উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান বলতে কী বোঝো? (What Are Plant Nutrients?)
উদ্ভিদের খনিজ পুষ্টি উপাদান(Plant Mineral Nutrients)
উদ্ভিদ তার বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টির জন্য মাটি, বায়ু ও পানি থেকে কতগুলো উপাদান গ্রহণ করে। পুষ্টি উপাদানের অধিকাংশই উদ্ভিদ মাটি থেকে সংগ্রহ করে বলে এদেরকে খনিজ পুষ্টি বলে। উদ্ভিদে প্রায় 60 টি অজৈব উপাদান শনাক্ত করা হয়েছে, তবে এই 60 টি উপাদানের মধ্যে মাত্র 16 টি উপাদান উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। এ 16 টি পুষ্টি উপাদানকে সমষ্টিগতভাবে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান (essential elements) বলা হয়। এই উপাদানগুলো সব ধরনের উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, শারীরবৃত্তীয় কাজ এবং প্রজননের জন্য প্রয়োজন।
অত্যাবশ্যকীয় 16 টি উপাদানের মধ্যে উদ্ভিদ কোনো কোনো উপাদান বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে, আবার কোনো কোনো উপাদান সামান্য পরিমাণে গ্রহণ করে। উদ্ভিদ কর্তৃক গৃহীত অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পুষ্টির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ম্যাক্রো উপাদান এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো উপাদান।
ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ম্যাক্রো উপাদান (macro-nutrient বা macro-element): উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যেসব উপাদান বেশি পরিমাণে দরকার হয়, সেগুলোকে ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ম্যাক্রো উপাদান বলা হয়। ম্যাক্রো উপাদান 10 টি, যথা: নাইট্রোজেন (N), পটাশিয়াম (K), ফসফরাস (P), ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (O), সালফার (S) এবং লৌহ (Fe)।
(মনে রাখার উপায়: MgK CaFe for Nice CHOPS)
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো উপাদান (micro-nutrient বা micro-element): উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যেসব উপাদান অত্যন্ত সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় তাদেরকে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো উপাদান বলে। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট 6 টি, যথা: দস্তা বা জিংক (Zn), ম্যাংগানিজ (Mn), মোলিবডেনাম (Mo), বোরন (B), তামা বা কপার (Cu) এবং ক্লোরিন (Cl)।
পুষ্টি উপাদানের উৎস (Source of nutrients)
উদ্ভিদ পুষ্টি (Plant Nutrients) উপাদানগুলোর মধ্যে কার্বন এবং অক্সিজেন বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রহণ করে। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন পানি থেকে গ্রহণ করে। অন্যসব উপাদান মাটি থেকে মূলের সাহায্যে শোষণ করে। এ উপাদানগুলো মাটিতে বিভিন্ন লবণ হিসেবে থাকে। কিন্তু উদ্ভিদ এগুলোকে লবণ হিসেবে সরাসরি শোষণ করতে পারে না, আয়ন হিসেবে শোষণ করে। যেমন: Ca++, Mn++, NH4+, NO3–,K+ ইত্যাদি।
উদ্ভিদের পুষ্টিতে বিভিন্ন খনিজ উপাদানের ভূমিকা (Role of various minerals in plant nutrition)
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন খনিজ পুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টের ভূমিকার কথা নিচে বর্ণনা করা হলো।
নাইট্রোজেন (Nitrogen):
- নাইট্রোজেন নিউক্লিক অ্যাসিড, প্রোটিন আর ক্লোরোফিলের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
- উদ্ভিদের সাধারণ দৈহিক বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং কোষ কলায় পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
- নাইট্রোজেনের অভাব হলে ক্লোরোফিল সৃষ্টি ব্যাহত হয়, আর ক্লোরোফিল সৃষ্টি ব্যাহত হলে খাদ্য প্রস্তুত বাধাপ্রাপ্ত হয়। খাদ্যপ্রস্তুত বাধাপ্রাপ্ত হলে শ্বসন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে এবং শক্তি নির্গমন হ্রাস পায়।
ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium):
ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরোফিল অণুর একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সাহায্য করে। এর অভাব হলে ক্লোরোফিল অণু সৃষ্টি এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত ব্যাহত হবে।
পটাশিয়াম (Potassium):
- উদ্ভিদের বহু জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় পটাশিয়াম সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
- পত্ররন্ধ্র খোলা এবং বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে পটাশিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম।
- পটাশিয়াম উদ্ভিদে পানি শোষণে সাহায্য করে।
- কোষ বিভাজনের মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে পটাশিয়াম।
- এটি মূল, ফুল ও ফল উৎপাদন এবং বর্ধনেও সাহায্য করে।
ফসফরাস (Phosphorus):
মূল বর্ধনের জন্য ফসফরাস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। ফসফরাস জীবকোষের DNA, RNA NADP, ATP প্রভৃতির গাঠনিক উপাদান।
আয়রন (Iron):
- আয়রন সাইটোক্রোমের সাংগঠনিক উপাদান, কাজেই বায়বীয় শ্বসন এর উপর নির্ভরশীল।
- ক্লোরোফিল সৃষ্টিতেও আয়রনের ভূমিকা অপরিসীম।
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন:
ম্যাংগানিজ (Manganese): ক্লোরোপ্লাস্ট গঠন ও সংরক্ষণের জন্য ম্যাংগানিজ প্রয়োজন।
কপার (Cupper): টমেটো, সূর্যমুখী উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য কপার বা তামার প্রয়োজন, শ্বসন প্রক্রিয়ার উপরও কপারের প্রভাব উল্লেখযোগ্য।
বোরন (Boron): উদ্ভিদের সক্রিয়ভাবে বর্ধনশীল অঞ্চলের জন্য বোরন প্রয়োজন, চিনি পরিবহনে বোরন পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে।
মোলিবডেনাম (Molybdenum): অণুজীব দিয়ে বায়বীয় নাইট্রোজেন সংবন্ধনের জন্য মোলিবডেনাম আবশ্যক।
ক্লোরিন (Chlorine): সুগারবিট এর মূল এবং কাণ্ডের বৃদ্ধির জন্য ক্লোরিন প্রয়োজন।
পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ (Symptoms of malnutrition)
অভাবজনিত লক্ষণ |
রোগাক্রান্ত উদ্ভিদ |
নাইট্রোজেন (N): নাইট্রোজেনের অভাব হলে ক্লোরোফিল সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটে। ক্লোরোফিলের অভাবে পাতার সবুজ রং হালকা হতে হতে একসময় হলুদ হয়ে যায়। পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘ক্লোরোসিস’ (chlorosis) বলে। লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ বা দস্তার অভাবেও ক্লোরোসিস হতে পারে কেননা এগুলোও ক্লোরোফিল উৎপাদনের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ক্লোরোসিসে কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজন হ্রাস পায়, তাই উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়। | |
ফসফরাস (P): ফসফরাসের অভাব হলে পাতা বেগুনি হয়ে যায়। পাতায় মৃত অঞ্চল সৃষ্টি হয় এমনকি পাতা, ফুল ও ফল ঝরে যেতে পারে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং উদ্ভিদ খর্বাকার হয়। | |
পটাশিয়াম (k): পটাশিয়ামের অভাবে পাতার শীর্ষ এবং কিনারা হলুদ হয় এবং মৃত অঞ্চল সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পাতার শিরার মধ্যবর্তী স্থানে ক্লোরোসিস হয়ে হলুদবর্ণ ধারণ করে। পাতার কিনারায় পুড়ে যাওয়া সদৃশ বাদামি রং দেখা যায় এবং পাতা কুঁকড়ে আসে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি কম হয় এবং শীর্ষ ও পার্শ্ব মুকুল মরে যায়। | |
ক্যালসিয়াম (Ca): কোষের সাইটোসলে ক্যালসিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের স্বাভাবিক কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত। মাত্রা কমে গেলে মাইটোকন্ড্রিয়ায় অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়া এবং এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের প্রোটিন ট্রাফিকিং প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়। তাই ক্যালসিয়ামের অভাবে উদ্ভিদের বর্ধনশীল শীর্ষ অঞ্চল, বিশেষ করে ফুল ফোটার সময় উদ্ভিদের কাণ্ড শুকিয়ে যায় এবং উদ্ভিদ হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে। | |
ম্যাগনেসিয়াম (Mg): ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে ক্লোরোফিল সংশ্লেষিত হয় না বলে সবুজ রং হালকা হয়ে যায় এবং সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়। পাতার শিরাগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অধিক হারে ক্লোরোসিস হয়। | |
লৌহ (Fe): লৌহের অভাবে প্রথমে কচি পাতার রং হালকা হয়ে যায়, তবে পাতার সরু শিরার মধ্যবর্তী স্থানেই প্রথম হালকা হয় এবং ক্লোরোসিস হয়। কখনো কখনো সম্পূর্ণ পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়। কাণ্ড দুর্বল এবং ছোট হয়। | |
সালফার (S): সালফার উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রোটিন, হরমোন ও ভিটামিনের গাঠনিক উপাদানই শুধু নয়, একই সাথে এটি কোষে পানির সমতা রক্ষা করে। সালফারের অভাবে পাতা হালকা সবুজ হয় এবং পাতায় লাল ও বেগুনি দাগ দেখা যায়। কচি পাতায় বেশি এবং বয়োবৃদ্ধ পাতায় কম ক্লোরোসিস হয়। সালফারের অভাবে মূল, কাণ্ড এবং পাতার শীর্ষ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে টিস্যু মারা যেতে থাকে, যাকে ডাইব্যাক (dieback) বলে। কাণ্ডের মধ্যপর্ব ছোট হয় বলে গাছ খর্বাকৃতির হয়। | |
বোরন (B): বোরন কোষপ্রাচীরের কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে প্রাচীরটিকে তথা কোষটিকে দৃঢ়তা দেয়। বিপাক ক্রিয়ার বিভিন্ন বিক্রিয়ায় এর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রয়েছে। তাই বোরনের অভাবে পর্যাপ্ত দৃঢ়তা না পেয়ে এবং বিপাকে গোলযোগ হওয়ার কারণে উদ্ভিদের বর্ধনশীল অগ্রভাগ মরে যায়। কচি পাতার বৃদ্ধি কমে যায় এবং পাতা বিকৃত হয়, কাণ্ড খসখসে হয়ে ফেটে যায়। ফুলের কুঁড়ির জন্ম ব্যাহত হয়। |