শক্তি, পারমাণবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস
- কোনো বস্তু বা ব্যবস্থার কাজ করার সামর্থ্যকে শক্তি বলে। শক্তি একটি স্কেলার রাশি।
- M.K.S পদ্ধতিতে শক্তির পরম একক– জুল
- C.G.S. পদ্ধতিতে শক্তির পরম একক– আর্গ
- 1 জুল = 10^7 আর্গ
শক্তির প্রধান উৎস
- কোনো স্থিতিশীল বস্তু তার স্থিতির জন্য কাজ করার যে সামর্থ্য অর্জন করে তাকে স্থিতিশক্তি বলে। একটি ঘড়িতে যে দম দেয়া হয় তাতে সঞ্চিত শক্তি স্থিতিশক্তি। স্থিতিশক্তিকে বিভবশক্তি নামে অভিহিত করা হয়। বিভব শক্তি, []katex]E_p=mgh[/katex]
- কোনো গতিশীল বস্তু তার গতির জন্য কাজ করার যে সামর্থ্য অর্জন করে তাকে গতিশক্তি বলে।
- এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো যন্ত্র এক ঘণ্টা কাজ করলে যে শক্তি ব্যয় হয়, তাকে এক কিলোওয়াট–ঘণ্টা বলে।
- বিদ্যুৎশক্তি পরিমাপের ব্যবহারিক একক কিলোওয়াট–ঘণ্টা।
- 1 কিলোওয়াট = 1000 ওয়াট = 10^3 ওয়াট
- 1 মেগাওয়াট = 1000000 ওয়াট = 10^6 ওয়াট
শক্তির নিত্যতা বিধি
শক্তি অবিনশ্বর, এর সৃষ্টি বা বিনাশ নেই। শক্তি কেবল একরূপ থেকে অন্য এক বা একাধিক রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়।
শক্তির রূপান্তর:
- পানির গতিশক্তির সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন: যান্ত্রিক শক্তি → বিদ্যুৎ শক্তি। জেনারেটরের সাহায্যে এরূপ শক্তির রূপান্তর করা হয়।
- বৈদ্যুতিক পাখায় বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে পাখা ঘুরানো: বিদ্যুৎ শক্তি → যান্ত্রিক শক্তি। মোটরের সাহায্যে এরূপ শক্তির রূপান্তর করা হয়।
- ফটোগ্রাফিক ফিল্মের উপর আলোকসম্পাত করে রাসায়নিক ক্রিয়ায় আলোকচিত্র তৈরি: আলোক শক্তি→ রাসায়নিক শক্তি।
- দুই হাতের তালু পরস্পরের সাথে ঘষলে তাপ উৎপন্ন হয়: যান্ত্রিক শক্তি → তাপ শক্তি।
- ফটো–ইলেকট্রিক কোষে আলো ফেলে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি: আলোক শক্তি → বিদ্যুৎ শক্তি।
- বৈদ্যুতিক ঘণ্টা ও টেলিফোন: বিদ্যুৎশক্তি → শব্দ শক্তি। টেলিফোনের লাইনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় তড়িৎশক্তি।
- কয়লা পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়: রাসায়নিক শক্তি → তাপ শক্তি।
- কলমের খালি মুখে ফুঁ দিলে: এ ক্ষেত্রে শব্দ উৎপন্ন হয় অর্থাৎ যান্ত্রিকশক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
- বৈদ্যুতিক বাল্বের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ চললে: বৈদ্যুতিক বাল্বের ফিলামেন্টের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের ফলে ফিলামেন্ট উত্তপ্ত হয়ে আলো প্রদান করে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ শক্তি প্রথমে তাপশক্তিতে এবং পরে আলোকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
- ফটোগ্রাফিক কাগজে আলো পড়লে: ফটোগ্রাফিক ফিল্মের উপর আলো ফেলে রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে চিত্র তৈরি করা হয়। অর্থাৎ এখানে আলোক শক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
- টেলিফোনে কথা শোনার সময়: টেলিফোনের প্রেরক যন্ত্রে শব্দ শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। আবার টেলিফোনের গ্রাহকযন্ত্রে তড়িৎ শক্তিকে শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়।
- বৈদ্যুতিক হিটারে: বৈদ্যুতিক হিটারে বিদ্যুৎ সংযোগ করে উত্তাপ পাওয়া যায় এখানে তড়িৎ শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
- সরল তড়িৎ কোষে: সরল তড়িৎকোষে তরল রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। এখানে রাসায়নিক শক্তি তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
- পারমাণবিক সাবমেরিন: পারমাণবিক সাবমেরিনে জ্বালানি হিসেবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে সাবমেরিন চালনা করা হয়। এখানে পারমাণবিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
- কোনো যন্ত্রের কর্মদক্ষতা 90% বলতে বুঝায় এই যন্ত্রে 100J শক্তি দেওয়া হলে যন্ত্র থেকে 90J কার্যকর শক্তি পাওয়া যাবে।
- যে শক্তি বারবার ব্যবহার করা যায় এবং ব্যবহারের পর নিঃশেষ হয়ে যায় না অর্থাৎ একবার ব্যবহারের পর যে শক্তি পুনরায় ব্যবহারের সুযোগ থাকে তাকে নবায়নযোগ্য শক্তি বলে।
- নবায়নযোগ্য শক্তির অপর নাম “ক্লিন এনার্জি‘ বা গ্রিন এনার্জি।
- সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতি হতে নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়া যায়।
- সূর্য থেকে বিকীর্ণ যে শক্তি তাপশক্তি ও আলোকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে সৌরজগতে এবং সৌরজগতের বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে তাকে সৌরশক্তি বলে। সূর্য হতে ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। সূর্য হতে উৎপন্ন সৌর শক্তির সবটাই পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে পৌঁছায় না। আপতিত সৌরশক্তির কেবল ৪৫ শতাংশ সৌরশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠে শোষিত হয়।
- বর্তমানে সোলার প্যানেলের সাহায্যে সৌরশক্তিকে আবদ্ধ করে– (ক) রান্নাবান্না, (খ) ঘরের বাতি ও ফ্যান, (গ) সেচের পাম্প, (ঘ) ঘড়ি, (ঙ) ক্যালকুলেটর, (চ) রেডিও, টেলিভিশন, এমনকি গাড়ি পর্যন্ত চালানো হচ্ছে।
- শীতের দেশে গ্রিন হাউসে ফসল, তরিতরকারী চাষ করতে সৌরশক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
- গাড়ি ও কলকারখানায় ফসিল ফুয়েল ব্যবহারে ঢাকা শহর একটি দূষিত বাতাসের শহরে পরিণত হয়েছে। এ দূষণ বন্ধ করতে বিকল্প সৌরশক্তির ব্যবহার করা যায়।
- এতে একদিকে পরিবেশও দূষণমুক্ত থাকবে, অন্যদিকে সৌরশক্তি উৎপাদন অনেক সস্তা বিধায় তেল আমদানিজনিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় রোধ হবে।
পারমাণবিক শক্তি
পরমাণুর শক্তি বলতে পারমাণবিক শক্তি বোঝায়। পরমাণুর নিউক্লিইয়াসই পারমাণবিক শক্তির উৎস। যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পরমাণুর মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে ব্যবহারযোগ্য শক্তি পাওয়া যায় তাকে পারমাণবিক বিক্রিয়া বলে। পারমাণবিক শক্তির অপর নাম হল নিউক্লিয় শক্তি। পারমাণবিক শক্তি মূলত দুই ভাবে পাওয়া যায়, যথা-
১. নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে
২. নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে
নিউক্লিয়ার ফিশন
যে প্রক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিশ্লিষ্ট হয়ে প্রায় সমান ভরের দুটি নিউক্লিয়াস তৈরি করে এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করে তাকে নিউক্লিয়ার ফিশন বলে। জার্মান বিজ্ঞানী অটোহ্যান ১৯৩৯ সালে এটি আবিষ্কার করেন। নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা হয়। এতে জ্বালানি হিসেবে ইউরোনিয়াম (U-235) ব্যবহৃত হয়।
নিউক্লিয়ার ফিউশন
ফিশন বিক্রিয়ার উল্টোটি হল ফিউশন বিক্রিয়া। যেখানে দুটি নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি করে। নক্ষত্রে যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর তাপ ও শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে এবং যা মহাবিশ্ব এ সমস্ত শক্তির উৎস, তা হল হাইড্রোজেন পরমাণুরর ফিউশানিত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুর গঠন বিক্রিয়া । সূর্যে যে প্রতিনিয়ত তাপ উৎপন্ন হচ্ছে তা হলো এই ফিউশন বিক্রিয়ার প্রভাব। এই বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা হয়। হাইড্রোজেন বোমা পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী।
- যে শক্তি ব্যবহারে পুনঃব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকে না তাকে অনবায়নযোগ্য শক্তি বলে। এ শক্তি ব্যবহারে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ যেমন– কার্বন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি উৎপন্ন হয়ে বাতাসে মিশে যায়। অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎস: কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি।
- ভূমিকম্প বা অন্য কোনো কারণে জীবদেহ মাটি চাপা পড়ে লক্ষ লক্ষ বছর পর পৃথিবীর অভ্যন্তরের প্রচণ্ড চাপ ও তাপের প্রভাবে এটি কয়লা, তেল, গ্যাসে পরিণত হয়। এদের জীবাশ্ম জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েল বলা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি হলো কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি।
- বিভিন্ন সংখ্যক কার্বন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগের মিশ্রণ হলো পেট্রোলিয়াম। পেট্রো অর্থ শিলা এবং অলিয়াম অর্থ তেল।
- পেট্রোলিয়ামের উপাদানগুলো হচ্ছে পেট্রোল, কেরোসিন, ডিজেল, লুব্রিকেটিং তেল এবং বিটুমিন।
- পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন– এ তিনটিই পেট্রোলিয়ামের আংশিক পাতনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। পেট্রোলিয়ামের আংশিক পাতনে প্রথমে কেরোসিন ও পরে ডিজেল পাওয়া যায়। এদের মধ্যে পেট্রোলের দহনক্ষমতা বেশি এবং ডিজেলের আপেক্ষিক গুরুত্ব অধিক। পেট্রোলের অপর নাম গ্যাসোলিন। এটি পানির চেয়ে হালকা। তাই পানি দ্বারা পেট্রোলের আগুন নেভানো যায় না। এটি পানির সাথে মিশে না অর্থাৎ পানির উপর ভেসে থাকে।
- অশোধিত পেট্রোলিয়াম থেকে আংশিক পাতনের সাহায্যে শোধিত একপ্রকার মিশ্র জ্বালানি হলো জেট ফুয়েল।
- প্রায় ২০%-৩০% ইথাইল অ্যালকোহলের সাথে পেট্রোল এবং অন্য কোন দাহ্য তরল পদার্থ যেমন – ইথার, বেনজিন ইত্যাদি মিশিয়ে পাওয়ার অ্যালকোহল প্রস্তুত করা হয়। মোটর যানের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়।
- তাপ উৎপাদনক্ষম উদ্ভিদ জীবাশ্ম হলো কয়লা। প্রকৃতি বা খনিতে অকেলাসিত বা দানাহীনরূপে যে কার্বন পাওয়া যায়, তাকে খনিজ কয়লা বলে।
- কয়লা চার প্রকার:
-
- আনথ্রাসাইট
- বিটুমিনাস
- লিগনাইট
- পিট
- বায়ুশূন্য আবদ্ধ পাত্রে প্রাণীর হাড় ও রক্ত রেখে তাপ প্রয়োগ করলে বিধ্বংসী পাতনের ফলে যে কয়লা উৎপন্ন হয় তাকে প্রাণিজ কয়লা বলে।
- প্রাণীদেহের চর্বিযুক্ত হাড়ের বিধ্বংসী পাতনের ফলে যে কয়লা উৎপন্ন হয় তাকে অস্থিজ কয়লা বলে।
- কার্বন একটি বহুরূপী মৌল। এটি কখনও হীরকরূপে, আবার কখনও কয়লারূপে অবস্থান করে। কার্বনের বিভিন্ন রূপভেদগুলো দেখতে বিভিন্ন হলেও কয়লাকে কালো হীরা বা ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলা হয়। তারা প্রত্যেকেই আসলে কার্বন ছাড়া আর কিছুই নয়।
- কয়লার বিধ্বংসী পাতনের ফলে আলকাতরা, কোল গ্যাস ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। আলকাতরা হলো পেট্রোলিয়ামের অবশেষ।
- খনিজ কয়লার বিধ্বংসী পাতনের ফলে নির্গত উদ্বায়ী পদার্থের অঘনীভূত অংশকে পানি ও ঘন সালফিউরিক এসিড দ্বারা ধৌত করার পর যে গ্যাসীয় অংশ পাওয়া যায়, তাকে কোলগ্যাস বলে।
- ভূ–পৃষ্ঠ হতে বিভিন্ন গভীরতায় শিলাস্তরের মধ্যে সঞ্চিত পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেলের উপরিভাগে পৃথকভাগে উচ্চচাপে সঞ্চিত গ্যাসকে প্রাকৃতিক গ্যাস বলে।
- প্রাকৃতিক গ্যাস এক ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি। এতে সাধারণত মিথেন, ইথেন, প্রোপেন এবং আরো কিছু হাইড্রোকার্বন থাকে। আমাদের দেশে যে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায় তার ৯৫–৯৯ শতাংশ মিথেন। এটি অত্যন্ত উন্নতমানের প্রাকৃতিক গ্যাস। এটি বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের প্রধান কাঁচামাল। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসকে কমপ্রেস বা সংকুচিত করে বা সিএনজিতে রূপান্তরিত করে গাড়ি চালানো হচ্ছে।
- উচ্চচাপে গ্যাসকে তরলে পরিণত করে রাখার পদ্ধতিকে CNG বলে।
- কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (CNG) হচ্ছে এক ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি যা পেট্রোল, ডিজেল কিংবা প্রোপেনের (LPG) পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়।
- আবর্জনা বা পচা পানি থেকে উৎপন্ন বায়োগ্যাসের (জৈব গ্যাস) সাথে CNG মিশ্রিত করা যায়।
- বায়োগ্যাসের প্রধান কাঁচামাল গোবর ও পানি।
- বায়োগ্যাস তৈরির পর যে অবশেষ থাকে তা সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বায়োগ্যাস জীবাশ্ম জ্বালানি নয়।
- প্রাণীর মল মূত্রে ইউরিয়া থাকে। ইউরিয়া ফারমেন্টেড হয়ে মিথেন উৎপন্ন হয়।