মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষা (Michelson-Morley experiment)
মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষা কি (What is Michelson-Morley experiment)
1861 খ্রিস্টাব্দে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলি আবিষ্কারের পর দেখা গেল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ শূন্য স্থানে আলোর বেগে প্রবাহিত হয়। পরে হার্জ তার পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন যে, আলো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ।
ওই সময় বস্তু মাধ্যম ব্যতিরেকে তরঙ্গের চলাচল চিন্তা করা সম্ভব ছিল না। তাই মনে করা হয়েছিল যে, বিশ্বের সর্বত্র এমনকি মহাশূন্যে, এবং অণু-পরমাণুর অভ্যন্তরেও এমন একটি মাধ্যম আছে যার মধ্য দিয়ে গ্রহ, নক্ষত্র ছুটে চলে—যে মাধ্যম কোনো কিছুর গতিকে বাধা দেয় না, যার ওজন নেই, সেই মাধ্যমের নাম করা হয়েছিল ইথার মাধ্যম।
সেই ইথারের সাপেক্ষে স্থির কাঠামোকে বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত কাঠামো বলা হয়েছিল। ব্রাডলির পরীক্ষা হতে জানা গেছে যে, পৃথিবী ইথার মাধ্যমের সাপেক্ষে 30 কিমি/সে বেগে বিচরণ করে এবং পারিপার্শ্বিক ইথার মাধ্যমকে কোনোরূপ আলোড়িত করে না।
পৃথিবী ও ইথারের মধ্যে আপেক্ষিক বেগ পরিমাপের জন্য অনেক বিজ্ঞানী অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন; কিন্তু মাইকেল সন-মর্লির পরীক্ষাটিও (Michelson-Morley experiment) না-ধর্মী পরীক্ষা। তাই এই পরীক্ষা বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি করে। এই না-ধর্মী পরীক্ষায় প্রকৃতির ইথার মাধ্যম বিষয়ক রহস্য উদঘাটিত হয়।
1887 খ্রিস্টাব্দে আলবার্ট মাইকেলসন ও এডওয়ার্ড মর্লি ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এই পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। মাইকেলসন তার পরীক্ষার জন্য এক অভূতপূর্ব সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার করেন যার ফলে তিনি নোবেল পুরস্কারের সম্মান লাভ করেন। তাঁর যন্ত্রের নাম করা হয় মাইকেলসন ব্যতিচার মাপক যন্ত্র। এই পরীক্ষাটি পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে এক শ্রেণির পরীক্ষা যা হতে ইথার মাধ্যমের যে অস্তিত্ব নেই তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
এই যন্ত্রে S একটি একরঙ বিশিষ্ট আলোক রশ্মি যা হতে লেন্সের মাধ্যমে সমান্তরাল হয়ে একটি রশ্মি 45 \degree কোণে হেলানো একটি অর্ধস্বচ্ছ কাঁচের প্লেট P_1–এর ওপর আপতিত হয়। এই আপতিত রশ্মি A বিন্দুতে সমকোণে দুই অংশে বিভক্ত হয়। একটি অংশ P_1 -এর উপরিতল হতে প্রতিফলিত হয়ে আড়াআড়িভাবে M_1দর্পণে আপতিত হয় এবং পুনরায় প্রতিফলিত হয়ে একই পথে দূরবীণ T– তে ফিরে আসে। অপর রশ্মিটি P_1 প্লেটের ভেতর দিয়ে প্রতিসরিত হয়ে লম্বিকভাবে M_2 দর্পণে আপতিত হয়ে পুনরায় প্রতিফলিত হয়ে প্রথম রশ্মির সাথে মিলিত হয়।
এই আলোক রশ্মিদ্বয় প্রায় সমান পথ অতিক্রম করে। M_1 ও M_2 দর্পণের সম্মুখ ভাগ ভালোভাবে রূপার প্রলেপযুক্ত করা হয় যাতে পৌনঃপুনিক প্রতিফলন না ঘটে এবং দর্পণদ্বয়কে সমকোণে সাজানো হয়।
P_1 প্লেট হতে উভয় দর্পণের দূরত্ব d ধরা হয়। এখানে P_2 একটি ক্ষতিপূরণকারী প্লেট যা দ্বারা কাঁচের মধ্যে অতিক্রান্ত দূরত্ব দুই রশ্মির ক্ষেত্রে সমান থাকে। যদি আলোক রশিদ্বয় ঠিক সমান্তরাল হয় এবং P_1 প্লেট হতে AB ও AC-এর দূরত্ব d-এর সমান হয় তবে M-1 ও M_2হতে প্রতিফলিত রশিদ্বয় একই দশায় থাকে এবং দূরবীন T-তে উজ্জ্বল আলোর ব্যতিচার নকশা দেখা যায়।
যদি M_1 ও M_2-এর মধ্যে কোণ এক সমকোণ হয় তবে ব্যতিচার নকশাটি বৃত্তাকার সমকেন্দ্রিক রেখার সমষ্টি হয় আর যদি M_1 ও M_2 -এর মধ্যে কোণ এক সমকোণের চেয়ে কম রাখা যায় যা পরীক্ষায় রাখা হয়েছিল, তবে ব্যতিচার নকশাটি কয়েকটি সমান্তরাল সরলরেখার সমষ্টি হয়।
মনে করি ইথার মাধ্যমের সাপেক্ষে যন্ত্রের বেগ ডান দিকে এবং বিপরীতে -\vartheta, যদি আলোর সঠিক বেগ c হয় তবে যন্ত্রের সাপেক্ষে আলোর বেগ হবে (c-\vartheta) A C বরাবর এবং A হতে C– তে যেতে সময় t_1 হলে সময় \mathrm{t}_{1}=\frac{d}{c-\vartheta}।
আলোক রশ্মি M_2 হতে প্রতিফলিত হয়ে ফেরত আসার সময় যন্ত্রের সাপেক্ষে আলোর বেগ হবে (\mathrm{c}+\vartheta) এবং সময়, \mathrm{t}_{2}=\frac{d}{c+\vartheta}।
অতএব আলোক রশ্মি A হতে C এবং C হতে A-তে ফিরে আসতে মোট সময় t হলে,
\begin{aligned} \mathrm{t}=\mathrm{t}_{1}+\mathrm{t}_{2}=\frac{d}{c-\vartheta}+\frac{d}{c+\vartheta} &=\frac{d(c+\vartheta)+d(c-\vartheta)}{c^{2}-\vartheta^{2}} \\ &=\frac{d c+d \vartheta+d c-d \vartheta}{c^{2}-\vartheta^{2}} \\ &=\frac{2 d c}{c^{2}-\vartheta^{2}}=\frac{2 d}{c\left(1-\frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)} \\ &=\frac{2 d}{c}\left(1-\frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)^{-1} \end{aligned}পৃথিবী ও যন্ত্র গতিশীল থাকার কারণে A হতে রশ্মিটি B অবস্থানে আপতিত না হয়ে B’ অবস্থানে আপতিত হবে।
অতএব A B^{\prime} A^{\prime}=A B^{\prime}+B^{\prime} A^{\prime}=2 A B^{\prime}
আবার A B^{\prime 2}=A O^{2}+O B^{\prime 2}
\therefore \mathrm{c}^{2} \mathrm{t}_{1}{ }^{\prime 2}=\vartheta^{2} \mathrm{t}_{1}{ }^{\prime 2}+\mathrm{d}^{2} \therefore \mathrm{t}_{1}^{\prime}=\frac{d}{\left(c^{2}-\vartheta^{2}\right)^{1/2}}আবার A হতে B এবং B হতে A-তে ফিরে আসতে আলোর মোট সময় t’ হলে,
সময় \mathrm{t}^{\prime}=\mathrm{t}_{1}^{\prime}+\mathrm{t}_{1}^{\prime}=2 \mathrm{t}_{1}^{\prime}
\begin{array}{l} =\frac{2 d}{\left(c^{2}-\vartheta^{2}\right)^{1/2}} \\ =\frac{2 d}{c}\left(1-\frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)^{-\frac{1}{2}} \end{array}
আড়াআড়িভাবে ও লম্বিকভাবে আলোক রশ্মি চলাচল করবার জন্য দুই রকম সময় পাওয়া গেল। এই দুই রকম সময় t ও t’- এর পার্থক্যের ফলে ব্যতিচার নকশার সৃষ্টি হয়। যদি যন্ত্রটি স্থির থাকে বলে ধরা হয় তবে \frac{\vartheta^{2}}{c^{2}} এর মানখুবই কম হয়। পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে A হতে B-তে যেতে ও আসতে সময় t’, A হতে C-তে যেতে ও আসতে সময় t অপেক্ষা কম যদিও উভয় ক্ষেত্রে আলোক রশ্মি একই দূরত্ব অতিক্রম করে ইথার মাধ্যমে।
অতএব সময়ের পার্থক্য \Delta \mathrm{t}=\mathrm{t}-\mathrm{t}^{\prime}
=\frac{2 d}{c}\left(1-\frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)^{-1}-\frac{2 d}{c}\left(1-\frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)^{-\frac{1}{2}}
যদি যন্ত্রের বা পৃথিবীর বেগ \vartheta<<C হয় তবে বাইনোমিয়াল (Binomial) তত্ত্ব দ্বারা সম্প্রসারিত করলে পাই
\begin{aligned} \Delta \mathrm{t} &=\frac{2 d}{c}\left[\left(1+\frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)-\left(1-\frac{1}{2} \frac{\vartheta^{2}}{c^{2}}\right)\right] \\ &=\frac{2 d}{c} \cdot \frac{\vartheta^{2}}{2 c^{2}}=\frac{d \vartheta^{2}}{c^{3}} \end{aligned}এই ∆t সময়ে আলো কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব = ∆t x আলোর বেগ, \mathrm{c}=\frac{d \vartheta^{2}}{c^{3}} x \mathrm{c}=\frac{d \vartheta^{2}}{c^{2}}। এই দূরত্ব হতে এটিই বুঝতে পারা যায় যে AC আলোর পথ AB আলোর পথ হতে বেশি। যন্ত্রটি গতিশীল থাকার কারণেই এই পথ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়।
যদি মাইকেলসন ব্যতিচার মাপক যন্ত্রের দুই বাহুর বিনিময় করা হয় অর্থাৎ পুরো যন্ত্রটিকে 90° কোণে ঘুরানো হয় তবে প্রথম বাহুটি দ্বিতীয় বাহুর স্থানে এবং দ্বিতীয় বাহুটি প্রথম বাহুর স্থানে আসে। এই অবস্থায় মোট পথ পার্থক্য হয় \frac{2 d \vartheta^{2}}{c^{2}}। এই পথ পার্থক্যের কারণে দূরবিনে ব্যতিচার নকশার কিছু অপসারণ হয়। মনে করি সেই অপসারণের পরিমাণ n।
যেহেতু এক তরঙ্গদৈর্ঘ্য λ -এর সমান পথ পার্থক্যে নকশার অপসারণ হয় 1 ব্যতিচার
∴ n ব্যতিচার অপসারণের জন্য পথ পার্থক্য হবে nλ
অতএব \mathrm{n} \lambda=\frac{2 d \vartheta^{2}}{c^{2}} এখানে n= \mathrm{n} \lambda=\frac{2 d \vartheta^{2}}{c^{2} \lambda}
মাইকেলসন ও মর্লি দূরত্ব ‘d’-কে বাড়িয়ে 11m ধরেছিলেন।
পৃথিবীর কক্ষপথের বেগ, \vartheta=30 \mathrm{kms}^{-1} বা 3 \times 10^{6} \mathrm{cms}^{-1}
আলোর বেগ, c =3 \times 10^{10} \mathrm{cms}^{-1}
এবং ব্যবহৃত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য \lambda=6 \times 10^{-5} \mathrm{cms}^{-1} হলে উক্ত সমীকরণ অনুসারে ব্যতিচার নকশার অপসারণের পরিমাণ দাঁড়ায়,
\mathrm{n}=\frac{2 d \vartheta^{2}}{c^{2} \lambda}=\frac{2 \times 1100 \times 9 \times 10^{10}}{9 \times 10^{20} \times 6 \times 10^{5}}=0.37 \approx 0.4মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ (Analysis of the experimental result of Michelson-Morley experiment)
এই পরীক্ষায় ব্যতিচার নকশার অপসারণ ব্যতিচার রেখার বিস্তৃতির 25 ভাগের এক ভাগ যা মাইকেলসনের সুক্ষ যন্ত্রে মাপা সম্ভব হয়। এই অপসারণে পরিমাণ এতই সামান্য যে তাকে নগণ্য ধরা যায়। অর্থাৎ মাইকেলসনের মতে ব্যতিচার রেখাগুলির কোনো অপসারণ হয়নি। এটি হতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্থিতিশীল ইথার প্রকল্পের ফলাফল ভুল বা পৃথিবী ও ইথারের মধ্যে কোনো আপেক্ষিক বেগ নেই।
এই পরীক্ষাটি পৃথিবীর গভীরে, ওপরে, বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে, এমনকি লেজার রশ্মি ব্যবহার করেও একই ফলাফল পাওয়া যায়। ফলে ইথার প্রবাহ তত্ত্বটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই সমস্ত ফলাফল বিবেচনা করে আইনস্টাইন তার দ্বিতীয় স্বীকার্যে বলেছিলেন শূন্য স্থানে আলোর বেগ বিশ্বজনীনভাবে ধ্রুব।
মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার সিদ্ধান্ত (Michelson-Morley experiment Decision)
বিজ্ঞানী মাইকেলসন এবং বিজ্ঞানী মর্লি ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে পরীক্ষা সম্পাদন করেন এবং তাদের পরীক্ষা হতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে আসা যায় –
(ক) ইথার বলতে এই মহাবিশ্বে কিছু নেই।
(খ) গ্যালিলিয় রূপান্তর সঠিক নয়।
(গ) আলোকের বেগ একটি ধ্রুব রাশি। এটি উৎস অথবা পর্যবেক্ষণ বা মাধ্যমের গতির ওপর নির্ভর করে না।
জানার বিষয়: ইথার বলতে এ মহাবিশ্বে কিছুই নেই একথা বলেছেন বিজ্ঞানী মাইকেলসন ও মর্লি।