10 Minute School
Log in

প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস কার্যক্রম | Ventilation Mechanism

যে প্রক্রিয়ায় ফুসফুসে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ বায়ু প্রবেশ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড-সমৃদ্ধ বায়ু ফুসফুস থেকে বের হয়ে যায় তাকে শ্বাসক্রিয়া (breathing) বলে। প্রকৃতপক্ষে এটি বহিঃশ্বসন প্রক্রিয়া। বক্ষগহ্বরের আয়তন হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ফুসফুসের আয়তন সঙ্কোচন-প্রসারণের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। দুধরনের পেশির ক্রিয়ায় বক্ষগহ্বরের আয়তনের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে : 

(১) বক্ষ ও উদর গহ্বরের মাঝে অবস্থিত মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রাম (diaphragm) এবং 

(২) পশুকাসমূহের (ribs) ফাঁকে অবস্থিত ইন্টারকোস্টাল পেশি (intercostal muscle)। 

শ্বাসক্রিয়া দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়, যথা: 

(ক) প্রশ্বাস বা শ্বাসগ্রহণ এবং 

(খ) নিঃশ্বাস বা শ্বাসত্যাগ।

নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।

(ক) প্রশ্বাস বা শ্বাসগ্রহণ (Inspiration) : 

ডায়াফ্রাম-পেশি সংকুচিত হলে এর কেন্দ্রীয় টেনডন (tendon) নিম্নমুখে সঞ্চালিত হয়। ফলে বক্ষগহ্বরের অনুদৈর্ঘ্য ব্যাস বেড়ে যায়। একই সময় নিম্নভাগের পর্শুকাগুলো (ribs) কিছুটা উপরে উঠে আসায় বক্ষগহ্বরের পার্শ্বীয় এবং অগ্র-পশ্চাৎ ব্যাসও বেড়ে যায়। ইন্টারকোস্টাল (intercostal) পেশির সংকোচনের ফলে পর্শুকার দেহ (shaft) উত্তোলিত হয়। এতে স্টার্নাম উপরে উঠে সামনে সঞ্চালিত হয়। ফলে বক্ষের অগ্র-পশ্চাৎ ব্যাসসহ অনুপ্রস্থ ব্যাস বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস কার্যক্রম

 

এভাবে ডায়াফ্রাম ও পর্শুকা পেশির সংকোচনের ফলে বক্ষীয় গহ্বর সবদিকে বেড়ে যায়। এ কারণে ফুসফুস প্রসারিত হয়ে এর ভিতরের আয়তনও বাড়িয়ে দেয়। প্রসারিত ফুসফুসের অভ্যন্তরীণ চাপ বাতাসের সাধারণ চাপ অপেক্ষা কম হওয়ায় নাসিকা পথের ভিতর দিয়ে আসা বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করে।

পরিবেশ থেকে O– সমৃদ্ধ বায়ু নাসারন্ধ্র পথে ট্রাকিয়া ব্রঙ্কাস ব্রঙ্কিওল অ্যালভিওলাই তথা ফুসফুসে প্রবেশ।

খ. নিঃশ্বাস বা শ্বাসত্যাগ (Expiration) : 

এটি প্রশ্বাসের পর পরই সংঘটিত একটি নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়া। প্রশ্বাসে অংশগ্রহণকারী পেশিগুলোর প্রসারণ বা শিথিলতার জন্য নিঃশ্বাস ঘটে।

নিঃশ্বাসের সময় প্রশ্বাসকালে অংশগ্রহণকারী পেশিগুলো স্থিতিস্থাপকতার জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। পর্শুকাগুলো নিজস্ব ওজনের জন্য নিম্নগামী হয়; উদরীয় পেশিগুলোর চাপে ডায়াফ্রাম ধনুকের মতো বেঁকে বক্ষগহ্বরের আয়তন কমিয়ে দেয়; ফুসফুসীয় পেশি পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়; এবং প্লিউরার অন্তঃস্থ চাপ ও ফুসফুসের বায়ুর চাপ বেড়ে যায়। বাতাস তখন ফুসফুস থেকে নাসিকা পথে বেরিয়ে গেলে ফুসফুসের আয়তনও কমে যায়।

ফুসফুসে CO2-সমৃদ্ধ বায়ু অ্যালভিওলাই ব্রঙ্কিওল ব্রঙ্কাস নাসাপথ নাসারন্ধ্র পথে বাইরে নিষ্কাশন।

শ্বসন একটি ছন্দময় প্রক্রিয়া। পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষে বিশ্রামকালে এ প্রক্রিয়া প্রতিমিনিটে ১৪-১৮ বার এবং নবজাত শিশুতে ৪০ বার সংঘটিত হয়। তবে ব্যায়াম বা অন্য কারণে শ্বসনের হার দ্রুত হয় বলে উদরীয় পেশিও তখন শ্বসন কাজে যোগ দেয়।

প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ (Control of Ventilation Mechanism)

মানুষের প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস কার্যক্রম দুভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। যথা:- ১. স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ ও ২. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ।

নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।

১. স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ (Nervous control)

মস্তিস্কের কয়েকটি শ্বাসকেন্দ্র, শসন সংশ্লিষ্ট প্রতিবর্ত ক্রিয়া এবং আরও কিছু স্নায়বিক উদ্দীপনা শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো ।

ক. শ্বাসকেন্দ্র (Respiratory centre) : মস্তিষ্কে অবস্থিত চারটি কেন্দ্র থেকে শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। পনস (pons)- এর পার্শ্বদেশে অবস্থিত একজোড়া স্নায়ুকেন্দ্র এবং মেডুলা অবলংগাটার (medulla oblongata) পার্শ্বদেশে অবস্হিত একজোড়া স্নায়ুকেন্দ্র প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে। এদের শ্বাসকেন্দ্র বলে। পনসের পাশে অবস্থিত স্নায়ুকেন্দ্র দুটি যথাক্রমে নিডমোট্যাক্সিকঅ্যানিউস্টিক স্নায়ুকেন্দ্র (pneumotaxic and apneustic center) এবং মেডুলার পাশে অবস্থিত স্নায়ুকেন্দ্র প্রশ্বাসকেন্দ্রনিঃশ্বাসকেন্দ্র নামে পরিচিত।

প্রশ্বাস-নিঃশ্বাসের স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ

উল্লিখিত স্নায়ুকেন্দ্রগুলো শ্বসন সংশ্লিষ্ট অঙ্গপ্রতঙ্গের সঙ্গে স্নায়ুজালক দিয়ে যুক্ত। স্নায়কেন্দ্রের মধ্যে প্রশ্বাসকেন্দ্র ও নিঃশ্বাসকেন্দ্রের কার্যকারিতা পরস্পর বিপরীতমুখী অর্থাৎ যেকোনো একটি উদ্দীপিত হলে অন্যটি ছন্দময় প্রক্রিয়ার অবদমিত হয়ে পড়ে। রক্তে CO2 এর উপস্থিতিতে অ্যানিউস্টিক কেন্দ্র হয়ে প্রশ্বাসকেন্দ্রে পৌঁছালে সেখান থেকে উদ্দীপক স্নায়ুর মাধ্যমে ডায়াফ্রাম ও ইন্টারকোস্টাল পেশিতে পৌছায়। তৎক্ষনাৎ প্রশ্বাস শুরু হয়ে যায়। একই সময়ে স্নায়ুতাড়না প্রশ্বাসকেন্দ্র থেকে নিউমোট্যাক্সিক কেন্দ্রেও প্রেরিত হয়। নিউমোট্যাক্সিক কেন্দ্রের স্নায়ুতাড়না ভেগাস স্নায়ুর মাধ্যমে ফুসফুসে বায়ুস্ফীতি উদ্দীপনা অ্যানিউস্টিক কেন্দ্রে পৌঁছালে তা প্রশমিত হয় ফলে প্রশ্বাসকেন্দ্রে স্নায়ুতাড়না বন্ধ হয়ে। এতে প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এসময় নিউমোট্যাক্সিক কেন্দ্র থেকে স্নায়ুতাড়না নিঃশ্বাস কেন্দ্রে পৌঁছালে নিঃশ্বাস শুরু হয়। নিউমোট্যাক্সিক কেন্দ্র থেকে একই সাথে তাড়না প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসকেন্দ্রে পৌছানোর ফলে একই সময়ে প্রশ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হয় এবং নিঃশ্বাস ক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় ফুসফুস সংকোচনজনিত কোনো উদ্দীপনা অ্যানিউস্টিক কেন্দ্রে পৌছাঁয় না বলে এর অবদমন ক্রিয়া অপসৃত হয়। ফলে অ্যানিউস্টিক কেন্দ্র পুনরায় উদ্দীপ্ত হয়ে স্নায়ুতাড়না প্রশ্বাসকেন্দ্রে প্রেরণ করে। এতে পুনরায় প্রশ্বাস চালু হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমিক ঘটনার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় থাকে।

খ. শ্বসন অঙ্গে প্রতিবর্তি ক্রিয়া (Reflex action of Respiratory organ) : শ্বাসক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন, প্রত্যঙ্গে নিচে বর্ণিত প্রতিবর্তি ক্রিয়ার মাধ্যমে শ্বসন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়।

প্রশ্বাসে ফুসফুস বায়ুস্ফীত হলে ফুসফুসের টানে গ্রাহক কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়। এ উদ্দীপনা ভেগাস স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ু কেন্দ্রে প্রেরিত হলে কার্যক্রম প্রশমিত হয় ও প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাসের সময় ফুসফুস সংকুচিত থাকে বলে টান গ্রাহককোষ উদ্দীপ্ত হয়না, তাই ভেগাস স্নায়ুর মাধ্যমে কোনো স্নায়ু তাড়না পরিবাহিত হয় না। এতে অ্যানিউস্টিক স্নায়ুকেন্দ্র কার্যকারিতা ফিরে পেয়ে প্রশ্বাস ঘটায়। ফুসফুসের এধরনের স্ফীতি ও সংকোচনের ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াকে হেরিং ব্রয়ার প্রতিবর্ত ক্রিয়া (Hering-Breur Reflex) বলে। এভাবে শ্বাসক্রিয়ার ছন্দ নিয়ন্ত্রিত হয়।

নাসিকাগহ্বরের প্রাচীরে মিউকাস পর্দায় উদ্দীপনাজনিত স্নায়ুতাড়না অলফ্যাক্টরি স্নায়ু (olfactory nerve)-র মাধ্যমে হাঁচি (sneezing) প্রতিবর্তি ক্রিয়ার উদ্ভব ঘটায় এবং শ্বাসক্রিয়ায় পরিবর্তন আনে।

ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালিতে বহিরাগত কোনো পদার্থ প্রবেশ করলে এর মিউকাস পর্দা উদ্দীপ্ত হয়ে ভেগাস স্নায়ুর মাধ্যমে কাশি (caughing) প্রতিবর্তি ক্রিয়ার উদ্ভব ঘটায় এবং শ্বাসক্রিয়ায় পরিবর্তন আনে।

খাদ্য গলাধঃকরণ বাধাগ্রস্থ হলে গলবিল গাত্রের উদ্দীপনাজনিত স্নায়ুতাড়না গ্লসোফ্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ুর (glossopharyngeal nerve) মাধ্যমে গলবিলীয় বা গ্যাগ প্রতিবর্তি (pharyngeal or gag reflex) ক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শ্বাসক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।

অনেক সময় দেহের ত্বক, ভিসেরা, পেশি, অস্থিসন্ধি ইত্যাদি থেকে উদ্ভূত স্নায়ুতাড়না প্রতিবর্তি ক্রিয়ার মাধ্যমে শ্বাসক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

গ. অন্যান্য স্নায়বিক উদ্দীপনা (Other nervous stimulations) : সেরেব্রাল কর্টেক্স, মধ্যমস্তিষ্ক, হাইপোথ্যালামাস প্রভৃতি স্থানে গৃহীত স্নায়ুতাড়নাও অনেকক্ষেত্রে শ্বাসক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। সেরেব্রাল কর্টেক্সের যেসব স্থান কথা বলা, ঘ্রাণ গ্রহণ, খাদ্য চর্বণ ও গলাধঃকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সেসব স্নায়ুকেন্দ্র শ্বাসক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটানোর সূচনা ঘটায়। যেমন- কথা বলার সময় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ক্রিয়ার পরই দ্রুত প্রশ্বাস ক্রিয়া ঘটে। হাইপোথ্যালামাস আবেগজনিত স্নায়ুতাড়না দিয়ে শ্বাসক্রিয়া প্রভাবিত করে। দেহের যেকোনো স্থান থেকে উদ্ভূত যন্ত্রণাদায়ক স্নায়ুতাড়না শ্বাসক্রিয়ার হার বৃদ্ধি করে। কিন্তু অধিক যন্ত্রণাদায়ক স্নায়ুতাড়না শ্বাসক্রিয়াকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।

২. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (Chemical control):

রক্তে CO2, O2 এবং H+ আয়নের মাত্রায় শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

. অক্সিজেন : রক্তে O2 এর অভাব বা আধিক্য ঘটলে ক্যারোটিড ও অ্যাওর্টিক বডির কেমোরিসেপ্টর কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে স্নায়ুতাড়নার মাধ্যমে শাসকেন্দ্রকে উদ্দীপ্ত করে। এ উদ্দীপনা রক্ত থেকে শ্বাসকেন্দ্রকে সরাসরিও গ্রহণ করতে পারে। O2 এর অভাবজনিত উদ্দীপনা শ্বসনকেন্দ্র থেকে ফুসফুসে পরিবাহিত হয়ে শ্বসন হার বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে O2 এর আধিক্যজনিত তাড়না শ্বাসকেন্দ্রকে প্রশমিত করে এবং শ্বাসক্রিয়ার হার কমিয়ে দেয়।

খ. কার্বন ডাইঅক্সাইড : ক্যারোটিড ও অ্যাওর্টিক বডিতে অবস্থিত কেমোরিসেপ্টর কোষ ও মেডুলায় অবস্থিত কোষ রক্তের CO2-এর নাম উদ্দীপিত হয়ে শ্বাসক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। রক্তে CO2 এর চাপ বৃদ্ধি পেলে প্রথমে শ্বাসক্রিয়ার গভীরতা ও পরে শ্বাসক্রিয়ার হার বেড়ে যায়। রক্তে CO2 এর মাত্রা কমে এলে শ্বাসক্রিয়ার হারও কমে যায়।

গ. হাইড্রোজেন আয়ন : রক্তে H+ আয়নের তীব্রতার হ্রাস বৃদ্ধিতে শ্বাসক্রিয়ারও হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে । H+ আয়নের পরিবর্তনও সরাসরি শ্বাসকেন্দ্র অথবা ক্যারোটিড অ্যাওটিক বডির মাধ্যমে কাজ করে শ্বাসক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে H+ আয়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে আধিক্য অবস্থায় শ্বাসক্রিয়ার হার বেড়ে যায়। এতে CO2 বেশি মাত্রায় ফুসফুস থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়। এ অবস্থায় H+ এর তীব্রতা কমে গেলে শ্বসন হারও কমে যায়।

গ্যাসীয় (O2CO2) পরিবহন (Transport of Gases):

ফুসফুস গহ্বরের ভিতরে অ্যালভিওলাই-এর বাতাস এবং এগুলোর প্রাচীরে অবস্থিত কৈশিকনালির রক্তের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় ঘটে।

ক. অক্সিজেন পরিবহন (Transport of Oxygen)

প্রশ্বাসের মাধ্যমে আগত বাতাস ফুসফুসে পৌছালে ফুসফুসের অ্যালভিওলাইয়ে O2-এর চাপ থাকে ১০৭ mmHg অন্যদিকে, ফুসফুসের কৈশিকজালিকায় দেহ থেকে আগত রক্তে O2– চাপ থাকে ৪০ mmHg। সুতরাং ফুসফুস থেকে O2 ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুসফুসীয় ঝিল্লি ভেদ করে রক্তে প্রবেশ করে। এই ব্যাপন যতক্ষণ না রক্তে O2-এর চাপ ১০০ mmHg উপনীত হয় ততক্ষণ অব্যাহত থাকে। রক্তে অক্সিজেন দুইভাবে পরিবাহিত হয়: ভৌত দ্রবণরূপেরাসায়নিক যৌগরূপে।

i. ভৌত দ্রবণরূপে : প্রতি ১০০মি.লি. রক্তে ০.২ মি.লি. অক্সিজেন ভৌত দ্রবণরুপে পরিবাহিত হয়। দ্রবীভূত অংশই রক্তে ১০০ mmHg চাপ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তবে অংশের পরিমাণ খুব সামান্য বলে তা টিস্যুকোষে অক্সিজেন সরবরাহ কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে না। তবে অক্সিজেন ও হিমোগ্লোবিনের সংযোজন কাজে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

অ্যালভিওলাইস-এর মাধ্যমে গ্যাসীয় বিনিময়

 

  1. রাসায়নিক যৌগরূপে : O2রক্তে প্রবেশের পর লোহিত কণিকায় অবস্থিত হিমোগ্লাবিন-এর সাথে যুক্ত হয়ে অক্সি-হিমোগ্লোবিন গঠন করে। এটি একধরনের শিথিল রাসায়নিক যৌগ, যা অক্সিজেনের চাপ কমে গেলে পুনরায় বিযুক্ত হয়। এ সংযোজন রক্তে অক্সিজেনের দ্রবীভূত অংশের চাপের উপর নির্ভরশীল। এ চাপ যত বাড়ে হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে তত বেশি সংযুক্ত হয়।

Hb4+4O24HbO2 [Hb= হিমোগ্লোবিন ]

খ. কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবহন (Transport of Carbon dioxide):

শর্করা জারণের সময় কোষে CO2 সৃষ্টি হয়। এই CO2 দেহের জন্য ক্ষতিকর। কোষ থেকে CO2 রক্তে পরিবাহিত হয়ে ফুসফুসে পৌঁছায় এবং ফুসফুস থেকে বায়ুতে মুক্ত হয়। নিচে বর্ণিত তিনটি ভিন্ন পদ্ধতিতে CO2 রক্তে পরিবাহিত হয়।

  • ভৌত দ্রবণরূপে : কিছু পরিমাণ (৫%) CO2 রক্তরসের পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড গঠন করে।

 H2O + CO2 → H2CO3 (কার্বনিক এসিড)

এ বিক্রিয়ায় কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ এনজাইম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

প্রতি হাজার CO2 অণুর মধ্যে মাত্র এক অণু H2CO3 রূপে দ্রবণে উপস্থিত থাকে। সুতরাং, CO2-এর খুব সামান্য অংশই H2CO3 রূপে পরিবাহিত হয়।

  • কার্বামিনো যৌগরুপে :

টিস্যুকোষ থেকে রক্তের প্লাজমায় আগত CO2 -এর কিছু অংশ লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। লোহিত কণিকার মধ্যে যে হিমোগ্লোবিন থাকে তার গ্লোবিন (প্রোটিন) অংশের অ্যামিনো গ্রুপের-(NH2) সাথে CO2 যুক্ত হয়ে কার্বামিনোহিমোগ্লোবিন যৌগ গঠন করে।

কার্বামিনোহিমোগ্লোবিন যৌগ গঠন

 

CO2-এর একাংশ প্লাজমা প্রোটিনের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে কার্বামিনোপ্রোটিন গঠন করে।

মোট CO 2-এর শতকরা ২৭ ভাগ কার্বামিনো যৌগরূপে পরিবাহিত হয়। প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে এর পরিমাণ ৩ মি.লি. যার ২ মি.লি কাৰ্বামিনোহিমোগ্লোবিনরূপে এবং ১ মি.লি কার্বামিনোপ্রোটিনরূপে পরিবাহিত হয়।

iii. বাইকার্বোনেট যৌগরূপে : 

CO2-এর বেশির ভাগই (৬৫%) রক্তে বাইকার্বোনেটরূপে পরিবাহিত হয়। এটি- (১) NaHCO3– রূপে প্লাজমার মাধ্যমে এবং (২) KHCO3 -রূপে লোহিত কণিকার মাধ্যমে পরিবাহিত হয়।

টিস্যুরস থেকে CO2 প্রথমে প্লাজমায় ও পরে লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে লোহিত কণিকার মধ্যে CO2 পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড (H2CO3) উৎপন্ন করে। রক্তরসে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ অনুপস্থিত থাকায় রক্তরসে খুব কম মাত্রায় কার্বনিক এসিড উৎপন্ন হয়।

প্লাজমা এবং এরিথ্রোসাইটের মাধ্যমে co2 পরিবহন

 

লোহিত কণিকায় উৎপন্ন H2CO3 বিশ্লিষ্ট হয়ে H+HCO3 আয়নে পরিণত হয়। লোহিত কণিকায় বেশি মাত্রায় HCO3 সঞ্চিত হওয়ায় এর ঘনত্ব প্লাজমার তুলনায় বেশি হয়।

আয়ন লোহিত কণিকা থেকে প্লাজমায় পরিব্যাপ্ত (diffuse) হয় এবং পাজমার Na+ আয়নের সাথে মিলে NaHCO3 উৎপন্ন করে। লাহিত কণিকার মধ্যে K+ আয়নের সাথে HCO3 বিক্রিয়া করে KHCO3 এ পরিণত হয়।

লোহিত কণিকা থেকে প্লাজমায় HCO3 আয়ন আগমনের সাথে সমতা রেখে প্লাজমা থেকে CI লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে এবং লোহিত কণিকায় K+  আয়নের সাথে যুক্ত হয়ে KCI গঠন করে। লোহিত কণিকা থেকে HCO3 আয়ন বেরিয়ে আসায় ঋণাত্মক আয়নের যে ঘাটতি হয় প্লাজমার ক্লোরাইড (CI) আয়ন লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে সে ঘাটতি পূরণ করে। একে ক্লোরাইড শিফট (chloride shift) বলে। এর প্রথম বর্ণনাকারী জার্মান শারীরবৃত্ত্ববিদ হার্টগ জ্যাকব হ্যামবার্গার (Hartog Jacob Hamburger)-এর নাম অনুসারে ক্লোরাইড শিফটকে হ্যামবার্গার শিফটও বলা হয়।

বহিঃশ্বসন ও অন্তঃশ্বসনের পার্থক্য(difference between exhalation and inhalation):

১. বহিঃশ্বসন একটি ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়া। ১. অন্তঃশ্বসন একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া।
২. এটি ফুসফুসের অভ্যন্তরে সম্পন্ন হয়। ২. এটি সকল কোষ অভ্যন্তরে সাইটোপ্লাজম ও মাইটোকন্ড্রিয়াতে এবং রক্তে সম্পন্ন হয়।
৩. বহিঃশ্বসনে পরিবেশ থেকে O2 ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং CO2 ফুসফুস থেকে বাইরের পরিবেশে মুক্ত হয়। ৩. অন্তঃশ্বসনে কোষ মধ্যস্থ খাদ্যসার O2 দ্বারা জারিত হয়ে শক্তি, পানি ও CO2 তৈরি করে।
৪. বহিঃশ্বসনের উপপর্যায়গুলো হলো- শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগ। ৪. অন্তঃশ্বসনের উপপর্যায়গুলো হলো- গ্লাইকোলাইসিস, ক্রেবস চক্র ও গ্যাস পরিবহন।
৫. বহিঃশ্বসনে শক্তি উৎপন্ন হয় না। ৫. অন্তঃশ্বসনে শক্তি উৎপন্ন হয়।
৬. বহিঃশ্বসনে এনজাইমের ভূমিকা নেই। ৬. অন্তঃশ্বসনে এনজাইম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শ্বসনে শ্বাসরঞ্জকের ভূমিকা (Role of Respiratory Pigments during Respiration):

হিমোগ্লোবিন হচ্ছে মেরুদণ্ডী প্রাণীর রক্তের লোহিত কণিকায় এবং অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণীর প্লাজমায় বিস্তৃত লাল বর্ণের প্রোটিনধর্মী অক্সিজেনবাহী শ্বাসরঞ্জক। লোহিত রক্তকণিকার প্রধান প্রোটিন হচ্ছে হিমোগ্লোবিনএর বর্ণের জন্যই লোহিত কণিকা লাল দেখায় এবং লোহিত কণিকার সংখ্যাধিক্যের কারণে রক্ত লাল দেখায়। হিমোগ্লোবিন শ্বসন গ্যাস অক্সিজেন পরিবহনে প্রধান ভূমিকা পালন করে, কিছু পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইডও বহন করে। চারটি একক নিয়ে গঠিত হিমোগ্লোবিন একটি গোল অণু। এর প্রতিটি একক পলিপেপটাইড জাতীয় প্রোটিন গ্লোবিন (globin) এবং লৌহগঠিত হিম (heme) নিয়ে গঠিত। রক্তে হিম ও গ্লোবিন ১:২৫ অনুপাতে উপস্থিত থাকে। হিমের ৩৩.৩৩% লৌহ (Fe)। পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমগ্র রক্তে মাত্র ৪-৫ গ্রাম লৌহ থাকে।

হিমোগ্লোবিনে অক্সিজেন পরিবহন

 

  • অক্সিজেন পরিবহন :

শ্বসনের সময় অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুসফুস থেকে রক্তে প্রবেশ করে। রক্তে প্রবিষ্ট সমস্ত অক্সিজেনই মুক্ত অবস্থায় থাকে না। এর এক বড় অংশ লোহিত কণিকার হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন (oxyhaemoglobin) নামে অস্থায়ী যৌগ গঠন করে। এ যৌগ গঠন রক্তরসে (প্লাজমায়) অক্সিজেনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। রক্তরসে যত বেশি অক্সিজেন দ্রবীভূত হবে তার সাথে সংগতি রেখে অক্সিহিমোগ্লোবিন যৌগ উৎপন্ন হবে। অন্যদিকে, অক্সিজেনের পরিমাণ যে হারে কমে যাবে যৌগ সে হারে ভেঙে যাবে এবং অক্সিজেন মুক্ত হয়ে রক্তরসে প্রবেশ করবে। প্রতিটি হিমোগ্লোবিনে চারটি হিম অংশ থাকায় এর চারটি ফেরাস অণু অক্সিজেন যুক্ত করতে পারে।

  • কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবহন :

CO2 হিমোগ্লোবিনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বামিনো হিমোগ্লোবিন নামক অস্হায়ী যৌগ গঠন করে। কার্বামিনো হিমোগ্লোবিন-সমৃদ্ধ রক্ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে হৃৎপিন্ড হয়ে পরিশোধনের জন্য ফুসফুসে গমন করে।

দেহে রক্ত পরিবহনের সময় বেশ কিছু পরিমাণ অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তরস থেকে স্বল্প অক্সিজেনযুক্ত টিস্যুরসে চলে যায়। ফলে রক্তরসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। হিমোগ্লোবিন তখন তার সাথে যুক্ত অক্সিজেন ছড়াতে শুরু করে। এভাবে অক্সিজেন প্রথমে রক্তরসে ও পরে টিস্যুরসে চলে যায়।