10 Minute School
Log in

স্থির বিদ্যুৎ | Static Electricity

কোনো প্রক্রিয়ায় পরমানুর এক বা একাধিক ইলেকট্রন আলাদা করা গেলে যে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয় তাকে স্থির বিদ্যুৎ বলে। বন্ধুরা, তোমরা জেনে অবাক হবে যে, আমাদের আশেপাশে আমরা নানাভাবে এই স্থির বিদ্যুতের উদাহরণ দেখতে পাই। যেমনঃ ছোটো শিশু কার্পেটে গড়াগড়ি দেয়ার সময় তার সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার পেছনে এই স্থির বিদ্যুৎ দায়ী। তাছাড়া, চিরুনি দিয়ে চুল আচড়ানোর পর সেই চিরুনিরকে ছোট ছোট কাগজেরর টুকরার কাছে আনা হলে তা চিরুনির দিকে ছুটে যায়। এর জন্যও স্থির বিদ্যুৎ দায়ী। বন্ধুরা, বলে রাখা ভালো এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা যা যা শিখবো তা হলোঃ

স্থির বিদ্যুৎ Static Electricity

 

 

  • আধান বা চার্জের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য।
  • ঘর্ষণ ও আবেশের ফলে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি।
  • ইলেক্ট্রোস্কোপ সম্পর্কে বিস্তারিত।
  • কুলম্বের সূত্রের ব্যাপারে জানবো।
  • তড়িৎক্ষেত্র সৃষ্টির কারণ ও তড়িৎ বলরেখা আঁকতে পারবো।
  • ইলেক্ট্রিক পটেনশিয়াল, বিভব পার্থক্য ও ধারকত্বের ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো।
  • স্থির বিদ্যুতের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হবো।

আধান বা চার্জ (Charge)

পদার্থ সৃষ্টিকারী মৌলিক কণাগুলোর মৌলিক ও বৈশিষ্ট্যমূলক Intrinsic ধর্মই হচ্ছে আধান বা চার্জ। এ ধর্মের জন্য পদার্থ তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নিজেও তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র উৎপন্ন করে। কিন্তু বন্ধুরা প্রশ্ন হলো, কোনো পদার্থ আয়নিত হয় কিভাবে?

কোনোভাবে পদার্থের পরমানুর একটি বা দুটি ইলেকট্রন সরিয়ে নিলে তা ধনাত্বক চার্জে চার্জিত হয় এবং কোনোভাবে পরমানুতে একটি বা দুটি ইলেকট্রন যুক্ত হলে তা ধনাত্বক আধানে আহিত হয়। এভাবে, চার্জ বা আধানের সৃষ্টি হয়।

বিদ্যুৎ সুপরিবাহী (Electric conductor)

যে পদার্থের মধ্যে তড়িৎ তথা আধান বা ইলেকট্রন খুব সহজে চলাচল করতে পারে, তাকে বিদ্যুৎ সুপরিবাহী বলে। এ ধরনের পদার্থের শেষ কক্ষপথের ইলেকট্রন প্রায় মুক্ত অবস্থায় থাকে অর্থাৎ যোজ্যতার ব্যান্ড পরিবহন ব্যান্ডের সাথে প্রায় মিলে যায় যে কারণে এরকম পদার্থে ইলেকটন খুব সহজে চলাচল করতে পারে। যেমনঃ সোনা, তামা, রূপা।

বিদ্যুৎ অপরিবাহী (Electric non-conductive)

যে পদার্থের মধ্য দিয়ে তড়িৎ তথা আধান বা ইলেকট্রন ছোটাছুটি করতে পারে না তাকে বিদ্যুৎ অপরিবাহী বলে। যেমনঃ কাঠ, প্লাস্টিক, কাচ, রাবার। তোমরা জেনে অবাক হবে যে, কোনো ব্যাক্তি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে তাকে আমরা কাঠের জিনিস দিয়ে সরিয়ে থাকি কেননা কাঠ বিদ্যুৎ অপরিবাহী হওয়ার বিদ্যুৎ উদ্ধারকারীর শরীরে পৌছাতে পারে না এবং এই সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যাক্তি বেঁচে যায়।

স্থির বিদ্যুং (Static Electricity) স্থির বিদ্যুং (Static Electricity) স্থির বিদ্যুং (Static Electricity)

ঘর্ষনে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি (Static Electricity due to friction)

তোমরা নিশ্চই অবাক হবে শুনে যে, ঘর্ষনের মাধ্যমে পদার্থের পরমানুর এক-দুইটি ইলেকট্রন পরমানু থেকে আলাদা হয়ে যায় যার ফলে স্থিরবিদ্যুৎ তৈরি হয়। চলো ব্যাপারটা উদাহরণ সহকারে বুঝে নিই।

  • এক টুকরো কাঁচকে সিল্ক দিয়ে ঘষা হলে কাঁচের চেয়ে সিল্কের ইলেকট্রন আসক্তি বেশি হওয়ায় কাঁচ থেকে ইলেকট্রন সিল্কে চলে যায় যার ফলে সিল্ক ঋণাত্বক আধানযুক্ত ও কাঁচ ধনাত্বক আধানযুক্ত হয়। এভাবেই কাঁচ ও সিল্কে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয়।

Static Electricity due to friction

 

  • এক টুকরো প্লাস্টিককে ফ্লানেল বা পশমি কাপড় দিয়ে ঘষা হলে প্লাস্টিকের ইলেকট্রন আসক্তি ফ্লানেল থেকে বেশি হওয়ায় প্লাস্টিক ঋণাত্বক আধানযুক্ত ও ফ্লানেল ধনাত্বক আধানযুক্ত হয়। এভাবে প্লাস্টিক ও পশমি কাপড়ে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয়।

 

Static Electricity due to friction

চলো বন্ধুরা, এবার একটা মজার বিষয় জেনে নেয়া যাক। তোমরা হয়তো জানো যে একই চার্জবিশিষ্ট দুটি চার্জ পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত চার্জ পরষ্পরকে আকর্ষন করে। কিন্তু আমাদের প্রমাণ চাই! চলো একটা এক্সপেরিমেন্ট করা যাক।

সিল্কের কাপড় দিয়ে দুটি কাঁচদন্ডকে ঘষে সুতা দিয়ে তা ঝুলালে আমরা দেখতে পাবো যে কাঁচদুটি পরষ্পর বিকর্ষণ করে দূরে সরে যাচ্ছে। একই ব্যাপার প্লাস্টিকের ক্ষেত্রেও ঘটবে। আবার একটি সিল্কের কাপড় দিয়ে একটি কাঁচ ও একটি পশম কাপড় দিয়ে একটি প্লাস্টিককে ঘষে উভয়কে ঝুলালে তা পরষ্পরকে আকর্ষণ করে কাছে সরে আসবে। কী? ইন্টারেস্টিং না?

বৈদ্যুতিক আবেশ (Electrical Induction)

যে পদ্বতিতে কোনো চার্জহীন বস্তুর কাছে কোনো চার্জিত বস্তু আনলে চার্জহীন বস্তুর মাঝে চার্জ জন্ম নেয়, তাকে বৈদ্যুতিক আবেশর ক্ষেত্রে বস্তুদ্বয় স্পর্শ করবেনা। চলো বন্ধুরা, ব্যাপারটা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে বোঝা যাক।

আমরা একটু আগেই জেনেছি যে, দুটি বিপরীত চার্জযুক্ত পদার্থ পরষ্পরকে আকর্ষণ করে। তাহলে একটা ঋণাত্বক আধানযুক্ত প্লাস্টিকের চিরুনি কাগজের টুকরোর কাছে আনলে কাগজগুলো চিরুনির গায়ে লেগে যায় কিভাবে?

এর কারণ হলো বৈদ্যুতিক আবেশ। কোনো চিরুনিকে মাথার চুলে ঘর্ষণের ফলে তার মধ্যে ঋণাত্বক আধান তৈরি হয়। এরপর চিরুনিকে কাগজের টুকরার কাছে আনলে কাগজগুলোর এক প্রান্তে ধ্বনাত্বক আধান ও অন্য প্রান্তে ঋণাত্বক আধান সৃষ্টি হয় যা বৈদ্যুতিক আবেশের কারণে ঘটে থাকে। চিরুনির একপ্রান্তের ধ্বনাত্বক চার্জের প্রতি আকর্ষণটুকু কাগজের অপর প্রান্তের ঋণাত্বক আধানের প্রতি বিকর্ষণের চেয়ে বেশি হওয়ায় কাগজগুলো চিরুনির গায়ে লেগে যায়। এভাবে বৈদ্যুতিক আবেশের জন্ম নেয়।

 

কিন্তু আরেকটা ব্যাপার ঘটে থাকে। চিরুনির গায়ে কাগজগুলো লাগার পর কাগজগুলো আর আবেশিত থাকে না। চিরুনির ঋণাত্বক আধান কাগজে সম্পূর্ণ ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে চিরুনি ও কাগজের পরষ্পরের বিকর্ষণের ফলে কাগজগুলো চিরুনি থেকে ছিটকে পড়ে। তবে, চিরুনির গায়ে কাগজগুলো না লাগলে এক প্রান্তে ধ্বনাত্বক আধান ও অপর প্রান্তে ঋণাত্বক আধান বিদ্যমান থাকতো। আশা করি বন্ধুরা, তোমরা বৈদ্যুতিক আধানের ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছো।

চলো বন্ধুরা, এবার স্থির বিদ্যুতের আরো চমৎকার দুটি উদাহরণ সম্পর্কে জানা যাক।

  1. তোমরা প্রায়ই দেখে থাকবে যে, একটি শিশু কার্পেটের উপর হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময় তার গায়ের চুল খাড়া হয়ে যায়। কিন্তু বন্ধুরা, তোমরা কি ভেবে দেখেছো এর পেছনে কারণটা কী? আসলে ছোট শিশু হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময় কার্পেটের সাথে তার পায়ের ঘর্ষণের ফলে স্থির বিদ্যুৎ অর্থাৎ চার্জ তৈরি হয় যা তার সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। তখন গায়ের লোম বা চুলগুলো একই আধানে আহিত হওয়ায় তারা পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে যার ফলে খাড়া হয়ে যায়

Electrical Induction

 

  • তোমরা জেনে অবাক হবে যে, বজ্রপাতের পেছনেও স্থির তড়িতের অবদান বিদ্যমান। মেঘের সাথে মেঘের ঘর্ষণের কারণে মেঘে বিপুল পরিমাণ চার্জ তৈরি হয় এবং মেঘের এক প্রান্তে ধ্বনাত্বক ও অন্যপ্রান্তে ঋণাত্বক চার্জ হয়ে চার্জ আলাদা হয়ে যায়। অর্থাৎ মেঘে দুই মেরুর সৃষ্টি হয়। ফলে মেঘের নিচে বা ভূমিতে বৈদ্যুতিক আবেশের কারণে চার্জের সৃষ্টি হয়। সেই চার্জ মেঘের এক প্রান্তের চার্জকে আকর্ষণ করে। মাঝে মাঝে আকর্ষণটা এতো বেশি হয় যে মেঘের এক প্রান্তের চার্জ যা ভূমিতে বা নিচে সৃষ্ট চার্জের প্রতি আকর্ষিত হয়ে বাতাস ভেদ করে নিচের চার্জের সাথে যুক্ত হয়ে যা আমরা বজ্রপাত হিসেবে দেখি। আশা করি বন্ধুরা, বুঝতে পেরেছো।

Electrical Induction

ইলেকট্রোস্কোপ (Electroscope)

যে যন্ত্রের সাহায্যে আধানের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় তাকে ইলেক্ট্রোস্কোপ বলে।

Electroscope

 

স্থির বিদ্যুৎ পরীক্ষণের জন্য এই যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। একটি ইলেক্ট্রোস্কোপে একটি ধাতব দন্ডের সাথে দুটি খুব হালকা সোনা বা অ্যালুমিনিয়াম বা অন্য কোনো ধাতব পাত যুক্ত থাকে। পুরো বস্তুটি একটি অপরিবাহী ছিপি দিয়ে কাঁচের বোতলের ভেতর রাখা হয় যেন বাইরের বাতাস ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে।

চার্জ আহিতকরণ (Charging)

একটা প্লাস্টিককে ফ্লানেল দিয়ে ঘষে তা ঋণাত্বক আধানে আহিত হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই আহিত বস্তু দিয়ে তোমরা ইলেকট্রোস্কোপের পাতগুলোর মাঝেও চার্জ তৈরি করতে পারবে। উক্ত প্লাস্টিককে ইলেকট্রোস্কোপের ধাতব চাকতির গায়ে লাগানোর ফলে চার্জটুকু চাকতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। চাকতিটায় ধাতব দন্ডের মাধ্যমে সোনার পাত দুটি যুক্ত থাকায় সেই ঋণাত্বক আধান পাতদুটির মাঝেও ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে পাতদুটি একই চার্জ থাকায় এরা পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে  দূরে সরে যাবে।

চার্জের প্রকৃতি বের করা (Nature of the charge)

কোনো বস্তুতে চার্জ আছে কি নেই তা কীভাবে বুঝবো? ধরি, পূর্বে প্লাস্টিককে ফ্লানেল কাপড় দিয়ে ঘষে চাকতির গায়ে স্পর্শ  করায় প্লাস্টিকের ঋণাত্বক চার্জ পাতদ্বয়ের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে ও পাতদ্বয় পরষ্পর বিকর্ষণ করে দূরে সরে যাবে।

  • এখন, একটা চার্জিত বস্তু এনে চাকতির গায়ে স্পর্শ করালে যদি পাতদ্বয়ের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে বস্তুটি ঋণাত্বক চার্জে আহিত। কেননা, পূর্বে সোনার পাতদ্বয়ের মধ্যে ধ্বনাত্বক চার্জ থাকায় তারা পরষ্পরকে বিকর্ষণের মাধ্যমে দূরে সরে গিয়েছিল। এখন চার্জিত বস্তুর ঋণাত্বক চার্জ পাতদ্বয়ের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ায় পাতদ্বয়ের মাঝে বিকর্ষণ আরো বেশি হবে ও পাতদ্বয়ের মাঝে দূরত্ব আরো বেড়ে যাবে।

Nature of the charge

 

  • আবার চার্জিত বস্তু চাকতি স্পর্শ করার ফলে যদি সোনার পাতদ্বয়ের দূরত্ব কমে যায় তাহলে বুঝতে হবে বস্তুটি ধনাত্বক আধানে আহিত। কেননা, বস্তুটি ধ্বনাত্বক আধানে আহিত হওয়ার কারণেই পাতদ্বয়ের মাঝে পূর্বের বিকর্ষণ বল কমে যায় এবং পাতদ্বয় খানিকটা কাছে চলে আসে।

চার্জের আবে (Induction of Charges)

তোমরা শুনে অবাক হবে যে, কোনো বস্তুতে চার্জ আছে কিনা সেটা স্পর্শ না করেই বোঝা যায়। তা সম্ভব হয়েছে বৈদ্যুতিক আবেশের কারণে।

ধরো, কোনো ধ্বনাত্বক আধানে আহিত বস্তু ইলেকট্রোস্কোপের চাকতির কাছে আনলে চাকতির মাঝে ঋণাত্বক চার্জ আবেশ হবে। যার জন্য যন্ত্রটির অন্যান্য অংশ থেকে ধ্বনাত্বক চার্জ চলে আসবে। এতে করে, সোনার পাতদ্বয়ের মাঝে ঋণাত্বক আধান সৃষ্টি হবে ও এরা বিকর্ষণ করে দূরে সরে যাবে।

 

Induction of Charges