পাতন ও শিখা পরীক্ষা (Distillation & Flame Test)
কেলাসন (Crystallization)
যে পদ্ধতিতে কোনো কঠিন পদার্থের দ্রবণকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রায় সম্পৃক্ত করে ধীরে ধীরে শীতল করে দ্রব কেলাসিত করা হয় তাকে কেলাসন পদ্ধতি বলে। কঠিন দ্রবের দ্রাব্যতা তাপমাত্রার সাথে সম্পর্কিত হলে এর উপর ভিত্তি করে কেলাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তবে নমুনাতে একাধিক লবণ মিশ্রিত থাকলে এদেরকে দ্রাব্যতা অনুসারে কেলাস আকারে দ্রবণ থেকে পৃথক করা হয়। এ পদ্ধতিকে আংশিক কেলাসন বলা হয়। তবে কোনো কোনো সময় কেলাসন দ্রুত করার জন্য সমআয়ন প্রভাব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ।
কেলাসন প্রক্রিয়াতে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রস্তুত সম্পৃক্ত দ্রবণকে ধীরে ধীরে শীতল করা হলে কেলাসের আকৃতি অপেক্ষাকৃত বড় এবং স্থায়ী হয়। কিন্তু দ্রুত শীতলীকরণ করলে কেলাসের আকার ছােট হয় এবং তা অস্থায়ী হয়।
তাছাড়া দ্রবণে সামান্য পরিমাপে অপদ্রব্য থাকে। দ্রুত শীতল করলে এসব অপদ্রব্য কেলাসের ভেতর আটকে পড়ায় প্রাপ্ত কেলাস অবিশুদ্ধ হয় কিন্তু ধীরে ধীরে শীতল করা হলে প্রাপ্ত কেলাস অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ হয়।
আংশিক পাতন (Fractional Distillation)
কোনো তরল মিশ্রণে উপাদানসমূহের স্কুটনাঙ্কের ব্যবধান 40°C এর কম হলে তাদেরকে পাতন ফ্লাস্ক এবং শীতক এর মাঝখানে অংশ কলাম ব্যবহার করে উপাদানগুলোকে পাতনের সাহায্যে বিশুদ্ধভাবে পৃথক করার পদ্ধতিকে আংশিক পাতন (Fractional Distillation) বলে । এর মূলনীতি হল- তরল অপেক্ষা বাষ্পে অধিক উদ্বায়ী উপাদানের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেশি থাকে। পেট্রোলিয়াম থেকে বিভিন্ন ধরনের উপাদান পৃথকীকরণে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।উদাহরণঃ রেকটিফাইড স্পিরিট ও আলকাতরার আংশিক পাতন ইত্যাদি।
বাষ্প পাতন (Steam Distillation)
যেসব কঠিন ও তরল জৈব যৌগ পানিতে অদ্রবণীয় এবং ফুটন্ত পানিতে বিযোজিত হয় না কিন্তু উত্তপ্ত জলীয় বাষ্প বা steam এ সহজেই উদ্বায়ী হয় যে তাদেরকে অনুদ্বায়ী ভেজাল পদার্থের মিশ্রণ হতে জলীয় বাষ্প বা steam প্রবাহ দ্বারা পৃথক করার পদ্ধতিকে বাষ্প পাতন বা steam distillation বলা হয়।
উদাহরণ: ইউক্যালিপটাস পাতা থেকে তেল নিষ্কাশন, লেমনগ্রাস থেকে সাইট্রাইল নামক সুগন্ধী নিষ্কাশন।
নিম্নচাপে পাতন বা অনুপ্রেস/ অনুপ্রেস পাতন(Low Pressure Distillation)
যেসব জৈব যৌগ এদের স্বাভাবিক স্ফুটনাঙ্কের তাপমাত্রায় বিযোজিত হয়ে যায়। সেসব তরল পদার্থকে অপেক্ষাকৃত নিম্ন তাপমাত্রায় ও নিম্নচাপে পাতন করা হয়। ফলে এরা বিযোজিত হয় না। এরূপ তরল পদার্থের উপরিস্থিত বায়ুচাপ কমিয়ে এর স্বাভাবিক স্ফুটনাঙ্ক হতে নিম্নতর তাপমাত্রায় একে পাতন করে এর কোনো মিশ্রণ থেকে পৃথক করার পদ্ধতিকে নিম্নচাপের পাতন বলে।
দ্রাবক নিষ্কাশণ পদ্ধতি (Solvent Extraction Process)
যে প্রক্রিয়ায় কোনো দ্রাবকে একাধিক পদার্থের মিশ্রণ থেকে কোনো উপযুক্ত দ্রাবক ব্যবহার করে মিশ্রণের কোনো উপাদানকে পৃথক করার পদ্ধতিকে দ্রাবক নিষ্কাশণ পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতির মূলনীতি হল পোলার যৌগ পোলার দ্রাবকে এবং অপোলার যৌগ অপোলার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়। এই পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১। জলীয় দ্রবণ বা তরল দ্রাবকে থেকে নিষ্কাশণ
২। কঠিন পদার্থ হতে নিষ্কাশণ
কঠিন পদার্থ হতে নিষ্কাশণ পদ্ধতিকে সক্সলেট নিষ্কাশণ পদ্ধতি (Soxlet Extraction) ও বলা হয়। এ পদ্ধতিতে গাছের পাতা, বাকল, শস্যবীজ হতে জৈব যৌগ নিষ্কাশন করা হয়। জলীয় দ্রবণ থেকে কোনো জৈব যৌগ নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে জলীয় দ্রবণে অবস্থানরত জৈব যৌগের মধ্যে একটি অপোলার দ্রাবক ইথার যোগ করে পৃথকীকরণ ফানেলে নিয়ে ঝাঁকানো হয়। এতে জৈব যৌগটি জলীয় স্তর ছেড়ে ইথার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়ে যায় এবং দুটি আলাদা স্তর তৈরি হয়। স্তর দুটিকে পরস্পর থেকে পৃথক করে জৈব যৌগটি আলাদা করা হয়।
জৈব দ্রাবকে দ্রবীভূত জৈব পদার্থকেও দ্রাবক নিষ্কাশন পদ্ধতির মাধ্যমে আলাদা করা যায়। যেমন: ক্লোরোফর্মে দ্রবীভূত অ্যালকোহল দ্রাবক নিষ্কাশনের সাহায্যে পৃথক করা যায়।
শিখা পরীক্ষা (Flame Test)
কোনো কোনো ধাতব আয়নের উপস্থিতি শিখা পরীক্ষার সাহায্যে নিশ্চিত করা যায়। এক্ষেত্রে একটি প্লাটিনাম তারের অগ্রভাগ গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক এসিডে সিক্ত করে তারের অগ্রভাগে প্রদত্ত নমুনা লবণ নিয়ে একে বুনসেন বার্নারের অনুজ্জ্বল শিখায় উত্তপ্ত করা হয়। এতে কতগুলো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিখা দেখা যায় যার মাধ্যমে ধাতব আয়নকে শণাক্ত করা যায় ।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিখার বর্ণ খালি চোখে বোঝা যায় না। যেমন- নমুনা লবণের সাথে একাধিক ধাতব আয়ন থাকলে একদম অন্যটির সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। এ অসুবিধা দূর করার জন্য কোবাল্ট কাচের মধ্য দিয়ে শিখার বর্ণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। কারণ এক্ষেত্রে কোবাল্ট কাচ কিছু কিছু বর্ণকে শোষণ করতে পারে। প্রত্যেক মৌলের ইলেকট্রন সংখ্যা এবং ইলেকট্রন বিন্যাস ভিন্ন তাছাড়া শক্তিস্তর সমূহের শক্তির পার্থক্যও ভিন্ন, তাই প্রত্যেক মৌল শিখা পরীক্ষায় ভিন্ন বর্ণ দেখায়।
কয়েকটি মৌলের শিখা পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বর্ণ দেখাতে পারবে। যা নিচের চার্টে প্রদত্ত হলো-
প্রশ্ন: শিখা পরীক্ষায় গাঢ় HCl ব্যবহার করা হয় কেন?
উত্তর: আমরা জানি, ধাতব লবণসমূহ (KCl, NaCl, CaCO_3, CuSO_4) আয়নিক প্রকৃতির। এই লবণগুলো সাধারণত উদ্বায়ী প্রকৃতির হলেও এগুলোর মধ্যে ক্লোরাইড লবণ (KCl, NaCl, CaCl_2) তুলনামূলক অধিক উদ্বায়ী। তাই কোনো কম উদ্বায়ী সালফেট, ফসফেট এবং কার্বনেট লবণের শিখা পরীক্ষা করতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন হয় এবং অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে এসব লবণকে অধিক উদ্বায়ী লবণে রূপান্তরের জন্য গাঢ় HCl প্লাটিনাম তার দণ্ডের মাথায় ভিজিয়ে সেসব লবণে ডোবালে তা সঙ্গে সঙ্গে HCl এর সাথে বিক্রিয়া করে ক্লোরাইডের লবণে রূপান্তর হয়।
প্রশ্ন: শিখা পরীক্ষায় Pt তার ব্যবহার করা হয় কেন?
উত্তর: Pt একটি উচ্চ গলনাঙ্ক বিশিষ্ট ধাতু। এর গলনাঙ্ক প্রায়(1770°c) আমরা ল্যাবে স্পিরিট ল্যাম্প বা বুনসেন বার্নার এর শিখায় লবণের প্রাথমিক অনুমানের জন্য শিখা পরীক্ষা করি। এখানে Pt তাঁর তারের মাথায় HCl এ ডুবিয়ে লবণ লাগিয়ে শিখা পরীক্ষা করি। যে তাপমাত্রায় লবণ গলে বিভিন্ন বর্ণ সৃষ্টি করে তার অনেক বেশি তাপমাত্রায় Pt গলে, তাই শিখা পরীক্ষায় Pt তার ব্যবহার নিরাপদ। তাছাড়া Pt ল্যাবে থাকা H_2SO_4, HCl, NH_4Cl, NaCl, CaSO_4 ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থের সাথে কোনো বিক্রিয়াও করে না। এটি কিছুটা নিষ্ক্রিয় প্রকৃতির ধাতু। তাই শিখা পরীক্ষায় Pt তার দণ্ড সবচেয়ে নিরাপদ।
প্রশ্ন: Berylium (Be) এবং Magnesium (Mg) শিখা পরীক্ষায় কোনো বর্ণ দেখায় না কেন?
উত্তর: Berylium এবং Magnesium পরমাণুর আকার তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ায় এদের নিউক্লিয়াস দ্বারা বহিঃস্তরের ইলেক্ট্রন দৃঢ়ভাবে আকৃষ্ট থাকে। তাই বুনসেন বার্নারের শিখার তাপে উত্তপ্ত করলে এদের বহিঃস্তরের ইলেক্ট্রন উচ্চ শক্তিস্তরে ধাপান্তরিত হয় না। অর্থাৎ এদের বহিঃস্তরের ইলেক্ট্রনকে ধাপান্তর করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন বুনসেন বার্নারের শিখার তাপ হতে পাওয়া যায় না। তাই এরা শিখা পরীক্ষায় কোনো বর্ণ সৃষ্টি করে না।