10 Minute School
Log in

খাদ্যের প্রধান উপাদান ও তার উৎস (Main Components of Food And Their Source)

খাদ্যের প্রধান উপাদান (Main Components of Food)

উপাদান অনুযায়ী খাদ্যবস্তুকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়:

(a) আমিষ( Protein): দেহের বৃদ্ধিসাধন এবং ক্ষয়পূরণ করে।

(b) শর্করা (Carbohydrate): দেহে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।

(c) স্নেহ ও চর্বিজাতীয় খাদ্য (Fats): দেহে তাপ এবং শক্তি উৎপাদন করে।

তিন ধরনের উপাদানও দেহের জন্য প্রয়োজন। যেমন:

(d) খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন (Vitamins): রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায় এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উদ্দীপনা যোগায়।

(e) খনিজ লবণ (Mineral salts): বিভিন্ন জৈবিক কাজে অংশ নেয়।

(f) পানি (Water): দেহে পানি এবং তাপের সমতা রক্ষা করে, এছাড়া কোষের কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষ ও তার অঙ্গাণুগুলোকে ধারণ করে।

উল্লেখ করা খাদ্য উপাদানের বাইরে আরও একটি উপাদান রয়েছে, যেটি কোনো পুষ্টি না জোগালেও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান।

(g) খাদ্য আঁশ (Fiber) বা রাফেজ: রাফেজ পানি শোষণ করে এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ও বৃহদন্ত্র থেকে মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে।

আমিষ (Protein)

আমিষ বা প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত। আমিষে শতকরা 16 ভাগ নাইট্রোজেন থাকে। আমিষে সামান্য পরিমাণে সালফার, ফসফরাস এবং আয়রনও থাকে। মূলত অনেকগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমন্বয়ে প্রোটিন বা আমিষ তৈরী।

আমিষের উৎস: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, শিমের বীচি, শুঁটকি মাছ, চিনাবাদাম ইত্যাদি থেকে আমরা আমিষ পাই। উৎস অনুযায়ী আমিষ দুই ধরনের: প্রাণিজ আমিষ এবং উদ্ভিজ্জ আমিষ।

প্রাণিজ আমিষ: মাছ, মাংস, ডিম, পনির, ছানা, কলিজা বা যকৃৎ ইত্যাদি প্রাণিজ আমিষ। এসব খাদ্যে দেহের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়।

Protein - Main Components of Food

চিত্র : আমিষজাতীয় খাদ্য

উদ্ভিজ্জ আমিষ: ডাল, চিনাবাদাম, শিমের বীচি ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ আমিষ। একসময় ধারণা করা হতো এগুলো প্রাণিজ আমিষের তুলনায় কম পুষ্টিকর, কারণ উদ্ভিজ্জ আমিষে প্রয়োজনীয় সব কয়টি অ্যামাইনো এসিড থাকে না।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্ভিজ্জ আমিষ প্রাণিজ আমিষের মতোই সকল অ্যামাইনো এসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে ধারণ করে।

শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate)

শর্করা জাতীয় খাদ্য শরীরে কাজ করার শক্তি যোগায়। শর্করার মৌলিক উপাদান কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। উদ্ভিদের মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল, ফল ও বীজে শর্করা বিভিন্নরূপে জমা থাকে। ফলের রসে গ্লুকোজ, দুধে ল্যাকটোজ, গম, আলু, চাল ইত্যাদিতে শ্বেতসার (স্টার্চ) ইত্যাদি শর্করাজাতীয় খাদ্যের বিভিন্ন রূপ। গঠনপদ্ধতি অনুসারে শর্করাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। নিচের সারণিতে এই তিন ধরনের শর্করার গঠন এবং উৎস দেখানো হলো।

শর্করার শ্রেণিবিভাগ (Classification of carbohydrate)

শর্করা শ্রেণি গঠন উদাহরণ উৎস
এক শর্করা (Monosaccharide) একটি মনোমার বিশিষ্ট শর্করা গ্লুকোজ মধু, ফলের রস
দ্বি-শর্করা (Disaccharide) দুইটি মনোমারবিশিষ্ট (ডাইমার) শর্করা সুক্রোজ, ল্যাকটোজ চিনি ও দুধ
বহু শর্করা (Polysaccharide) বহু মনোমারবিশিষ্ট (পলিমার) শর্করা শ্বেতসার, গ্লাইকোজেন চাল, আটা, আলু, সবুজ শাক-সবজি ইত্যাদি।
Carbohydrate

চিত্র : শর্করাজাতীয় খাদ্য

স্নেহজাতীয় খাদ্য (Fats)

Fats

 

চিত্র : স্নেহজাতীয় খাদ্য

চর্বি একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন দিয়ে তৈরি এই উপাদানটির মুখ্য কাজ হলো তাপ উৎপাদন করা। এই উপাদানটি পাকস্থলীতে অনেকক্ষণ থাকে, তাই তখন ক্ষুধা পায় না। দেহের ত্বকের নিচে চর্বি জমা থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন অঙ্গ যেমন: যকৃৎ, মস্তিষ্ক, মাংস পেশিতেও চর্বি জমা থাকে। দেহের এ সঞ্চিত চর্বি উপবাসের সময় কাজে লাগে। শর্করা ও আমিষের তুলনায় চর্বিতে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ক্যালরি থাকে।

উৎস অনুযায়ী স্নেহপদার্থ দুই ধরনের, উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ ও প্রাণীজ স্নেহপদার্থ ।

উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ: সয়াবিন, সরিষা, তিল, বাদাম, সূর্যমুখী এবং ভুট্টার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল প্রধান।

প্রাণিজ স্নেহপদার্থ: চর্বি, ঘি, ডালডা ইত্যাদি প্রাণিজ স্নেহপদার্থ। ডিমের কুসুমে স্নেহপদার্থ আছে কিন্তু সাদা অংশে স্নেহপদার্থ থাকে না। স্নেহপদার্থ পানিতে অদ্রবণীয়। পানির চেয়ে হালকা বলে পানির উপর ভাসে। একজন সুস্থ সবল পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দিনে 50-60 গ্রাম চর্বির প্রয়োজন হয়।

খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন (Vitamins)

দেহের বৃদ্ধির জন্য ও সুস্থ থাকার জন্য ভিটামিন অত্যাবশ্যক। সুষম খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে বলে সুষম খাদ্য থেকে প্রচুর ভিটামিন পাওয়া যায়।

ভিটামিনকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন এবং পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন।

চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন

ভিটামিন A: দুধ, মাখন, চর্বি, ডিম, গাজর, আম, কাঁঠাল, রঙিন শাকসবজি, মলা মাছ ইত্যাদিতে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়।

ভিটামিন D: দুধ, ডিম, কলিজা বা যকৃৎ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাছের তেল, ভোজ্য তেল ইত্যাদিতে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে।

ভিটামিন E এবং K: উপরে উল্লিখিত সব খাবার থেকে ভিটামিন ‘ই’ এবং ‘কে’ পাওয়া যায়।

পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন

ভিটামিন B: ইস্ট, ঢেকিছাঁটা চাল, জাঁতায় ভাঙা আটা বা লাল আটা, অঙ্কুরিত ছোলা, মুগডাল, মটর এবং প্রাণিজ স্নেহপদার্থ। ফুলকপি, চিনাবাদাম, শিমের বীচি, কলিজা বা যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড, দুধ, ডিম, মাংস, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদিতে ভিটামিন ‘বি’ থাকে।

ভিটামিন C: পেয়ারা, বাতাবি লেবু, কামরাঙা, কমলা, আমড়া, বাঁধাকপি, টমেটো, আনারস, কাঁচামরিচ, তাজা শাকসবজি ইত্যাদি থেকে ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়।

পানিতে অদ্রবণীয় ভিটামিন = A, D, E, K , পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন = B, C।

খনিজ লবণ (Mineral salts)

মানুষের শরীরে ক্যালসিয়াম, লৌহ, সালফার, দস্তা, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়োডিন ইত্যাদি থাকে। এ উপাদানগুলো কখনো মৌলিক উপাদানরূপে মানবদেহে অবস্থান করে না, এগুলো খাদ্য ও মানবদেহে বিভিন্ন পরিমাণে অন্য পদার্থের সাথে মিলিত হয়ে নানা জৈব এবং অজৈব যৌগের লবণ তৈরি করে। খনিজ লবণ দেহ গঠন ও দেহের অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। হাড়, দাঁত, পেশি, এনজাইম এবং হরমোন গঠনের জন্য খনিজ লবণ একটি অপরিহার্য উপাদান। স্নায়ুর উদ্দীপনা, পেশি সংকোচন, দেহকোষে পানির সাম্যতা বজায় রাখা, অম্ল ও ক্ষারের সমতাবিধান, এসব কাজে খনিজ লবণের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

দুধ, দই, ছানা, পনির, ছোট মাছ (মলা-ঢেলা) নানা রকম ডাল, সবুজ শাকসবজি, ঢেঁড়স, লাল শাক, কচু শাক ইত্যাদি ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস। কলিজা, সবুজ শাকসবজি, মাংস, ডিমের কুসুম, কচু শাক ইত্যাদিতে লৌহ থাকে। দুধ, মাছ, মাংস, বাদাম, ডাল থেকে ফসফরাস পাওয়া যায়। খাবার লবণ, চিপস, নোনতা খাবার, পনির, বাদাম, আচার ইত্যাদিতে সোডিয়াম থাকে। মাছ, মাংস, বাদাম, ডাল, কলা, আলু, আপেল ইত্যাদিতে পটাশিয়াম থাকে। আয়োডিনের উৎস হলো সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছ, মাংস এবং শেওলা।

পানি (Water)

পানির অপর নাম জীবন। জীবনরক্ষার কাজে অক্সিজেনের পরেই পানির স্থান। দেহের পুষ্টির কাজে পানি অপরিহার্য। দেহের গঠন ও অভ্যন্তরীণ কাজ পানি ছাড়া চলতে পারে না। মানবদেহে পানির কাজগুলোকে তিন ভাগে করা যায় : দেহ গঠন, দেহের অভ্যন্তরীণ কার্য নিয়ন্ত্রণ এবং দেহ থেকে দূষিত পদার্থ নির্গমন।

দেহ গঠন: দেহকোষের গঠন এবং প্রতিপালন পানি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। গড়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈহিক ওজনের 50%-65% পানি।

দেহের অভ্যন্তরীণ কার্য নিয়ন্ত্রণ: পানি ব্যতীত দেহের অভ্যন্তরের কোনো রাসায়নিক ক্রিয়া চলতে পারে না। দেহে পানি দ্রাবকরূপে কাজ করে। পানির জন্যই দেহে রক্তসঞ্চালন সম্ভব। রক্তে পরিবাহিত খাদ্য উপাদান এবং অক্সিজেন পানির মাধ্যমে দেহকোষে পৌঁছাতে পারে। দেহের সকল ধরনের রসে খনিজ লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। পরিপাককৃত খাদ্য উপাদান পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্য দিয়ে রক্তে বিশোষিত হয়।

দূষিত পদার্থ নির্গমন: পানি দেহের দূষিত পদার্থ অপসারণে সাহায্য করে। মলমূত্র, ঘাম ইত্যাদি দূষিত পদার্থের সাথে দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক 2 লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। যেমন: কোনো ব্যক্তির দৈনিক ক্যালরি চাহিদা 2000 কিলোক্যালরি হলে, তার দৈনিক 2 লিটার পানির প্রয়োজন হয়।

খাদ্য আঁশ (Fiber) বা রাফেজ

শস্যদানার বহিরাবরণ, সবজি, ফলের খোসা, শাঁস, বীজ এবং উদ্ভিদের ডাঁটা, মূল ও পাতায় আঁশ থাকে। এগুলো মূলত কোষপ্রাচীরের সেলুলোজ এবং লিগনিন। হাড় যেমন মানবদেহের কাঠামো তৈরি করে, সেলুলোজ এবং রাফেজ তেমনি উদ্ভিদের কাঠামো তৈরি করে। এগুলো জটিল শর্করা। গবাদিপশু, যেমন: গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদি সেলুলোজ হজম করতে পারে। কিন্তু মানুষ এগুলো হজম করতে পারে না। রাফেজ পানি শোষণ করে এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ও বৃহদান্ত্র থেকে মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে। রাফেজযুক্ত খাবার বিষাক্ত বর্জনীয় বস্তুকে খাদ্যনালি থেকে পরিশোষণ করে। ধারণা করা হয়, এরূপ খাবার খাদ্যনালির ক্যান্সারের আশঙ্কা অনেকাংশে হ্রাস করে। আঁশযুক্ত খাবার স্থূলতা হ্রাস, ক্ষুধাপ্রবণতা এবং চর্বি জমার প্রবণতা হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।