10 Minute School
Log in

ছত্রাকের গুরুত্ব (The Importance of Fungi)

ছত্রাকের বিভিন্ন ব্যবহার

  1. খাদ্য হিসেবে ছত্রাক (Fungi as food): মাশরুম (mushrooms-Agaricus, Volvariella), মোরেল (morels-Morchella, ট্রাফল (truffles-Tuber) প্রভৃতি নামে পরিচিত বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে চাষ করা হয়। Agaricus bisporus এবং A. campestris প্রজাতির মাশরুম সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর পুষ্টিগুণও উচ্চমানের।
  2. ওষুধ তৈরিতে (In making medicine): পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন(Penicillium) chrysogenum গণের ছত্রাক থেকে তৈরি হয়। Claviceps purpurea ছত্রাক থেকে ergot তৈরি হয় যা ওষুধ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে সন্তান প্রসবের পর রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে। মৃত্তিকাবাসী ছত্রাক থেকে (Tolypocladium inflatum) সাইক্লোস্পোরিন (cyclosporine) ওষুধ তৈরি হয় যা মানুষের যে কোনো অঙ্গ ট্রান্সপ্লান্ট করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। Aspergillus ছত্রাক থেকে স্টেরয়েড পাওয়া যায়, এটি আরথ্রাইটিস নিরাময় করে।
  3. জৈব অ্যাসিড ও উৎসেচক তৈরিতে (In making organic acids and enzymes): বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক থেকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন জৈব অ্যাসিড ও উৎসেচক তৈরি করা হয়। যেমন- Saccharomyces cerevisiae ছত্রাক থেকে ভারটেজ নামক উৎসেচক পাওয়া যায়। ডায়াস্টেজ ও জৈব অ্যাসিড তৈরি করতে Aspergillus ছত্রাক ব্যবহার করা হয়।
  4. পরিবেশ সংরক্ষণে (In environmental protection): ছত্রাক পরিবেশ থেকে বিষাক্ত দৃষক পদার্থ বিশ্লিষ্ট (decompose) করে পরিবেশকে বিষাক্ত পদার্থ থেকে দূষণমুক্ত করে। এই প্রক্রিয়াকে বায়োরিমেডিয়েশন (bioremediation) বলে। বর্জ্য পদার্থ বিশ্লিষ্ট করে ছত্রাক পরিবেশে কার্বন ও অন্যান্য মৌল ফিরিয়ে দেয় যা পরবর্তীতে উদ্ভিদ পুনরায় ব্যবহার করতে পারে।
  5. হরমোন (Hormone): Gibberella fujikuroi নামক ছত্রাক থেকে জিবেরেলিন নামক উদ্ভিদের বৃদ্ধি হরমোন পাওয়া যায়। 
  6. মৌলিক গবেষণায় (In basic research): আণবিক জীববিজ্ঞানের উচ্চতর গবেষণার কাজে Saccharamyces cereviside এর AH 109, PJ 69-4 alpha, Y187 ইত্যাদি জাত ব্যবহার করা হয়।
  7. কৃষিতে ব্যবহার (Used in agriculture): ছত্রাকের বহুমুখী ব্যবহার কৃষিতে লক্ষ্য করা যায়। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও ছত্রাকের অবদান আছে। এক একর উর্বর জমির উপরের ৮ ইঞ্চি মাটিতে এক টন পরিমাণ ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। মৃত জীবদেহ ও জৈব বর্জ্য পচনের মাধ্যমে জৈব সার তৈরিতে ছত্রাকের যথেষ্ট ভূমিকা আছে।
  8. শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে (In the production of industrial goods): অত্যাবশ্যকীয় শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

  • Saccharomyces নামক ঈস্টের বিভিন্ন প্রজাতি ভিটামিন B ও C, গ্লিসারিন তৈরিতে, কোকোর বীজ থেকে চকোলেট সংগ্রহ করে সুগন্ধযুক্ত করাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
  • বেকারিতে পাউরুটি ও কেক তৈরিতে Saccharomyces ঈস্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। Penicilliam cdmembertP. rosqueferti ব্যবহার করে সুরভিত পনির প্রস্তুত করা হয়।
  • মদ তৈরিতে Saccharomyces cerevisiae ছত্রাক প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। এজন্য একে brewer yeast বলে।
  • খেজুর, তাল, আঙ্গুর ও আখের রস থেকে Saccharomyces ঈস্টের মাধ্যমে গাঁজন প্রক্রিয়ায় অ্যালকোহল প্রস্তুত করা হয়।
  • Penicillium এর বিভিন্ন প্রজাতি ব্যবহার করে বিভিন্ন জৈব অ্যাসিড; যেমন- সাইট্রিক অ্যাসিড, ফিউমারিক অসিড, অক্সালিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড ইত্যাদি উৎপান করা হয়।

ছত্রাকের অপকারী বা ক্ষতিকর প্রভাব (Harmful effects of fungi)

  1. খাদ্যদ্রব্য পচন ও বিষক্রিয়া সৃষ্টি (Food digestion and poisoning): কিছুসংখ্যক মৃতজীবী ছত্রাক আমাদের খাদ্যদ্রব্যে পচন ও বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। যেমন- Aspergillus, Penicillium প্রভৃতি ছত্রাক আচার, চাটনি, জ্যাম ও জেলি নষ্ট করে দেয় এবং ছত্রাকের আক্রমণে গুদামজাত শস্য নষ্ট হয়। Aspergilluus flavus মাইকোটক্সিন সৃষ্টি করে।
  2. কাগজ বিনষ্টকরণে (Destroying the paper): Penicilium, AlternariaFusarium জাতীয় ছত্রাক কাগজের উপর জন্মিয়ে কাগজ বিনষ্ট করে ফেলে।
  3. প্রাণীর রোগে সৃষ্টিতে (In the creation of animal diseases): Aspergillus, Mucor, Rhizopus, Cercospora প্রভৃতি ছত্রাক মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদেহে বিভিন্ন রোগে সৃষ্টি করে Microsporium ছত্রাকের আক্রমণে মানুষের মাথায় চুল পড়ে গিয়ে টাকের সৃষ্টি হয়।
  4. উদ্ভিদের রোগে সৃষ্টি (Caused by plant diseases): পরজীবী ছত্রাক আবাদি ফসলের মারাত্মক রোগে সৃষ্টি করে। ব্লাইট, ব্লাস্ট, মিলডিউ, রট প্রভৃতি উদ্ভিদ রোগের কারণ বিভিন্ন প্রজাতির পরজীবী ছত্রাক। ১৯৪২ সালে তৎকালীন বাংলায় মহাদুর্ভিক্ষ হয়েছিল ধানের ছত্রাকজনিত বাদামি দাগ রোগের কারণে। এই রোগে Helminthosprium oryzae নামক ছত্রাক দিয়ে সৃষ্টি হয়। আলুর বিলম্বিত ধ্বসা (লেট ব্লাইট) রোগের কারণে ১৮৪৩-১৮৪৭ সাল পর্যন্ত আলু ক্ষেতের ফলন প্রায় সম্পূর্ণটাই নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে আয়ারল্যান্ডে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ও দশ লক্ষ লোক মারা যায়। Phytophthora infestans নামক ছত্রাকের আক্রমণে আলুর বিলম্বিত ধ্বসা রোগে হয়। Puccinia graminis-tritici নামক ছত্রাক দ্বারা গম গাছে মরিচা রোগে হয়। পিটার দ্যা গ্রেট ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক দখল করতে যায়। অরগোট আক্রান্ত রাই খেয়ে পরদিন সকালে তার শতাধিক ঘোড়া পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং বহুলোক মারা যায়। পরিণামে অভিযান বন্ধ ঘোষিত হয়।
  5. চামড়া ও কাপড়ে চিতি : বর্ষাকালে চামড়া ও কাগজের উপর Aspergillus ছত্রাক জন্মায় এবং চামড়া ও কাপড়ের উপর চিতি তৈরি করায় চামড়া ও কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। 
  6. মানুষের রোগে সৃষ্টি (Caused by human disease): Trichophyton rubrum নামক ছত্রাকের আক্রমণে মানুষের দেহে দাদরোগ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ছত্রাকঘটিত রোগগুলোকে একত্রে মাইকোসিস্ট (Mycoses) এবং অ্যাস্পারজিলোসিস (Aspergelloses) বলা হয়। MucorRhizopus গণের কোনো কোনো প্রজাতি মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও খাদ্য নালিতে  জাইগোমাইকোসিস নামক রোগে সৃষ্টি করে। TrichodermaCandida গণের কোনো কোনো প্রজাতি পুরুষাঙ্গের রোগে সৃষ্টি করে। যক্ষ্মার মতো ফুসফুসের coccidiomycosis নামক রোগে হয় এক প্রকার স্যাক ফাংগাস দিয়ে। Absidia corymbifera নামক ছত্রাক মানুষের দেহে ব্রঙ্কোমাইকোসিস নামক রোগে সৃষ্টি করে। Candida albicans নামক ছত্রাক মুখ, নাক, গলা ইত্যাদি স্থানের মিউকাস ঝিল্লির ক্ষতিসাধন করে। এই রোগকে candidiasis বলে। ঐসব স্থানে অবস্থানরত ব্যাকটেরিয়া Candida-র আক্রমণ প্রতিহত করে রাখে। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের কারণে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে Candida-র আক্রমণ মারাত্মক হয়।
  7. গৃহপালিত পশু-পাখি ও মাছের রোগে (Diseases of domestic animals, birds and fish): Aspergillus funigatus ছত্রাক হাঁস-মুরগি ও পাখির গর্ভপাত ঘটায়। Microsporium canis নামক ছত্রাক কুকুর ও ঘোড়ার শরীরে দাদ জাতীয় চর্মরোগ সৃষ্টি করে।
  8. মাছের রোগে সৃষ্টি (Caused by fish diseases): Saprolegnia ছত্ৰাক কার্পজাতীয় মাছের বিশেষ রোগে সৃষ্টি করে উৎপাদন হ্রাস করে। 

অধিকৃত জায়গা (আয়তন) হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতি Armillaria ostoyae যা যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বনে আছে। এর দখলকৃত জায়গার পরিমাণ ১৬৬৫ টি ফুটবল খেলার মাঠের চেয়েও বেশি।

মাশরুম ছত্রাকের উপকারিতা (Benefits of mushroom fungus):

  • খাদ্য হিসেবে (As Food): মাশরুম বিভিন্ন ভিটামিন সমৃদ্ধ হওয়ায় পৃথিবীর বহুদেশে এটি সুপ্রিয় খাদ্য হিসেবে পরিচিত। এজন্য পৃথিবীর বহুদেশে এর চাষ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশেও এর ব্যাপক চাষ শুরু হয়েছে। এটি টাটকা ও সংরক্ষিত উভয় অবস্থায় বাজারে বিক্রি হয়। বাংলাদেশের বড় বড় হোটেলগুলোতে খাদ্য হিসেবে, বিশেষ করে স্যুপ তৈরিতে মাশরুম ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ সমাজেও মাশরুম ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। খাদ্য হিসেবে বাংলাদেশে (মানিকগঞ্জ ও সাভার) VolvariellaPleurotus গণভুক্ত কয়েকটি মাশরুম প্রজাতির চাষ হচ্ছে। পুষ্টিগত দিক থেকে Agaricus campestrisA. bisporus অত্যন্ত উঁচু মানের এবং সুস্বাদু। টাটকা মাশরুমে নানা ধরনের ভিটামিন পাওয়া যায়; যেমন- থায়ামিন, রিবোফ্লোবিন, Vit – C, D, K ও প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড। আমেরিকা ও ইউরোপে Agaricus brunnescens (= A. bisporus) মাশরুম প্রজাতির ব্যাপক চাষ হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৭৮০ মিলিয়ন পাউন্ড mushroom উৎপাদিত হয়। 
  • মৃত্তিকার পুষ্টি বৃদ্ধিতে (In increasing soil nutrition): মাশরুম (Agaricus) মৃতজীবী তাই বিভিন্ন ধরনের জটিল দ্রব্যকে ভেঙে মৃত্তিকার পুষ্টি বৃদ্ধি করে থাকে। 
  • শিল্প ও বাণিজ্যে (In industry and commerce): মাশরুম এর চাষ বেশ লাভজনক কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে।
  • দূষণরোধে (Pollution prevention): মাশরুম পরিবেশ থেকে শিল্পবর্জ্য, তেল, পেস্টিসাইড অপসারণে ব্যবহৃত হয়।
  • ওষুধি গুণাবলি (Medicinal properties):

  • এতে আঁশ বেশি থাকায় এবং শর্করা ও চর্বি কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীর জন্য একটি আদর্শ খাবার।
  • এতে শর্করা, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ (Ca, K, P, Fe ও Cu) এমন সমন্বয়ে আছে যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে। যার ফলে গর্ভবতী মা ও শিশুরা এটি নিয়মিত খেলে দেহের রোগে  প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।
  • এতে প্রচুর উৎসেচক (এনজাইম) আছে যা হজমে সহায়ক, খাবারে রুচি বাড়ে এবং পেটের পীড়া নিরাময় করে।

  • বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে (In earning foreign currency): বিশ্বের অনেক দেশে মাশরুম অত্যন্ত দামি খাবার। ব্যাপকভাবে মশরুম চাষ ও রপ্তানির মাধ্যমে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।

মাশরুম ছত্রাকের অপকারিতা (Disadvantages of Mushroom):

  • বিষাক্ততা (Toxicity): অপুরিচিত বুনো মাশরুম খাওয়া ঠিক নয়, কারণ কিছু কিছু প্রজাতি; যেমন—Agaricus xanthodermus বেশ বিষাক্ত সবচেয়ে বিষাক্ত হলো Amanita virosa এবং A. Dhalloides প্রজাতি। বিষাক্ত মাশরুম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যু হতে পারে।
  • বিনাশী কার্য (Destructive action): মাশরুম কাঠের গুড়ি, খড়, বাঁশ প্রভৃতির উপর জন্মিয়ে উহাদের ক্ষতি সাধন করে থাকে।
  • জৈব বস্তুর ঘাটতি (Deficiency of organic matter): মাশরুম যেখানে জন্মায়, সেখানে জৈব বস্তুর অভাব দেখা দেয়। এতে মাটির উর্বরা শক্তি বিনষ্ট হয়।