ট ঐ অ্যান্টিজেনের স্মৃতি বহন করে ভবিষ্যতে ঐ অ্যান্টিজেন দেহে প্রবেশ করলে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এসব কোষের নাম স্মৃতি কোষ (memory cells)। যে প্রক্রিয়ার এমন বিশেষায়িত ক্লোনের সৃষ্টি হয় তাকে ক্লোনাল সিলেকসন (clonal selection) বলে।

৬. প্রতিরক্ষা (Defense): অর্জিত প্রতিরক্ষায় দুধরনের প্রতিরক্ষা সাড়া (immune response)-র মাধ্যমে মানবদেহে প্রতিরক্ষা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ও বজায় থাকে।

  • অ্যান্টিবডি-নির্ভর সাড়া (Antibody Mediated Response): এ ধরনের সাড়ায় B-কোষ বিভাজিত হয়ে যে কার্যকর (effector) কোষ উৎপন্ন হয় সেগুলোকে প্লাজমা কোষ (plasma cell) বলে। প্লাজমা কোষ রক্তস্রোতে মুক্ত নির্দিষ্ট গড়নের অ্যান্টিজেনের বিপক্ষে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি ক্ষরণ করে।
  • কোষ-নির্ভর সাড়া (Cell- Mediated Response): সাইটোটক্সিক T-কোষ হচ্ছে কোষ নির্ভর সাড়া দানে কার্যকর T-কোষ। এসব কোষ অ্যান্টিজেনবাহী কোষগুলোকে ধ্বংস করে। যখন ২টি ঘটনা যুগপৎ সংঘটিত হয় তখন সাইটোটক্সিক T-কোষ টার্গেট কোষ ধ্বংসে সক্রিয় হয়: (ক) সাইটোটক্সিক T-কোষ যখন অ্যান্টিজেন উপস্থাপনকারী কোষের (APC, যেমন-ম্যাক্রোফেজের) সম্মুখীন হয় এবং (U) যখন একটি হেলপার T-কোষ সাইটোটক্সিক T-কোষকে সক্রিয় করতে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে। সাইটোটক্সিক T–কোষ সক্রিয় হলে বিভাজিত হয় এবং স্মৃতিকোষ ও কার্যকর সাইটোটক্সিক T- কোষ উৎপন্ন হয়।

৭. অতন্দ্র প্রহরা (Continuous surveillance): একটি অ্যান্টিজেন যখন প্রথমে দেহে প্রবেশ করে তখন কয়েকটিমাত্র লিম্ফোসাইট সেটাকে শনাক্ত করতে পারে। সেই লিম্ফোসাইটগুলো খুঁজে বের করে বিভাজনে উদ্দীপ্ত করে অগণিত লিম্ফোসাইট উৎপন্ন করতে হয়। এ কারণে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে মুখ্য সাড়া (primary response) ধীরে সংঘটিত হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অ্যান্টিজেন দেহে প্রবেশের ১ বা ২ সপ্তাহ পর চরম মাত্রায় পৌঁছায়। দেহে যদি আবারও (অনেক বছর পর বা কয়েক যুগ পর হলেও) একই অ্যান্টিজেনের অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে সাড়াদান ঘটে দ্রুত ও শক্তিশালী। এটি গৌণ সাড়া (secondary response) নামে পরিচিত। মুখ্য সাড়ায় B-কোষ ও T-কোষগুলো উদ্দীপ্ত ও বিভাজিত হয়ে কেবল অ্যান্টিজেন বিরোধী কার্যকর কোষ (effector cells) সৃষ্টি করে না, বরং স্মৃতি কোষ (memory cells) ও উৎপন্ন করে। স্মৃতি কোষ অনেক বছর, এমন কি কয়েক যুগ পর্যস্ত জীবিত থাকতে পারে।

সহজাত প্রতিরক্ষা ও অর্জিত প্রতিরক্ষার মধ্যে পার্থক্য

(Difference between the Innate Immunity & Acquired Immunity)

তুলনীয় বিষয় সহজাত প্রতিরক্ষা অর্জিত প্রতিরক্ষা
১. স্থায়িত্ব আজীবন স্বল্প বা দীর্ঘস্থায়ী।
২. উপস্থিতি সবসময় উপস্থিত উপস্থিতি পরিবেশের উপর নির্ভরশীল
৩. পূর্ব অভিজ্ঞতা পূর্বে আক্রান্তের প্রয়োজন হয় না পূর্বে আক্রান্তের প্রয়োজন হয়
8. সাড়াদান কাল তাৎক্ষণিক প্রথমবার ৫-৬ দিন থেকে ১-২ সপ্তাহ পরে দ্রুত সাড়া
৫. স্মৃতিকোষ সৃষ্টি হয় না B-লিম্ফোসাইট ও T-লিম্ফোসাইট থেকে সৃষ্টি হয়
৬. অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না সৃষ্টি হয়
৭. প্রতিবন্ধক তাপমাত্রা, , ত্বক ও মিউকাস ঝিল্লি হচ্ছে প্রতিবন্ধক লসিকা পর্ব, প্লীহা ও লিম্ফয়েড টিস্যু হচ্ছে প্রতিবন্ধক
৮. উপাদান ভৌত ও রাসায়নিক প্রতিবন্ধক, মারণ কোষ, প্লাজমাপ্রোটিন, ফ্যাগোসাইট, ড্রেন্ড্রাইট কোষ। B-কোষ ও T-কোষ

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অ্যান্টিবডির ভূমিকা

(Role of Antibody in Immune System)

দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র (immune system) থেকে উৎপন্ন এক ধরনের দ্রবণীয় গ্লাইকোপ্রোটিন যা রোগ-ব্যাধি সৃষ্টিকারী নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনকে (যেমন- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া) ধ্বংস করে তাকে অ্যান্টিবডি বলে। প্রত্যেকটি অ্যান্টিবডি হচ্ছে ইমিউনোগ্লোবিউলিন (সংক্ষেপে Ig) নামে বিশেষ ধরনের একেকটি প্রোটিন অণু।

প্লাজমা কোষ থেকে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়। মানুষের দেহে প্রায় ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) ধরনের অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হতে পারে।

অ্যান্টিবডির গঠন (Structure of Antibody)

প্রত্যেক অ্যান্টিবডির মৌলিক গঠন এক গাঠনিক অংশগুলো নিম্নরূপ:

১. ভারী ও হালকা শৃঙ্খল (Heavy and light chains): প্রত্যেক অ্যান্টিবডিতে দুজোড়া পলিপেপটাইড শৃঙ্খল থাকে। এর মধ্যে সদৃশ একজোড়া লম্বা ও ভারী শৃঙ্খল এবং অন্য জোড়া সদৃশ হালকা শৃঙ্খল। ভারী ও হালকা শৃঙ্খলের আণবিক ওজন হচ্ছে যথাক্রমে ৫০-৭০ kD ও ২৩ kD (kiloDaltons)।

২. ডাইসালফাইড বন্ড (Disulfide bonds): প্রত্যেক অ্যান্টিবডিতে অন্তত ৩টি আন্তঃশৃঙ্খল ডাইসালফাইড বন্ড রয়েছে। একটি বড় থাকে দুই-ভারী শৃঙ্খলের মাঝে, বাকি দুটি থাকে দুপাশে ভারী ও হালকা শৃঙ্খলের মাঝে। অ্যান্টিবডির গড়ন দেখতে Y আকৃতির মতো। আন্তঃশৃঙ্খল ডাইসালফাইড বন্ডের সংখ্যা বিভিন্ন অ্যান্টিবডিতে বিভিন্ন হতে পারে। প্রত্যেকটি পলিপেপটাইড শৃঙ্খল আবার অন্তঃস্থভাবে অন্তশৃঙ্খল (intra-chain) ডাইসালফাইড বন্ডে যুক্ত থাকে।

৩. স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল অঞ্চল (Constant and variable regions): প্রত্যেক অ্যান্টিবডি দুই অঞ্চলবিশিষ্ট গঠনে নির্মিত একটি স্থায়ী অঞ্চল, অন্যটি পরিবর্তনশীল অঞ্চল। ধরন অনুযায়ী প্রত্যেক অ্যান্টিবডির ভারী ও হালকা শৃঙ্খলে অ্যামিনো এসিড ক্রম (sequence) অনুযায়ী ওই দুটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ধরনের মিউনোগ্লোবিনের (যেমন-IgG-তে কিংবা IgA-তে) স্থায়ী অঞ্চলে অ্যামিনো এসিড ক্রম একই থাকে। কিন্তু পরিবর্তনশীল অংশকে অ্যান্টিজেন (জীবাণু) ধরার জন্য আকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে খাপ খাওয়াতে হয় বলে ক্রমের পরিবর্তন হতে পারে। পরিবর্তনশীল অঞ্চল নির্মাণে ভারী ও হালকা উভয় শৃঙ্খলই অংশ গ্রহণ করে। অ্যান্টিজেন ধরার এ অংশটির নাম প্যারাটপ (paratope)। এটি তালা-চাবি (lock and key) পদ্ধতিতে কাজ করে। এক্ষেত্রে ‘চাবি’ হচ্ছে প্যারাটপ, আর ‘তালা’ অ্যান্টিজেন (জীবাণু)।

ভারী শৃঙ্খলের স্থায়ী অঞ্চলে অ্যামিনো এসিডের ক্রম-এর ভিত্তিতে অ্যান্টিবডি মাত্র ৫ ধরনের হলেও পরিবর্তনশীল অঞ্চলের (ভারী ও হালকা শৃঙ্খলের) প্যারাটপে যখন জরুরী অবস্থায় বিশেষ বিশেষ জিনখন্ডের (subgene) এলোপাথাড়ি (random) সম্মিলনের ফলে পরিবর্তন ঘটে তখন কোটি কোটি ভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবডির সৃষ্টি হয়। [এ প্রক্রিয়ার নাম VDJ রিকম্বিনেশন। V=Variable, D = diversity, J = Joining subgene] বিজ্ঞানীদের ধারণা মানুষের দেহে প্রায় ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) ধরনের অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হতে পারে। আমাদের জীবদ্দশায় ১০ কোটি অ্যান্টিজেন দেহে প্রবেশ করবে বা করতে পারে তা অকল্পনীয়।

Immunity

Immunity

৪. কব্জা অঞ্চল (Hinge region): অ্যান্টিবডি অণুর বাহুদুটি যে সংযোগস্থল থেকে দুভাগ হয়ে যায় তা কব্জা অঞ্চল। অংশটি অ্যান্টিবডিকে কিছুটা নমনীয়তা দান করে। বাহুদুটির দুপ্রান্তে অবস্থিত একটি করে মোট দুটি প্যারাটপে দুটি অ্যান্টিজেনকে আটক করা যায়।

অ্যান্টিবডির প্রকারভেদ (Types of Antibody)

অ্যান্টিবডির গড়নে যে ভারী শৃঙ্খল রয়েছে তাতে অ্যামিনো এসিডের ক্রমের (sequence) ভিত্তিতে ভারী শৃঙ্খল ৫ ধরনের: -(gamma), -(alpha), -(mu), -(epsilon) এবং δ-(delta)।

১. ইমিউনোগ্লোবিউলিন G (IgG): দেহের মোট ইমিউনোগ্লোবিউলিনের (Ig) 75% IgG। রক্ত, লসিকা, অস্ত্র ও টিস্যু তরলে এ Ig বিস্তৃত থাকে। কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমিক সক্রিয় করে এবং অনেক বিষাক্ত পদার্থকে প্রশমিত করে। IgG ই একমাত্র অ্যান্টিবডি যা গর্ভাবস্থায় অমরা অতিক্রম করে মায়ের অর্জিত পরিমাকে ভ্রুণদেহে বাহিত করে।

২. ইমিউনোগ্লোবিউলিন A (IgA): দেহের মোট Ig-র মধ্যে ১৫% হচ্ছে IgA। এ ধরনের অ্যান্টিবডি মিউকাস ঝিল্লিতে আবৃত থাকে, যেমন-পরিপাক, জনন ও শ্বসনতন্ত্রে বিস্তৃত হয় এবং সেখানে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব ও অণুকণাকে প্রশমিত করে। মায়ের দুধেও IgA পাওয়া যায় এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুদেহে স্থানান্তরিত হয়।

৩. ইমিউনোগ্লোবিউলিন M (IgM): দেহের মোট Ig-এর ৫-১০% IgM। ABO ব্লাড গ্রুপের রক্তকণিকার অ্যান্টিবডি এ ধরনের IgM পাওয়া যায় রক্ত ও লসিকায়। এটি কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমকে সক্রিয় করে এবং বহিরাগত কোষকে পরস্পরের সঙ্গে আসঞ্জিত করে দেয়। অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া ও কিছু ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্পেসিফিক ইমিউন সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে IgG ও IgM একত্রে কাজ করে।

৪. ইমিউনোগ্লোবিউলিন D (IgD): দেহের মোট Ig-র মধ্যে ১%-এরও কম হচ্ছে IgD। রক্ত, লসিকা ও লিম্ফোসাইট B-কোষে এ Ig পাওয়া যায়। এর কাজ অজ্ঞাত হলেও বিজ্ঞানিদের ধারণা, IgD B– কোষকে সক্রিয়করণে ভূমিকা পালন করে।

৫. ইমিউনোগ্লোবিউলিন E (IgE): দেহের মোট Ig-র মধ্যে প্রায় ০.১% হচ্ছে lgE। এটি দুর্লভ Ig। B–কোষ, মাস্টকোষ ও বেসোফিলে এ Ig পাওয়া যায়। হিস্টামিন ক্ষরণকে উদীপ্ত করে এটি প্রদাহ সাড়া (inflammatory response) সক্রিয় করে। বিভিন্ন অ্যালার্জিক সাড়া দানে (যেমন-সন্ধিবাতে) এ অ্যান্টিবডির ভূমিকা বেশ নেতিবাচক প্রমাণিত হয়েছে।

Immunity

Immunity

অ্যান্টিবডির কার্যপদ্ধতি (Functional System of Antibody)

অ্যান্টিবডির কাজের পদ্ধতিকে ৩টি প্রধান শিরোনামভুক্ত করা যায়:

১. অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ,

২. কমপ্লিমেন্ট প্রোটিন সক্রিয়করণ এবং

৩. সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধ।

১. অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ (Direct attack against antigen):

  • স্তূপীকরণ বা অ্যাগ্লুটিনেশন (Agglutination): যে প্রক্রিয়ায় রক্ত বা লসিকায় সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে রোগ সৃষ্টিকারী বহিরাগত অণুজীব বা অণুকণা দলা পাকিয়ে নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে তাকে স্তূপীকরণ বলে। প্রত্যেক অ্যান্টিবডিতে দুটি করে অ্যান্টিজেন-বাঁধনস্থল থাকে, অতএব একটি অ্যান্টিবডি দুটি অ্যান্টিজেনকে আটকাতে পারে। এভাবে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেনের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দলা পাকিয়ে নিশ্চল বড় স্তূপের মতো পড়ে থাকে। ফলে খুব সহজেই ম্যাক্রোফেজ ও নিউট্রোফিল নামক শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় তা গ্রাস করে।
  • অধঃক্ষেপন (Precipitation): যে প্রক্রিয়ায় দ্রবণীয় অ্যান্টিজেনের (যেমন- টিটেনাস টক্সিন) আণবিক যৌগ প্রিসিপিটিন (precipitin) অ্যান্টিবডির সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে বড় জালিকাকার ও অদ্রবণীয় বস্তু হিসেবে অধঃক্ষিপ্ত হয় তাকে অধঃক্ষেপণ বলে। অধঃক্ষিপ্ত অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি দলাকে খুব সহজে ফ্যাগোসাইটিক কোষ গ্রাস করে দেহকে রোগমুক্ত রাখে।
  • প্রশমন (Neutralization): যে প্রক্রিয়ায় একটি অ্যান্টিবডি কোনো অ্যান্টিজেনের ক্ষতিকারক অংশগুলোকে ঢেকে রেখে ক্ষতিকর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বাধা দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দেয় কিংবা অ্যান্টিজেন-ক্ষরিত টক্সিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে তার বিষক্রিয়া থেকে অন্যান্য দেহকোষকে রক্ষা করে তাকে প্রশমন বলে।
  • বিশ্লিষ্টকরণ (Lysis): কিছু শক্তিশালী অ্যান্টিবডি যে প্রক্রিয়ায় সরাসরি বহিরাগত অণুজীবের ঝিল্লি আক্রমণ ও বিদীর্ণ করার মধ্য দিয়ে অণুজীবের দেহকে ফাটিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তাকে বিশ্লিষ্টকরণ বলে।

২. কমপ্লিমেন্ট প্রোটিন সক্রিয়করণ (Complementary protein activation):

অন্তত ২০ ধরনের প্লাজমা প্রোটিনে গঠিত এমন একটি আন্তঃসম্পর্কিত গ্রুপ যা নিষ্ক্রিয়ভাবে রক্তে সংবহিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে সাহায্য করে তাকে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম বা কমপ্লিমেন্ট বলে। অ্যান্টিবডির কাজের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। কমপ্লিমেন্ট প্রোটিন সক্রিয়করণের মাধ্যমে নিম্নোক্ত বিভিন্ন উপায়ে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় থাকে।

  • অপসোনাইজেশন (Opsonization): দেহে অনুপ্রবিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার গায়ে অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি কমপ্লেক্স যুক্ত হলে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রোটিন নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজকে প্রচন্ডভাবে ফ্যাগোসাইটোসিসে উদ্বুদ্ধ করে তুলে। এ প্রক্রিয়াকে অপসোনাইজেশন বলে। এভাবে কম সময়ে শতগুণ বেশি সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া গ্রাসে ফ্যাগোসাইটগুলো ভূমিকা পালন করে।
  • বিশ্লিষ্টকরণ (Lysis): কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনেক ধরনের কমপ্লিমেন্টে গঠিত লাইটিক কমপ্লেক্স (lytic complex) নামে একটি বিশেষ গ্রুপ। এ গ্রুপভুক্ত কমপ্লিমেন্ট বহিরাগত ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য অণুজীবের কোষঝিল্লি বিদারণের মাধ্যমে অণুজীব ধ্বংসে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে।
  • স্তূপীকরণ (Agglutination): কমপ্লিমেন্ট থেকে উৎপন্ন পদার্থের বিক্রিয়ায় বহিরাগত অণুজীবের ঝিল্লি এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যার ফলে অণুজীবগুলো পরস্পর সংলগ্ন হয়ে নিষ্ক্রিয় নিশ্চল স্তুপের মতো পড়ে থাকে।
  • ভাইরাসের প্রশমন (Neutralization of Viruses): কমপ্লিমেন্ট থেকে ক্ষরিত এনজাইম ও অন্যান্য পদার্থ ভাইরাসের গঠনকে আক্রমণ করে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
  • কেমোট্যাক্সিস (Chemotaxis): অণুজীবের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত রক্তকণিকা, টিস্যু, রক্তজমাট ও ব্যাকটেরিয়ার নানা রাসায়নিক ক্ষরণে উদ্দীপ্ত হয়ে ফ্যাগোসাইটগুলো সেখানে (ক্ষতস্থানে) ধাবিত হয়। এভাবে রাসায়নিক সংবেদের প্রতি সাড়া দেয়াকে কেমোট্যাক্সিস বলে। কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের কিছু প্রোটিন ফ্যাগোসাইটকে কেমোট্যাক্সিসের প্রতি সাড়া দিতে আকৃষ্ট করায় গন্তব্যে পৌঁছে ফ্যাগোসাইট কমপ্লিমেন্টের সহযোগিতায় অনুপ্রবেশকারী ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করতে পারে।
  • মাস্টকোষ ও বেসোফিলের সক্রিয়করণ (Activation of Mast-cells and Basophils): কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের কিছু প্রোটিন মাস্টকোষ ও বেসোফিলকে আশপাশের তরলে হিস্টামিন, হেপারিন ও অন্যান্য পদার্থ ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে। ফলে স্থানীয় রক্তপ্রবাহ, টিস্যুতে তরল পদার্থ ও প্লাজমা প্রোটিনের প্রবেশ এবং স্থানীয় টিস্যুর বিক্রিয়া বেড়ে যায়। এসব কারণে সৃষ্ট প্রদাহ সাড়ায় জীবাণু নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

৩. সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধ (Preventing the spread of infection):

কিছু অ্যান্টিবডি, বিশেষ করে IgE প্রদাহ সাড়ার বিষয়টি ত্বরান্বিত করে। যে কোনো ক্ষতস্থানে প্রদাহের যে ৪টি মৌলিক ও ধারাবাহিক বাহ্যিক লক্ষণ প্রকাশিত হয় তা হচ্ছে:

  • ক্ষতস্থানটি লাল হয়ে যায়
  • জায়গাটি গরম হয়;
  • ফুলে যায় এবং
  • সবশেষে ব্যথার প্রকাশ ঘটায়।

প্রদাহের কারণে ক্ষতস্থানে এমনভাবে পরিবর্তন ঘটে যার ফলে বহিরাগত জীবাণু আর ছড়াতে পারে না। এভাবে মাস্টকোষ ও বেসোফিলের ক্ষরণে প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে সংক্রমণের বিস্তার রুদ্ধ করে দেয়।