10 Minute School
Log in

ম্যালেরিয়া পরজীবী, হেপাটিক বা যকৃত সাইজোগনি, এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি বা লোহিত রক্ত কণিকায় সাইজোগনি

ম্যালেরিয়া পরজীবী (Malarial parasite) 

ম্যালেরিয়া বিশ্বের প্রাচীনতম রোগগুলোর অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ অব্দের শুরুতে চীন দেশে এটি অনুপম পর্যাবৃত জ্বর(unique periodic fever) হিসেবে নথিভুক্ত ছিল। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য এ রোগের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বলে একে রোমান জ্বরবলা হতো। মধ্যযুগে একে জলা জ্বর(marsh fever) বলা হতো। “Malaria” শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন বিজ্ঞানী Torti (1753)। দুটি ইতালিয় শব্দ Mal (অর্থ-দূষিত) ও aria (অর্থ-বায়ু) হতে Malaria শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে, যার আভিধানিক অর্থ দূষিত বায়ু। তখনকার দিনে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে “দূষিত বায়ু সেবনে ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টি হয়।” ফরাসি ডাক্তার Charles Laveron (1880) ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর লোহিত রক্তকণিকা থেকে ম্যালেরিয়ার পরজীবী আবিষ্কার করলে প্রায় শতবছরের এ ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটে। এজন্য তাঁকে হাজার ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ফিজিওলজি ও মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কর্মরত বৃটিশ সেনাবাহিনীর ডাক্তার Sir Ronald Ross আবিষ্কার করেন যে Anopheles গণভুক্ত মশকীরা এ রোগের জীবাণু একদেহ হতে অন্যদেহে বিস্তার ঘটায়। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তাকে ১৯০২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। মূলত: ম্যালেরিয়া হচ্ছে Anopheles মশকীবাহিত (মশা নয়) এক ধরনের জ্বররোগ। এ রোগে রক্তের লোহিত কণিকা ধ্বংস হয়, তাই রক্তস্বল্পতাসহ (anaemia) বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। Plasmodium গণের প্রায় ৬০টি প্রজাতি মানুষসহ বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীতে এ রোগ সৃষ্টি করে। মানবদেহে এ পর্যন্ত রোগ সৃষ্টিকারী ৪টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে।

ম্যালেরিয়া পরজীবীর শ্রেণিতাত্ত্বিক অবস্থান :

Kingdom: Protista

Subkingdom: Protozoa

Phylum: Apicomplexa

Class: Sporozoa

Order: Haemosporidia

Family: Plasmodiidae

Genus: Plasmodium

Species: Plasmodium vivax, P. ovale, P. falciparum, P. malariae

সাধারণত ৪ ধরনের পরজীবী এর আক্রমণে ম্যালেরিয়া হয়। 

ম্যালেরিয়ার পরজীবীর নাম  রোগের নাম  জ্বরের প্রকৃতি  
১. Plasmodium vivax বিনাইন টারশিয়ান ম্যালেরিয়া  48 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে 
২. Plasmodium malariae কোয়ারটার্ন ম্যালেরিয়া   72 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে 
৩. Plasmodium ovale মৃদু টারশিয়ান ম্যালেরিয়া 48 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে 
৪. Plasmodium falciparum  ম্যালিগন্যান্ট টারশিয়ান ম্যালেরিয়া  36-48 ঘন্টা পর পর জ্বর আসে 

 

ম্যালেরিয়া পরজীবীর জীবন চক্র (The life cycle of the malarial parasite)

জীবন চক্র (Life Cycle)

কোন জীব তার অনুরূপ সৃষ্টি করতে যে সকল ধাপসমূহ অতিক্রম করে, তাদের সমষ্টিকে জীবন চক্র বলে। 

Plasmodium vivax এর জীবন চক্র সম্পন্ন করতে দুটি পোষকের প্রয়োজন হয়, যথা-মানুষ ও মশকী। প্রচলিত সংজ্ঞানুযায়ী মানুষ ম্যালেরিয়া পরজীবীর মাধ্যমিক (intermediate) বা গৌণ (secondary) পোষক (host), কারণ মানবদেহে এ পরজীবীর যৌন জনন হয় না। 

অপরদিকে মশকী এ পরজীবীর নির্দিষ্ট (definite) বা মুখ্য (primary) পোষক, কারণ মশকীর দেহে এ পরজীবীর যৌন পরিপক্বতা তৈরি হয় ও যৌন জনন সম্পন্ন হয়। 

কিন্তু প্রোটোজোয়া-পতঙ্গ-মেরুদণ্ডী সম্পর্কিত পরজীবী পোষক চক্রে প্রজননের গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় বিবেচনা করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পোষক নির্ধারণ করা হয়। তাই মানুষকে এ পরজীবীর মুখ্য পোষক ও মশকীকে গৌণ পোষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

 

মানবদেহে জীবন চক্র (Life cycle in human body)

মানুষের যকৃত ও লোহিত রক্ত কণিকায় ম্যালেরিয়ার পরজীবী অযৌন পদ্ধতিতে জীবন চক্র সম্পন্ন করে। এ জীবন চক্রে ‘সাইজন্ট’ নামক বহু নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট একটি বিশেষ দশা বিদ্যমান থাকে। এ ধরনের জীবন চক্রকে সাইজোগনি বলে। মানবদেহে সংঘটিত সাইজোগনিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 

(১) হেপাটিক সাইজোগনি (Hepatic schizogony) বা যকৃত সাইজোগনি এবং

(২) এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি (Erythrocytic schizogony) বা লোহিত রক্ত কণিকায় সাইজোগনি।  

 

হেপাটিক বা যকৃত সাইজোগনি (Hepatic schizogony)

বিজ্ঞানী Shortt এবং Garnham (1948) মানুষের যকৃতে ম্যালেরিয়ার পরজীবীর হেপাটিক সাইজোগনি চক্রের বর্ণনা দেন। হেপাটিক সাইজোগনি নিম্নলিখিত দুটি পর্যায়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়- 

(ক) প্রি-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি। 

(খ) এক্সো-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি।  

(ক) প্রি-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি (Pre-erythrocytic hepatic schizogony) : 

১। Anopheles মশকীর লালাগ্রন্থিতে অবস্থিত Plasmodium-এর স্পোরোজয়েট (দৈর্ঘ্য 10–14  μm এবং প্রস্থ 0.05-1 μm) দশার পরিণত জীবাণু মশকীর দংশনের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং রক্তস্রোতের মাধ্যমে বাহিত হয়ে কেমোট্যাক্সিস এর কারণে যকৃতে এসে আশ্রয় নেয়। মানবদেহে প্রবেশের প্রায় ৩০-৪৫ মিনিটের মধ্যে জীবাণুগুলো যকৃতের প্যারেনকাইমা কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

২। যকৃত কোষ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে মাকুআকৃতির স্পোরোজয়েটগুলো গোলাকার ক্রিপ্টোজয়েটে পরিণত হয়। 

৩। প্রতিটি ক্রিপ্টোজয়েটের নিউক্লিয়াস ক্রমাগত বিভক্ত হয়ে কয়েকদিনের মধ্যে বহু নিউক্লিয়াস (প্রজাতিভেদে প্রায় ১০০০-১২০০) বিশিষ্ট দশায় পরিণত হয়। পরজীবীর এ দশাকে সাইজন্ট বলে।

৪। পরবর্তী পর্যায়ে সাইজন্টের প্রতিটি নিউক্লিয়াসের চারপাশে কিছু পরিমাণ সাইটোপ্লাজম ও প্লাজমামেমব্রেন সৃষ্টি হয়। পরজীবীর এ দশাকে ক্রিপ্টোমেরোজয়েট বলে। 

৫। চক্রের শেষ পর্যায়ে হেপাটোসাইট ভেঙ্গে যায় এবং ক্রিপ্টোমেরোজয়েটগুলো যকৃতের সাইনুসয়েডে আশ্রয় নেয় এবং এখান থেকে পরবর্তী চক্র শুরু করে। 

পরজীবীর হেপাটিক সাইজোগনি চক্র

(খ) এক্সো-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি (Exo-erythrocytic hepatic schizogony) : 

১। প্রি-এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রে উৎপন্ন ক্রিপ্টোমেরোজয়েটগুলো নতুন হেপাটোসাইটকে আক্রমণের মাধ্যমে এ চক্রের সূচনা করে। 

২। সাইজন্ট (Sigent) : পরিণত ক্রিপ্টোমেরোজয়েটগুলো নতুন যকৃত কোষে প্রবেশ করে নিউক্লিয়াসের বারবার বিভাজনের মাধ্যমে বহু নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট সাইজন্ট দশায় পরিণত হয়। 

৩। মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট (Meta Crypto Merozoite) : সাইজন্টের প্রতিটি নিউক্লিয়াসের চারপাশে সাইটোপ্লাজম জমা হয়ে যেসব নতুন কোষ সৃষ্টি করে তাদেরকে মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট বলে। 

৪। আক্রান্ত যকৃত কোষের ভাঙন (Rupture of infected liver cells) : মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েটগুলো পরিণত হলে আক্রান্ত যকৃত কোষ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে এবং নতুন নতুন যকৃত কোষকে আক্রমণ করে এ চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এ অবস্থায় মানুষের যকৃতে প্রচুর মেরোজয়েট পাওয়া যায়। আকারের ভিত্তিতে এদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-

(১) মাইক্রো-মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট ও (২) ম্যাক্রো-মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট প্রথমোক্তগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট এবং শেষোক্তগুলো অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির। বড় আকৃতির মেরোজয়েটগুলো নতুন যকৃত কোষকে আক্রমণ করে এবং ছোট মেরোজয়েটগুলো যকৃত কোষকে আক্রমণের পরিবর্তে রক্তস্রোতে চলে আসে এবং মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় প্রবেশ করে। স্পোরোজয়েট থেকে এ অবস্থা পর্যন্ত পৌঁছতে পরজীবীর প্রায় ৭-১০ দিন সময় লাগে। মেরোজয়েটগুলো ম্যালেরিয়ার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে যকৃত কোষে সাইজোগনি চালিয়ে যেতে পারে।

 

এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি বা লোহিত রক্ত কণিকায় সংঘটিত সাইজোগনি (Erythrocytic schizogony or schizogony occurring in red blood cells)

প্রি-প্যাটেন্টকাল (রক্তে আত্মপ্রকাশ করার পূর্ব পর্যন্ত সময়) অতিক্রমের পর পরজীবী লোহিত রক্ত কণিকাকে (RBC) আক্রমণ করার মাধ্যমে এ চক্রের সূচনা করে।

১। মাইক্রো-মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েটগুলো যকৃত কোষ থেকে লোহিত রক্ত কণিকায় প্রবেশ করে এবং খাদ্য গ্রহণ করে স্ফীত ও গোলাকার হয়। এই দশাকে ট্রফোজয়েট দশা বলে। এ অবস্থায় জীবাণুর দেহে ক্ষুদ্র একটি কোষ গহ্বর ও ছোট একটি নিউক্লিয়াস দেখা যায়। এটি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী দশা। 

২। কোষ গহ্বরটি ধীরে ধীরে বড় হয় ও নিউক্লিয়াসটি একপাশে সরে যায়, ফলে জীবাণুটি একটি আংটি আকৃতি লাভ করে। এই অবস্থাকে সিগনেট রিং বলা হয়।  

৩। প্রায় ৮ ঘণ্টার মধ্যে পরজীবীর অন্তঃস্থ গহ্বর অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পরজীবীটি ক্ষণপদবিশিষ্ট Amoeba এর আকৃতি প্রাপ্ত হয়, তাই এ দশাকে অ্যামিবয়েড ট্রফোজয়েট বলে। এ সময় লোহিত রক্ত কণিকাটি আকারে স্ফীত হয় এবং এর সাইটোপ্লাজমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা দেখা যায়। এ গুলোকে সাফনার্স দানা (কণা) বলে। রক্ত কণিকায় সাফনার্স দানার উপস্থিতি দেখে ম্যালেরিয়া রোগ শনাক্ত করা হয়।  

৪। অ্যামিবয়েড ট্রফোজয়েট দশার কোষস্থ নিউক্লিয়াস বারবার বিভাজনের মাধ্যমে ১২-২৪টি অপত্য নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে। বহু নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট এ অবস্থাকে সাইজন্ট বলা হয়। এর সাইটোপ্লাজমে হিমোজয়েন নামক বর্জ্য পদার্থ জমা হয়। 

৫। সাইজন্ট দশার প্রতিটি নিউক্লিয়াস প্রায় 45 ঘণ্টা পর সাইটোপ্লাজম ও প্লাজমামেমব্রেনসহ বিভক্ত হয়ে ১২-১৮টি মেরোজয়েট-এ পরিণত হয়। মেরোজয়েটগুলো গোলাপের পাপড়ির ন্যায় দুই স্তরে সজ্জিত হয়। এ দশাকে রোজেট বলে। 

৬। পরবর্তী অবস্থায় লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙ্গে যায় এবং মেরোজয়েটগুলো প্লাজমায় বের হয়ে আসে। মেরোজয়েট রক্তস্রোতে ঢুকে গেলে রক্তের শ্বেত রক্ত কণিকাগুলো তাকে প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করে। এসময় রক্তে প্রচুর পরিমাণে পাইরোজেন নামক রাসায়নিক পদার্থ জমা হয় এবং এর প্রভাবেই দেহে জ্বর আসে। সমগ্র-এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রটি সম্পন্ন হতে প্রায় ৪৮-৭২ ঘণ্টা সময় লাগে। 

Malaria

৭। মুক্ত মেরোজয়েট নতুন লোহিত রক্ত কণিকাকে আক্রমণ করে এবং একইভাবে চক্রটি পুনরাবৃত্তি ঘটায়। 

৮। কতিপয় মেরোজয়েট গ্যামিটোসাইটে পরিণত হয়। গ্যামিটোসাইট দুই প্রকার। পুং গ্যামিটোসাইট বা মাইক্রোগ্যামিটোসাইট এবং স্ত্রী গ্যামিটোসাইট বা ম্যাক্রোগ্যামিটোসাইট। পুং গ্যামিটোসাইটগুলো আকারে ছোট কিন্তু এর নিউক্লিয়াস বড় এবং স্ত্রী গ্যামিটোসাইটগুলো আকারে বড় কিন্তু এর নিউক্লিয়াস ছোট হয়। স্ত্রী ও পুং গ্যামিটোসাইটগুলো পোষক দেহের প্রান্তীয় রক্তনালীতে অবস্থান করে। মানুষের রক্তে গ্যামিটোসাইটগুলোর আর কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হয় না। পরবর্তী ধাপগুলো সম্পন্ন হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা কেবলমাত্র স্ত্রী Anopheles মশকীর দেহেই বিদ্যমান আছে। ৭ দিনের মধ্যে মশকী কর্তৃক শোষিত না হলে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষের রক্তে গ্যামিটোসাইট ৭ দিনের বেশি বাঁচে না।